বিএনপি মনে করে, ভাসানচরে পাঠানোর ফলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠানো কঠিন হয়ে যাবে৷ এক বিবৃতিতে দলটি আরো বলেছে, এই স্থানান্তরের ফলে মিয়ানমারেরই সুবিধা হবে৷
বিজ্ঞাপন
বিএনপি'র স্থায়ী কমিটি বৈঠক করে এই বিবৃতি দিয়েছে৷ বিএনপি সহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আপত্তির মুখে রোহিঙ্গা শরণার্থী স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত ও তা বাস্তবায়নের এই প্রক্রিয়াকে আত্মহননের প্রক্রিয়া হিসাবে অভিহিত করেছে স্থায়ী কমিটি৷ এর ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্মান ও নিরাপত্তার সা্থে প্রত্যাবর্তনের দাবি দুর্বল হবে বলে সভা মনে করে৷’’
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ‘‘এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া মিয়ানমারের স্বার্থ রক্ষায় সাহায্য করবে এবং এই সমস্যা একদিকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করবে, অন্যদিকে বাংলাদেশের পরিবেশ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে৷’’
এটা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন না করে বাংলাদেশে পুনর্বাসনের ইঙ্গিত দেয়: আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী
ওই সভায় উপস্থিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান৷ মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে৷ কোর্ট অব জাস্টিসের চাপ বাড়ছে৷ তাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য গ্রহণযোগ্য পরিবেশের চাপ বাড়ছে৷ কফি আনান রিপোর্ট বাস্তবায়নের আলাপ চলছে৷ তালিকা পাঠানো হয়েছে৷ রাখাইনে স্থাপনা তৈরি হচ্ছে, রোহিঙ্গারা যাতে ফিরে যেতে পারে৷ ঠিক সেই সময়ে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর কী মেসেজ দেয়? এটা রোহিঙ্গাদের মিয়নমারে প্রত্যাবাসন না করে বাংলাদেশে পুনর্বাসনের ইঙ্গিত দেয়৷’’
তিনি বলেন, দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করে ভাসানচরে স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে৷ কেন করা হলো? এটা বাংলাদেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা৷ আর জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর বিরোধী৷ তারা এখন কী ভাববে?
বিএনপি দুইবার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
জাতিসংঘ বিরোধিতা করার পর বিএনপি বিরোধিতা করছে- এমন মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এটা ঠিক নয়৷ আমরা আগে থেকেই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর বিরোধিতা করেছি৷ দুই-তিনটি সেমিনার করেছি৷ আমরা কি রাস্তায় নামবো? এই সরকার তো রাস্তায় প্রতিবাদ করতে দেয় না৷’’
‘‘বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে দুইবার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়ছে৷ একবার জিয়াউর রহমানের সময় এবং আরেকবার খালেদা জিয়ার সময়৷ তাহলে এখন কেন পারা যাবে না? এটা এই সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা,’’ বলেন তিনি৷
তার মতে, এই সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে সামরিক কৌশলেও ব্যর্থ হয়েছে৷ জিয়াউর রহমানের সময় বর্ডারে যে শক্ত অবস্থান ছিল তা এখন নাই৷ তারা বাংলাদেশের আকাশে ঢুকে পড়ছে৷ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না৷
বিএনপি'র এই নেতা মনে করেন, রোহিঙ্গা ইস্যু সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে সামনে থেকে পিছনে চলে গেল৷ মিয়ানমার এখন আগের চেয়ে আরো সুবিধা পেয়ে গেল৷
ভাসানচরে স্থানান্তর: কী বলছেন রোহিঙ্গারা
শুক্রবার রোহিঙ্গাদের প্রথম ব্যাচ ভাসানচরে পৌঁছেছে৷ তাদের অনেকে সেখানকার সুযোগ-সুবিধা দেখে ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন৷ তবে জোর বা নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও আছে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
ভাসানচর প্রকল্প
প্রায় তিন হাজার একশ কোটি টাকা খরচ করে ভাসানচরে আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার৷ সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে৷ স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ভাসানচরে যাওয়া প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবার আলাদা ঘর পাচ্ছে, আছে রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা৷ সেই সঙ্গে আছে খেলার মাঠ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ৷
ছবি: DW/A. Islam
প্রথম ব্যাচ পৌঁছেছে
বাসে ও জাহাজে করে প্রথম ধাপে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা শুক্রবার ভাসানচরে পৌঁছেছেন৷ পরে তাদের অনেককে মোবাইল ফোনে কক্সবাজারে থাকা সঙ্গীদের ভাসানচরের খবর দিতে দেখা গেছে৷ কেউ কেউ ভিডিও কলও করেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
বাবা-মাকে আনতে চান হোসেন
কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্প থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাসনচরে গেছেন মোহাম্মদ হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে অনেক ভালো লাগছে৷ আমি এখানে ঘুরেফিরে আবার কক্সবাজার যাবো৷ ওখানে গিয়ে তাদের (বাবা-মা ও ভাইয়ের পরিবার) নিয়ে আসবো৷ তারা যদি না আসে, তাহলে আমি আবার এখানে ফিরে আসবো৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
‘আল্লাহ মিলায়ে দিছে’
কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে গেছেন মোহাম্মদ জোবায়ের৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘এত ভালো পরিবেশের কথা আমরা ভাবতেই পারছি না৷ জীবনে আমরা এত ভালো বাসায় থাকতে পারিনি, থাকতে পারব এটাও আশা করিনি৷ আল্লাহ আমাদের মিলায়ে দিছে৷’’
ছবি: bdnews24.com
নিরাপত্তাবোধ
বালুখালীর ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাওয়া আবদুর রহমান এখন নিজেকে কিছুটা নিরাপদ ভাবছেন৷ ‘‘ওখানে (বালুখালী ক্যাম্পে) ঘরের বেড়া কেটে চুরি করে নিয়ে যেতো৷ ঘুমিয়ে থাকলে ছুরিও মারতো৷ এখানে তা পারবে না৷ যে ঘরটা পেলাম, সেটা খুবই নিরাপদ৷ কেউ চাইলেই চুরি করতে বা ঘরে ঢুকতে পারবে না৷’’
ছবি: DW/A. Islam
‘লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে’
বালুখালীর ক্যাম্প থেকে স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে ভাসানচরে যাওয়া আব্দুস সামাদ বলেন, ‘‘এখানে এসে খুব ভালো লাগছে৷ ঘরবাড়ি অনেক৷ অনেক বড় বড় রুম৷ এখানে লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে৷ বড় খেলার মাঠ আছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে জায়গা কম৷ মানুষ অনেক৷ একজন বের হলে আরেকজন বের হওয়ার জায়গা থাকে না৷’’
ছবি: DW/N. Conrad
পার্থক্য
ভাসানচর আর কক্সবাজারের পরিবেশের পার্থক্য সম্পর্কে জমিনা আক্তার বলেন, ‘‘এখানে বেশি ভালো লাগছে৷ ভালো ঘর, থাকার জায়গা ভালো৷’’
ছবি: bdnews24.com
নির্যাতনের অভিযোগ
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের উখিয়ায় একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে নেয়া হয়েছিল৷ সেখানে উপস্থিত ৬০ বছর বয়সি শরণার্থী সুফিয়া খাতুন এএফপিকে জানান, ‘‘আমার ছেলে যেন ঐ দ্বীপে যেতে রাজি হয় সেজন্য তারা আমার ছেলেকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে, তার দাঁত ভেঙে ফেলেছে৷ আমি এখানে তাকে ও তার পরিবারকে হয়ত শেষবারের মতো দেখতে এসেছি৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
‘নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না’
ট্রানজিট ক্যাম্পে উপস্থিত আরেক শরণার্থী হাফেজ আহমেদ এএফপিকে বলেন, ‘‘গত দুইদিন ধরে আমার ভাই নিখোঁজ ছিল৷ আমরা জানতে পেরেছি, সে এখানে আছে৷ এখান থেকে তাকে দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হবে৷ সে সেখানে নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
জাতিসংঘের আশঙ্কা, অভিযোগ
জাতিসংঘের আশঙ্কা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ভাসানচরে পানি উঠে গিয়ে রোহিঙ্গাদের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে উঠতে পারে৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে যুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ তাদের৷ ভাসানচরে স্থানান্তর প্রসঙ্গে রোহিঙ্গারা যেন ‘স্বাধীন ও তথ্যসমৃদ্ধ’ সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ৷
ছবি: DW/A. Islam
‘ভুল ব্যাখ্যা’ না দেয়ার অনুরোধ
রোহিঙ্গারা ‘স্বেচ্ছায়’ ভাসানচরে গেছে জানিয়ে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ‘‘জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একমাত্র বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হওয়া উচিত প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে ও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত হওয়া, সেটাই একমাত্র স্থায়ী সমাধান৷ একইসঙ্গে বাংলাদেশের আন্তরিক চেষ্টাকে খাটো করা ও ভুল ব্যাখ্যা না করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে সবার প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বিএনপির বক্তব্য
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ায় তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছে বিএনপি৷ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে উপেক্ষা করে এই স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে ‘আত্মহনন’ বলেও আখ্যায়িত করেছে দলটি৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
12 ছবি1 | 12
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘আমরা সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে না পাঠানোর জন্য বলেছি৷ আমরা তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলেছি৷ এখন ভাসানচরে পাঠানোর মাধ্যমে সরকার তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলো৷ ফলে সরকার মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার জন্য যে চাপ সৃষ্টি করতে পারতো সেই জায়গায় দুর্বল হয়ে পড়লো৷ মিয়ানমার সুযোগ পেয়ে গেল৷ একটা বার্তা গেল যে, রোহিঙ্গাদের আমরা স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি দুইবার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠিয়েছে মিয়ানমারে৷ এখন মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জায়গাটা দুর্বল হয়ে গেল৷’’
তার মতে, ভাসানচরে সর্বোচ্চ এক লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো যাবে৷ আরো সাত লাখ তো কক্সবাজারে থেকে যাবে৷ ফলে যে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও স্থানীয় অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বলা হচ্ছে তার তেমন কোনো উন্নতি হবে না৷
আর কোনো রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পঠানোর আহ্বান জানচ্ছেন কিনা প্রশ্ন করলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে পাঠাতে হবে৷ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতার প্রশ্ন নয়, আমরা বলছি এটা করার কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের অবস্থান দুর্বল হয়ে যাবে৷’’
এই বিষয় নিয়ে বিএনপি সরকারকে বার বার সহযোগিতা করতে চেয়েছে, আলোচনা করতে চেয়েছে, কিন্তু সরকার তা আমলে নেয়নি বলে দাবি করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী৷
ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ শুক্রবার নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের তত্ত্বাবধানে এক হজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে ৭টি জাহাজে করে ভাসান চরে নেয়া হয়েছে৷