বিষয়টি নিয়ে ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে মিয়ানমারের বক্তব্য চেয়েছিলেন আইসিসির বিচারকরা৷ এ বিষয়ে মিয়ানমার কেন আইসিসির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায় না এবং তারা কেন বক্তব্য দেবে না, তার একটি ব্যাখ্যাও মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির দপ্তর দিয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স৷
এক বিবৃতিতে সুচির দপ্তর বলেছে, ‘প্রসিকিউটরের আবেদন মিয়ানমারের ওপর বিচারিক এখতিয়ার পাওয়ার একটি পরোক্ষ চেষ্টা হয়ে থাকতে পারে, যেখানে দেশটি রোম সনদের স্টেট পার্টিই নয়৷'
এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আইসিসির বক্তব্য পায়নি রয়টার্স৷
বিশ্বের প্রথম স্থায়ী যুদ্ধাপরাধ আদালত আইসিসির শুধু সদস্য দেশগুলোর ভেতরের বিষয়ে কার্যক্রম পরিচালনার এখতিয়ার রয়েছে বা বিষয়গুলো তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাঠাতে পারে৷
তবে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগের ঘটনা ‘আন্তঃসীমান্ত বিরোধের মধ্যে পড়ে' বলে আইসিসি প্রসিকিউটর ফাতোও বেনসুদা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আদালতের কাছে আবেদন করেন৷ এরপর আদালত বাংলাদেশের কাছে বিষয়টি নিয়ে মতামত চাইলে তাতে সম্মতি জানানো হয়েছিল বলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন৷
অং সান সু চির দপ্তর বলেছে, ‘‘প্রসিকিউটরের এই মামলায় অংশ হওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই মিয়ানমারের এবং এ বিষয়ে এখতিয়ার দেওয়া হলে তা ভবিষ্যতে ‘নানা জনপ্রিয় বিষয়' এবং আইসিসি সদস্য বহির্ভূত দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার একটি ‘বিপজ্জনক নজির‘ তৈরি হবে৷''
এ বিষয়ে আইসিসির বিরুদ্ধে ‘প্রক্রিয়াগত অনিয়ম' এবং ‘স্বচ্ছতার ঘাটতির‘ অভিযোগও তুলেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ৷
গত বছর আগস্টের শেষ দিকে রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরু হলে বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে৷ কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে বলে জাতিসংঘের ভাষ্য৷
কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া এসব রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মতো মানতবাবিরোধী অপরাধের বিবরণ দিয়েছেন৷
মিয়ানমার বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান' হিসেবে বর্ণনা করে আসছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা৷
মিয়ানমার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য না হওয়ায় সেখানে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার নেই আইসিসির৷
সে কারণে এখতিয়ারের পক্ষে আদেশ চেয়ে ওই আবেদন করেন বেনসুদা৷ দাবির পক্ষে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা যেহেতু মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, তাদের বিতাড়নের বিষয়টি যেহেতু আন্তঃসীমান্ত অপরাধের পর্যায়ে পড়ে এবং বাংলাদেশ যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য, সেহেতু বিদ্যমান আইনি কাঠামোর মধ্য থেকেই আইসিসি ঘটনাটি খতিয়ে দেখার এখতিয়ারের পক্ষে রুল দিতে পারে৷
একটা সময় ছিল যখন কয়েকজন রোহিঙ্গা মিয়ানমার সংসদে সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ আর এখন রোহিঙ্গাদের ভোট দেয়ারই অধিকার নেই৷
ছবি: DW/M.M. Rahmanবর্তমানে মিয়ানমার নামে পরিচিত দেশে ১২ শতক থেকে মুসলমানরা বাস করছে বলে দাবি অনেক ইতিহাসবিদ ও রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমার যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন (১৮২৪-১৯৪৮) ছিল তখন বর্তমানের ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেকে শ্রমিক হিসেবে সেখানে গিয়েছিল৷ তবে তারা যেহেতু ব্রিটিশ আমলে এসেছে তাই স্বাধীনতার পর মিয়ানমার তাদের অবৈধ হিসেবে গণ্য করে৷ প্রতিবেদন পড়তে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters/Z. Bensemraবাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সংসদকে জানান, বার্মায় ১৯৫১ সালের নির্বাচনে পাঁচজন ও ১৯৫৬ সালে ছ’জন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ সব মিলিয়ে মিয়ানমার সংসদে মোট ১৭ জন রোহিঙ্গা সাংসদ ছিলেন বলে জানান তিনি৷ এর মধ্যে দুজন ছিলেন নারী৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Gacad১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক অভ্যুত্থান হয়৷ এরপর সব নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধন কার্ড করতে বলা হলেও রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছিল বিদেশি পরিচয়পত্র৷ ফলে রোহিঙ্গাদের জন্য চাকরি ও পড়াশোনার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়৷ ছবিটি ১৯৬২ সালের ৪ মার্চ তৎকালীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন থেকে তোলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFPরোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে তাড়াতে ১৯৭৭ সালে নির্যাতন শুরু করা হয়৷ ফলে ১৯৭৮ সালের মে মাসের মধ্যে প্রায় দু’লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর জুলাইতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ জাতিসংঘও মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল৷ ফলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল মিয়ানমার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/K. Hudaবাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়া ঐ চুক্তির উপর ‘সিক্রেট’ অর্থাৎ ‘গোপন’ শব্দটি লেখা ছিল৷ ২০১৪ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়টি চুক্তিটি প্রকাশ করে৷ এতে দেখা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে যাঁদের পরিবারের একসময় জাতীয় নিবন্ধন কার্ড ছিল তাঁদের মিয়ানমার সরকার ‘বার্মার বৈধ বাসিন্দা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ চুক্তিটি পড়তে উপরে (+) চিহ্ন ক্লিক করুন৷
ছবি: http://dataspace.princeton.edu১৯৮২ সালে পাস হওয়া নতুন নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের বস্তুত রাষ্ট্রহীন করে দেয়া হয়৷ ঐ আইনে মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতিগত গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম নেই৷ এই আইনের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য পড়াশোনা, চাকরি, ভ্রমণ, ধর্মীয় রীতিনীতি পালন, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া ইত্যাদি সীমিত হয়ে যায়৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভোটের অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়৷
ছবি: Reuters/C. McNaughton১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে আবার রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার৷ ফলে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর তাদের ফিরিয়ে নিতে দুই দেশ একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছিল৷ বিবৃতিতে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমারের বাসিন্দা’ এবং ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল৷
গত আগস্টের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান শুরু করে৷ ইতিমধ্যে এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ৷ নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ছয় লক্ষ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে৷ তবে তাদের ফিরিয়ে নিতে দু’দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman এএইচ/ডিজি