রোহিঙ্গা জাতিকে নির্মূলের লক্ষ্যে গণহত্যা পরিচালনা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী৷ আর আন্তর্জাতিক সমাজ এই গণহত্যা রোধে উদ্যোগী হচ্ছে না বলে বার্লিনে এক সম্মেলনে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির রাজধানী বার্লিনের ইহুদি জাদুঘরে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেন গণহত্যা বিষয়ক একাধিক গবেষক, অধ্যাপক, রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্ট এবং আইনজীবীরা৷ ‘বার্লিন কনফারেন্স অন রোহিঙ্গা জেনোসাইড' শীর্ষক সম্মেলনে বক্তারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য মিয়ানমারে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পর্যাপ্ত উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে মত দেন৷
বার্লিন সম্মেলনের আহ্বায়ক ড. মারিয়া দো মার কাস্ত্রো ভ্যারেলা এই বিষয়ে বলেন, ‘‘অনেকে বলেন, আমাদের গণহত্যার কথা বলা উচিত নয়৷ কেননা, গণহত্যার মানদণ্ড পূর্ণ হয়নি৷ কিন্তু আমরা মনে করি, সেটা হয়েছে৷ মিয়ানমারে গণহত্যা হচ্ছে৷ তাই রোহিঙ্গাদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি৷''
বিশেষজ্ঞরা রাখাইনে গণহত্যা হচ্ছে বললেও জাতিসংঘ সেটা মনে করছে না৷ এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন বার্লিন সম্মেলনে অংশ নেয়া বক্তারা৷ তাঁরা মনে করেন, কোনো দেশে গণহত্যা পরিচালিত হচ্ছে স্বীকার করা হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য সেটা বন্ধে উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব তৈরি হয়৷ রাখাইন অঞ্চলের সঙ্গে যেহেতু চীনসহ একাধিক শক্তিশালী রাষ্ট্রের ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত আছে, তাই তাদের চাপে কঠোর হতে পারছে না জাতিসংঘ৷
বার্লিনে ইহুদি জাদুঘরের কাছেই হলোকস্ট মেমোরিয়াল অবস্থিত৷ চট্টগ্রাম থেকে আসা রোহিঙ্গা আইনজীবী সুলতানা রাজিয়া সম্মেলনের ফাঁকে মেমোরিয়াল পরিদর্শন করেন৷ তিনি মনে করেন, রোহিঙ্গাদের নির্মূলের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে মিয়ানমার৷
তবে তথ্য-উপাত্ত যা-ই থাক, রাখাইনে গণহত্যা বা নির্বিচারে রোহিঙ্গা হত্যা হচ্ছে বলে মানতে রাজি নয় মিয়ানমার৷ সেদেশের সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, ‘‘রাখাইনের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে ‘জাতিগত নির্মূল' বা ‘গণহত্যার' মতো শব্দ ব্যবহারে আপত্তি জানাচ্ছে সরকার৷''
উল্লেখ্য, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করছেন৷ তাঁরা শীঘ্রই নিজেদের দেশে ফিরে নিরাপদে জীবনযাপন করতে পারবেন, এমন সম্ভাবনা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা৷
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷