হিন্দুর সন্তান হয়ে রোজা রাখছেন টালিগঞ্জের এক অভিনেতা। তাতেই তৈরি হয়েছে বিতর্ক। নেটমাধ্যমে ট্রোলিংয়ের মুখে পড়েও অভিনেতা অবিচল তার সিদ্ধান্তে।
বিজ্ঞাপন
আপত্তি আগেও উঠেছিল। সাংসদ-অভিনেত্রী নুসরত জাহানের পর তালিকায় এবার অভিনেতা ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূলের সাংসদ নুসরত বিয়ে করে মাথায় সিঁদুর পরে, হাতে চূড়া পরে সংসদে শপথ নিয়েছিলেন। এই ঘটনা নিয়ে নেটদুনিয়ায় ব্যাপক ট্রোল করা হয় মুসলিম অভিনেত্রীকে। এবার অভিযোগের আঙুল হিন্দু অভিনেতা ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ের দিকে। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কলাকুশলীদের উৎসর্গ করে এই প্রথমবার রোজা রাখার কথা বলেছিলেন খ্যতিমান এই অভিনেতা। তার দাবি, "আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অনেক মুসলিম মেকআপ আর্টিস্ট, ড্রেসার রোজা রেখে কাজ করেন দিনের পর দিন। আমি না হয় আমার মতো করে তাদের প্রতি আমার ভালবাসা, সম্মান ফেরত দিলাম!” এতেই আক্রমণের মুখে পড়েছেন তিনি। অভিনেত্রী দেবলীনা দত্তও গোমাংস খাওয়া নিয়ে মন্তব্যের জেরে সম্প্রতি কট্টরপন্থীদের অশালীন মন্তব্যের শিকার হয়েছেন।
রাজ্যে এখন বিধানসভা ভোটের গরম হাওয়া। সঙ্গে চলছে মেরুকরণের রাজনীতি। তার রেশ ধরে অনেক নেটনাগরিক তার উপর গোমাংস ভক্ষণ বা মুসলিম তোষণের অভিযোগ আনছেন। যদিও ভাস্বর তার উত্তরে লিখেছেন, "না, গরু আমি খাই না আর রোজা রাখলে কারোর পা চাটতেও হয় না। সবটাই নিজের ইচ্ছের ব্যাপার।”
দেবদূত ঘোষ
ভাস্বর দীর্ঘদিনের অভিনেতা। দলবদলের যুগেও তাঁকে কোনো রাজনৈতিক শিবিরে দেখা যায়নি। বড় পর্দার পাশে টেলিভিশনে ‘জয় বাবা লোকনাথ', ‘ওম সাঁইরাম' ধারাবাহিকে লোকনাথ এবং সাঁইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে সমাদৃত হয়েছেন তিনি। মেকআপ আর্টিস্ট মহম্মদ নুরকে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর চরিত্রে রূপদানের জন্য কৃত্বিত্বও দিয়েছেন অতীতে। ভাস্বর জানিয়েছেন, হিন্দু সাধক লোকনাথ নিজেও নাকি কোরান পাঠ করতেন। তার মতে, "লোকনাথ বাবার এই আচরণ আমায় ছুঁয়ে গিয়েছিল। তার থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আমার এই পদক্ষেপ।”
এই পদক্ষেপকে নেটনাগরিকরা অনেকেই ভাল চোখে দেখছেন না। কিন্তু কী বলছেন তার সতীর্থরা?
টালিগঞ্জের অভিনেত্রী ও পরিচালক সুদেষ্ণা রায় ভাস্বরের এই মন্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বাঙালির চরিত্র এমনই হওয়া উচিত। ভাস্বর দেখিয়েছেন বাঙালিরা গোবলয়ের মতো নয়। রামকৃষ্ণও তো নামাজ পড়েছিলেন। ভাস্বর যা করেছেন, বেশ করেছেন।” সুদেষ্ণার পাশাপাশি অভিনেতা দেবদূত ঘোষও সমর্থন জানিয়েছেন ভাস্বরকে। তিনি বলেন, "আমাদের সংবিধানে ১৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে নাগরিকদের। ভাস্বরের উপর এমন আক্রমণে আমি খুবই আঘাত পেয়েছি। তাহলে তো সংবিধানটা তো পাল্টাতে হয়। শুটিংয়ের সময় আমাদের মুসলিম টেকনিসিয়ানরা যখন রোজা ভাঙত, আমরা একসঙ্গেই তো খাওয়াদাওয়া করেছি।” দেবদূত এ বারের টালিগঞ্জ বিধানসভা নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চার সিপিআইএম প্র্রার্থী।
সম্প্রীতির কলকাতা
ধর্ম নয়, সকলের সব উৎসবে সামিল কলকাতার মানুষ।
ছবি: Sudipta Bhoumik/DW
ঈদের কলকাতা
ঈদের নামাজে মুসলিমরা এ ভাবেই রেড রোডে সমাবেত হন। নামাজের পর গোটা শহর জুড়ে খাওয়াদাওয়ার হিরিক লেগে যায়। সেখানে সামিল হন হিন্দু-মুসলিম সকলেই। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঈদের নামাজের ব্যবস্থা করেন হিন্দুরাও। বহু হিন্দু তাঁদের বাড়ির ছাদ খুলে দেন মুসলিমদের প্রার্থনার জন্য।
ছবি: Sudipta Bhoumik/DW
ঐতিহ্যের রক্ষক
শুধু কলকাতা নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গেই এমন অনেক মসজিদ এবং ইমামবারা আছে, যার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সামলান হিন্দুরা। আবার বহু হিন্দু মন্দির রক্ষণাবেক্ষণ করেন মুসলিমরা। পাথরার ইয়াসিন পাঠান তেমনই এক মানুষ। প্রাচীন মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করেন তিনি।
ছবি: Sudipta Bhoumik/DW
দুর্গা প্রতিমার নির্মাতা
এই কলকাতাতেই দুর্গা প্রতিমা তৈরি করেন মুসলিম ভাস্কর। দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ খুব আনন্দের সঙ্গে করেন। বিশ্বাসী এই ভাস্কর বিশ্বাস করেন প্রতিমা তৈরির সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই।
ছবি: Sudipta Bhoumik/DW
খ্রিস্টান মাস
এই কলকাতাই আবার মেতে ওঠে বড়দিনে। দিকে দিকে জ্বলে ওঠে আলো। পার্কস্ট্রিটে হয় কার্নিভাল। মিশনারিদের মাস মিছিলে যোগ দেন অসংখ্য সাধারণ মানুষ। মাঝ রাতে সেন্ট পলস, জোড়া গির্জার প্রার্থনায় যোগ দেন হিন্দু-মুসলিম সকলেই।
ছবি: Sudipta Bhoumik/DW
নকশি কাঁথা
নকশা করা যে কাঁথার উপর নামাজ পড়ছেন এই নারীরা, সেই কাঁথা তৈরি করেছেন প্রতিবেশী হিন্দুরা। উপহার দিয়েছেন ঈদে।
ছবি: Sudipta Bhoumik/DW
রামকৃষ্ণের মন্দির
কালীর উপাসক ছিলেন রামকৃষ্ণ। কিন্তু কোনও ধর্মকেই অবহেলা করেননি তিনি। ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিও তাঁর অগাধ টান ছিল। সে কারণেই এখনও রামকৃষ্ণ মিশনে যীশুর পুজো হয়। ইসলামকেও অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ছবি: Sudipta Bhoumik/DW
দশমীর কোলাকুলি
ঈদের কোলাকুলিতে যেমন ধর্ম থাকে না, তেমনই সব ধর্ম এক হয়ে যায় শারদোৎসবে। বিজয়ার দিনে দুর্গা প্রতিমায় সিঁদুর লাগিয়ে সব ধর্মের মানুষ একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। এটাই আসলে কলকাতার ধর্ম।
ছবি: Sudipta Bhoumik/DW
7 ছবি1 | 7
সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা সুহৃতা সাহার যুক্তি, ইফতারে বা দুর্গাপূজায় একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া আর কোনো হিন্দুর রোজা রাখার বিষয়টি এক নয়। সুহৃতা বলেন, "আমি যে ধর্মের আচার পালন করতে চাইছি, তাতে সংশ্লিষ্ট ধর্মের মানুষদের অনুমোদন আছে তো? ভাস্বরের আন্তরিকতা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুলছি না, বরং যারা তাকে ট্রোল করেছে, তাদের নিন্দা করছি। কিন্তু এ ধরনের আপাত-উদার পদক্ষেপের নেপথ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে।” এরই সঙ্গে তিনি সংবিধানের সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলার পক্ষপাতী নন।
ভোটের মরসুমে হঠাৎ করে রোজা রাখার বিষয়ে অনেকে রাজনীতির গন্ধও পাচ্ছেন। মানিকতলার একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক অরূপ দত্ত বলেন, "এতদিন পরে হঠাৎ রোজা রাখার প্রয়োজন কেন? তাও বিধানসভা ভোট চলাকালীন?” অবশ্য পবিত্র রোজার উপবাস প্রসঙ্গে ভাস্বর তার ফেসবুকে প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে লেখেন, "একজন জানতে চেয়েছেন আমি উপোস করি কিনা। আমার বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়। তাই উপোস করার অভ্যেস আছে।”
সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে দূর করা যায়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আট নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ ছবিঘরে থাকছে তাঁদের কথা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সাদেকা হালিম, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে৷ এছাড়া দেশের প্রতিটি মানুষকে যার যার অবস্থান থেকে একসঙ্গে কাজ করলে অসাম্প্রদায়িক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব৷ এ ব্যাপারে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে৷ আরেকটি বিষয় হলো, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সকল ধর্মের সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
গোলাম কুদ্দুস, সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট
কোনো ধর্মই মানুষের অকল্যাণের কথা বলে না৷ পৃথিবীর সব ধর্মই মানুষের কল্যাণের কথা বলে৷ তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে কেউ যাতে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে৷ দেশের প্রতিটি মানুষকে যদি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় তাহলেও দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
আইনুন নাহার সিদ্দিকা, আইনজীবী
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সব রকমের রাজনৈতিক উস্কানি বন্ধ করতে হবে৷ আমরা যেন এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের পেছনে কখনো না লাগি৷ সবাই সবার ধর্মকে সম্মান করি৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
শেখ শাফায়াতুর রহমান, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কখনো শক্তি আর অস্ত্র দিয়ে লড়াই করা যাবে না৷ আমাদেরকে আমাদের বুদ্ধি আর মেধা দিয়ে লড়াই করতে হবে৷ গ্রামে-গঞ্জে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
রেখা শাহা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে দেশের সর্বত্র সকল ধর্মের উৎসব নির্বিঘ্নে পালন করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে৷ সবাই যেন সবার ধর্মীয় উৎসবগুলোতে অংশ নিতে পারেন, সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে৷ এছাড়া সবাই মিলে একটি দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারলে সাম্প্রদায়িকতাও দেশ থেকে দূর হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
খরাজ মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা, পশ্চিমবঙ্গ
আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ৮৫ শতাংশ মেকআপ আর্টিস্টই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের৷ কই, আমাদের তো সমস্যা হয় না! আমরা মন থেকে কোনও বিভেদে বিশ্বাস রাখি না৷ তাই নিজেদের মধ্যেও বিভেদ জন্মায় না৷ মনের অন্ধকার দূর করাটাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার৷
সত্যিকারের জ্ঞান মনের সংকীর্ণতা দূর করে৷ তাই শুধু ডিগ্রি দিয়ে লাভ নেই৷ জ্ঞানের আলো জ্বালাতে প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে৷ সেটাই হবে আদর্শ জ্ঞাননির্ভর সমাজ৷ সেই সমাজ এমন মানুষ তৈরি করবে, যার মধ্যে উগ্রতা থাকবে না৷
ছবি: DW/P. Samanta
পতিতপাবন রায়, পিয়ারলেস, পশ্চিমবঙ্গ
ব্যক্তিগতস্তরে ধর্মীয় অনুশাসন মানতে অসুবিধে নেই৷ কিন্তু সমষ্টিগতস্তরে মানতে হবে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন৷ দেওয়ানি বিধির অধীনে সবাইকে রাখতে হবে৷ রাজনীতির অনুপ্রবেশ রুখে সবার জন্য সমান আইন প্রণয়ন দরকার৷ তবেই রাস্তা আটকে নামাজ পড়া বা মণ্ডপ তৈরি নিয়ে দাঙ্গা হবে না বা রক্তও ঝরবে না৷
ছবি: DW/P. Samanta
8 ছবি1 | 8
এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক রজত রায় উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের ছবি তুলে ধরেন। ডিরোজিয়ানরা পুরোনো প্রথা ভাঙতে ধর্মের বিরুদ্ধে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। রজত বলেন, "বিদ্রোহ এভাবেই হয়। এখন তথাকথিত হিন্দু ধর্মের নয়া সংজ্ঞা তৈরি করা হচ্ছে। এখানে এটা করবে না, ওটা করবে না বলা হচ্ছে। নিচুতলার দলিত হিন্দুরা অনেকে বৌদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। ভাস্বরের মত একান্ত ব্যক্তিগত হলেও এটা রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বলে ধরা যেতে পারে। তবে এই প্রতিবাদটা খুব একটা কার্যকর হবে না।"