মিয়ানমারের সংঘাতপ্রবণ রাখাইন অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন একদল বিদেশি সাংবাদিক৷ তাদের নিয়ে যাওয়া হয় এমন সব এলাকায়, যেখান থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে গেছে৷ তবে সাংবাদিকদের ধোঁকা দিতে গিয়ে ফেসেছে স্থানীয়রা৷
বিজ্ঞাপন
মিয়ানমারে আমন্ত্রিত বিদেশি সাংবাদিকদের রাখাইনে নেয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে৷ তাঁদের স্বাধীনভাবে কোথাও যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা ছিল৷ নিষেধাজ্ঞা ছিল খুশিমতো কারো সঙ্গে কথা বলাতেও৷ তবে মিয়ানমার সরকার তাদের নিয়ে গেছে এমন সব এলাকায়, যেখান থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে গেছে৷ সেখানে কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়েছিল সাংবাদিকদের, যারা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে, রোহিঙ্গারা কার্যত স্থানীয় হিন্দুদের উপর হামলা চালিয়েছে৷ এবং নিজেরাই নিজেদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে৷
স্থানীয় এক বৌদ্ধ বাসিন্দা সাংবাদিকদের কয়েকটি ছবি দেখান, যেখানে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল কমলা রংয়ের পোশাক পরা এক মহিলা একটি ঘরে আগুন দেয়ার পর দা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন৷ অপর ছবিতে সেই নারীর সঙ্গে ঘরে আগুন দিতে আরেক পুরুষকে দেখা যায়৷ স্থানীয় এক মঠাধ্যক্ষ এবং সেই বৌদ্ধ সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ছবিতে দেখা মানুষরা রোহিঙ্গা এবং তারা নিজেরাই নিজেদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে৷
কিন্তু বিপত্তি বাঁধে যখন সাংবাদিকরা ছবির সেই মানুষদের কাছেরই একটি স্কুলে আবিষ্কার করেন, যেখানে সহিংসতার শিকারদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছে মিয়ানমার সরকার৷ বার্তা সংস্থা এপি এবং বিবিসি'র সাংবাদিকরা ছবিতে থাকা নারীকে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়৷ আর তাঁর সঙ্গে ছবিতে থাকা পুরুষটিও হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত মিয়ানমারের নাগরিক৷ তাদের দু'জনের পরনে তখনও ছবিতে পরা পোশাকই ছিল৷
ধারনা করা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের উপর দোষ চাপাতে সাংবাদিকরা সেই এলাকায় যাওয়ার কিছু আগে ঘটনা সাজিয়ে ছবিগুলো তোলা হয়েছিল৷ কিন্তু সাংবাদিকরা পরবর্তীতে ছবির মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে আবিষ্কার করায় সেটা আর সম্ভব হয়নি৷
তবে পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকটের ভয়াবহতা বোঝাতে অন্য ঘটনার ছবি রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের ছবি হিসেবে প্রকাশের অনেক ঘটনাও ঘটেছে৷ তার মধ্যে কোনো কোনো ছবি ইন্টারনেটে ভাইরালও হয়েছে৷ এই টুইটে রয়েছে সেরকম কিছু ছবি (গ্রাফিক কনটেন্ট):
উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে পুলিশ চেকপোস্টে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদেরহামলার পর সেখানে অভিযান শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনী৷ এতে প্রাণ হারায় চার শতাধিক ব্যক্তি৷ আর সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী৷
রোহিঙ্গা সংকট: কার কী অবস্থান?
হিংসালীলা ও বৈরি মনোভাবের মুখে মিয়ানমার থেকে দলে দলে পালাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের৷ তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সমাজে সহানুভূতি সত্ত্বেও মূলত কৌশলগত কারণে বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Armangue/AP
বাংলাদেশ
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিচ্ছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ এত সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়া অবশ্যই বিশাল চ্যালেঞ্জ৷ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ চলছে৷ শরণার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ নিয়ে তথ্যভাণ্ডার গড়ার কথা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/Z. H. Chowdhury
ভারত
দেশের উত্তর পূর্বে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে এবং চীনের প্রভাব সীমিত রাখতে ভারতের একের পর এক সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রথম মিয়ানমার সফরে গিয়ে সে দেশের সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন৷ রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যেও প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Sharma
তুরস্ক
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তুরস্ক৷ শুধু কথায় নয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য দিতেও তৎপর সে দেশ৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন৷ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরতেও তৎপর হতে চায় তুরস্ক৷
ছবি: picture-alliance/abaca/K. Ozer
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়া মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়েছে৷ তবে অন্যান্য নথিপত্রহীন বহিরাগতদের মতো তাদেরও নির্দিষ্ট কেন্দ্রে আটক রাখা হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেশনে স্বাক্ষর করেনি৷ তাই সেখানে শরণার্থীরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ছবি: Reuters/Stringer
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি-র প্রতি অগাধ আস্থা দেখিয়েছিলেন৷ বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলেও সরাসরি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কূটনৈতিক অবস্থান নেয় নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Watson
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতা দাবি করেছে৷ সেইসঙ্গে এই সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বন্ধ করার ডাক দিয়েছে ইইউ৷ শরণার্থীদের সহায়তা করতে বাংলাদেশে ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর অঙ্গীকার করেছে এই রাষ্ট্রজোট৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
চীন
মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে চীনের দীর্ঘ ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে৷ সে দেশে কৌশলগত স্বার্থের খাতিরেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সরকারের বিরোধিতা করছে না চীন৷ জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের সরকারের জন্য জরুরি৷
ছবি: Reuters/R. Dela Pena
রাশিয়া
চীনের মতো রাশিয়াও মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে৷ জাতিসংঘে সে দেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে এই দুই ভেটো শক্তি৷ এদিকে রাশিয়ার মুসলিম-প্রধান চেচনিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মস্কোর উপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Z.Bairakov
জাতিসংঘ
জাতিসংধের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির মোকাবিলার উদ্যোগ নিচ্ছে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে হিংসালীলা বন্ধ করার ডাক দিয়েছেন৷ প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের নেতৃত্বে এক কমিশন পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে৷ তবে নিরাপত্তা পরিষদ এখনো প্রকাশ্যে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি৷