পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে নতুন করে পুরান কথা
২১ অক্টোবর ২০২২তার এই দাবি কতটা বাস্তবানুগ?
বাংলাদেশে এখন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৩ জন৷ ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর নির্যাতনের শিকার হয়ে এবং নির্যাতন থেকে বাঁচতে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়৷ আরপর তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে৷আগে থেকেই চার লাখের মতো রোহিঙ্গা সেখানে ছিল৷ প্রতিবছর ২৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে বলে ইউএনএইচসিআর-এর ফ্যাক্ট শিট বলছে৷
২০১৭ সালের শেষ দিকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি করে৷ ২০১৯ সালে স্বল্প পরিসরে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন তুলে রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি হননি৷ ২০২১ সালের জানুয়ারিতে চীনকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত হলেও ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তা৷
এরপর চলতি বছরের মার্চে ৭০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার আগ্রহ দেখায় মিয়ারমার৷ এই তথ্য তখন সংবাদমাধ্যমকে জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম৷ তবে তাতেও কোনো অগ্রগতির খবর ছিল না৷ শাহরিয়ার আলম তখন বলেন যে, বাংলাদেশ চায় প্রথম দফায় তারা এক হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নিক৷
তবে বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিংয়ের সঙ্গে ঢাকায় এক বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে চীনের রাষ্ট্রদূত কোনো সুখবর দিতে পারেননি৷সুখবর শুধু এটা যে তারা (মিয়ানমার সরকার) আগের চুক্তি অনুযায়ী এখনো এক পায়ে দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গাদেরকে নেওয়ার জন্য৷’’
বাস্তব পরিস্থিতি কী?
বাস্তব পরিস্থিতি হলো বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত আগের চুক্তি অনুযায়ী আট লাখ ২৯ হাজার ৩৬ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা ‘ক্লিয়ারেন্সের জন্য’ মিয়ানমারকে দিয়েছে৷ তাদের মধ্যে ২৯ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের নাগরিক বলে এখন পর্যন্ত তারা নিশ্চিত বা স্বীকার করেছে৷ বাকিদের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি৷ এখন পর্যন্ত একজনকেও ফেরত নেয়নি৷
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত মার্চে মিয়ানমার ৭০০ জনের তালিকা পাঠিয়ে তাদের ফেরত নেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে৷ কিন্তু তাতে সমস্যা হচ্ছে, অনেক পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে৷ তাই মন্ত্রণালয় এটার ওপর কাজ করছে৷ কাজ করতে গিয়ে দেখেছে এক হাজারের একটু বেশি হলে এর মধ্যে যারা যাবেন তাদের পরিবারের সবাইকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে৷ সেভাবে একটি প্রস্তাব মিয়ানমারকে পাঠানো হয়েছে৷ তবে এখনো কোনো জবাব মিয়ানমার দেয়নি৷ বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে৷
ওই সূত্র জানায়, এর বাইরে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোরক বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই৷ এক প্রশ্নের জবাবে ওই সূত্র জানায়, ‘‘মিয়ানমার কখনোই বলেনি তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না৷ কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী আমরা যে তালিকা পাঠিয়েছি, তাদের মধ্যে তারাই নির্ধারণ করবে কারা তাদের নাগরিক৷ তারা যাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করবে, তাদের তো ফেরত নেবে না৷ আর এটা তারা ঠিকমতো করছে না৷ তাই রোহিঙ্গাদের যে তারা ফেরত নেবে এটা কোনো নতুন খবর নয়৷ বিষয় হলো তারা কতজনকে ফেরত নেবে, কবে ফেরত নেবে৷’’
মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকার যে চীনের সঙ্গে আলাপ করছে, এটাই একমাত্র সুখবর৷ এর বাইরে তাদের যে শিগগিরই মিয়ানমার তাদের ফেরত নেবে এমন কোনো প্রক্রিয়া আমি আপাতত দেখছি না৷ আর কোনো সুখবর নেই৷’’
তিনি বলেন, ‘‘পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চীনা রাষ্ট্রদূতকে আরো একটি কথা বলেছেন যে, মিয়ানমার রাজি হয়েছে রোহিঙ্গাদের নেয়ার জন্য৷ এই শব্দটা গুরুত্বপূর্ণ৷ এই প্রথম চীন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে কিছু বললো৷ ভারত তো কিছুই বলে না৷ সেইদিক থেকে আমার ভালো লেগেছে৷ তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার কোনো লক্ষণ আমি এখনো দেখছি না৷ আরেকটি ব্যাপার হলো উত্তর রাখাইনে যেখান থেকে অধিকাংশ রোহিঙ্গা এসেছে সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির ভয়াবহ যুদ্ধ হচ্ছে৷ মিয়ানমার সেনাবাহিনী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পোস্টের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে৷ ফলে ওটাই তাদের এখন মাথা ব্যথা৷ রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের আপাপতত কোনো চিন্তা আছে বলে আমার মনে হয় না৷’’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন, তা নতুন কোনো কথা নয়৷ মিয়ানমারের সাথে তো আমাদের চুক্তিই আছে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে৷ মূল বিষয় হলো ভ্যারিফিকেশন৷ সেখানেই তো তারা ঝামেলা করছে৷’’
তার কথা, ‘‘চীন যদি কিছু করতে পারে তা আমাদের খোলাখুলিভাবে বলুক৷ আমাদের সঙ্গে তো মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি আছে৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পুরনো কথা বলছেন৷ আমি এর মধ্যে আশার কিছু দেখছি না৷’’