মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ৷ কিন্তু এই মানবিকতার কারণেই এখন নানা ঝুঁকিতে পড়েছে দেশটি৷ খুব সহসাই এ সংকটের সমাধান হবে না৷ ফলে সারাদেশে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, আছে নানা চ্যালেঞ্জও৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
বিজ্ঞাপন
রোহিঙ্গাদের মধ্যে আছে এইডস আক্রান্ত মানুষ৷ বাংলাদেশে এখন কলেরা না থাকলেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে সেই সমস্যাও৷ বন উজার হচ্ছে, পাহাড় কেটে ধ্বংস করছে তারা৷ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকিও আছে এর সঙ্গে৷ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও প্রকট হতে পারে, বাড়তে পারে নিরাপত্তা ঝুঁকিও৷ সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এই সমস্যাগুলো কীভাবে মোকাবেলা করবে সেটা ঠিক করাই এখন একটা চ্যালেঞ্জ৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারকে এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে৷ না হলে দেশকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে৷
রোহিঙ্গাদের ইতিহাস
একটা সময় ছিল যখন কয়েকজন রোহিঙ্গা মিয়ানমার সংসদে সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ আর এখন রোহিঙ্গাদের ভোট দেয়ারই অধিকার নেই৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
স্বাধীনতার আগে
বর্তমানে মিয়ানমার নামে পরিচিত দেশে ১২ শতক থেকে মুসলমানরা বাস করছে বলে দাবি অনেক ইতিহাসবিদ ও রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমার যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন (১৮২৪-১৯৪৮) ছিল তখন বর্তমানের ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেকে শ্রমিক হিসেবে সেখানে গিয়েছিল৷ তবে তারা যেহেতু ব্রিটিশ আমলে এসেছে তাই স্বাধীনতার পর মিয়ানমার তাদের অবৈধ হিসেবে গণ্য করে৷ প্রতিবেদন পড়তে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters/Z. Bensemra
রোহিঙ্গা সাংসদ
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সংসদকে জানান, বার্মায় ১৯৫১ সালের নির্বাচনে পাঁচজন ও ১৯৫৬ সালে ছ’জন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ সব মিলিয়ে মিয়ানমার সংসদে মোট ১৭ জন রোহিঙ্গা সাংসদ ছিলেন বলে জানান তিনি৷ এর মধ্যে দুজন ছিলেন নারী৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Gacad
অভ্যুত্থান
১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক অভ্যুত্থান হয়৷ এরপর সব নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধন কার্ড করতে বলা হলেও রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছিল বিদেশি পরিচয়পত্র৷ ফলে রোহিঙ্গাদের জন্য চাকরি ও পড়াশোনার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়৷ ছবিটি ১৯৬২ সালের ৪ মার্চ তৎকালীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন থেকে তোলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFP
প্রথমবার বিতাড়ন
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে তাড়াতে ১৯৭৭ সালে নির্যাতন শুরু করা হয়৷ ফলে ১৯৭৮ সালের মে মাসের মধ্যে প্রায় দু’লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর জুলাইতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ জাতিসংঘও মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল৷ ফলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল মিয়ানমার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/K. Huda
‘গোপন’ চুক্তি
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়া ঐ চুক্তির উপর ‘সিক্রেট’ অর্থাৎ ‘গোপন’ শব্দটি লেখা ছিল৷ ২০১৪ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়টি চুক্তিটি প্রকাশ করে৷ এতে দেখা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে যাঁদের পরিবারের একসময় জাতীয় নিবন্ধন কার্ড ছিল তাঁদের মিয়ানমার সরকার ‘বার্মার বৈধ বাসিন্দা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ চুক্তিটি পড়তে উপরে (+) চিহ্ন ক্লিক করুন৷
ছবি: http://dataspace.princeton.edu
রাষ্ট্রহীন
১৯৮২ সালে পাস হওয়া নতুন নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের বস্তুত রাষ্ট্রহীন করে দেয়া হয়৷ ঐ আইনে মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতিগত গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম নেই৷ এই আইনের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য পড়াশোনা, চাকরি, ভ্রমণ, ধর্মীয় রীতিনীতি পালন, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া ইত্যাদি সীমিত হয়ে যায়৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভোটের অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়৷
ছবি: Reuters/C. McNaughton
দ্বিতীয় পর্যায়ের বিতাড়ন
১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে আবার রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার৷ ফলে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর তাদের ফিরিয়ে নিতে দুই দেশ একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছিল৷ বিবৃতিতে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমারের বাসিন্দা’ এবং ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল৷
সবশেষ ঘটনা
গত আগস্টের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান শুরু করে৷ ইতিমধ্যে এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ৷ নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ছয় লক্ষ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে৷ তবে তাদের ফিরিয়ে নিতে দু’দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
8 ছবি1 | 8
রয়েছে এইডস, বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ৯৭ জন এইচআইভি পজেটিভ৷ ফলে ওই অঞ্চলে এইডস-এর ঝুঁকি বাড়ছে৷ তাই এইচআইভি ছড়ানো ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার৷ গত ২৫ আগস্ট থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা৷ নতুন আর পুরোনো মিলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস৷
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. আবদুস সালাম বলেন, ‘‘এইডস রোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে৷ প্রতিদিনই এইডস-এ আক্রান্ত তিন-চারজন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন৷'' তাঁর কথায়, ‘‘পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৯২ জন আগে থেকেই আক্রান্ত ছিলেন৷ নতুন করে চিহ্নিত হয়েছেন পাঁচজন৷ এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের শনাক্ত করতে টেকনাফ ও উখিয়ায় দু'টি ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে৷ সাধারণ রোগের চিকিৎসায় রক্ত পরীক্ষা করিয়ে অনেকের শরীরে এইডস পাওয়া গেছে৷ তবে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় অনেকের রক্ত পরীক্ষা করা যাচ্ছে না৷''
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন৷ ফলে স্থানীয় লোকজনের চিকিৎসাসেবা পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে৷ তার ওপর রোহিঙ্গারা যেখানে সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করছেন৷ ফলে পানিবাহিত রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি হয়েছে৷ আসলে এখনও তাঁদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ করা যায়নি৷
‘এত কম সময়ে একটা নিয়মিত বাহিনীর পক্ষে এ ধরনের হামলা চালানো কিছুতেই সম্ভব নয়’
This browser does not support the audio element.
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশ অবশ্যই স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে৷ আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তাঁরা বিভিন্ন ধরনের রোগ নিয়ে এসেছেন৷ রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে৷ কারণ দুই লাখ মানুষের জন্য যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তৈরি, সেখানে ৭ থেকে ৯ লাখ মানুষের সেবা দিতে হচ্ছে৷ আমরা এটাও জানতে পেরেছি যে, পোলিও টিকা ছাড়া তাঁরা কোনো ধরনের টিকা পাননি৷ তাই আমাদের শিশুদের জন্য রাখা হাম-রুবেলার টিকা রোহিঙ্গা শিশুদের দেয়া হয়েছে৷ কারণ হাম একবার দেখা দিলে ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ তাছাড়া মিয়ানমারে কলেরা সমস্যা রয়েছে৷ তাই সংকটকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মজুদ ১০ লাখ টিকার ৯ লাখই রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছে৷
দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক চাপে পড়বে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার৷ সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার মাথাপিছু আয় হওয়ার কথা ১১২ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা৷ কিন্তু আশ্রিত হিসেবে রোহিঙ্গাদের আয়ের কোনো উৎস নেই৷ জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় প্রায় ৭০০ ডলার৷ কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যয় থাকলেও বৈধপথে আয়ের কোনো উৎস নেই৷ সেই হিসাবে এই ৭ লাখ রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হবে প্রায় ৪৯ কোটি ডলার বা ৩ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা, যা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা৷ বর্তমানে কিছু সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদি এই সাহায্য অব্যহত থাকবে সেটা বলা মুশকিল৷ যখন পাওয়া যাবে না তখন বাংলাদেশকেই এই টাকা খরচ করতে হবে৷
‘রোহিঙ্গাদের ওই এলাকা থেকে বাইরে আসতে না দিলে ভালো হবে’
This browser does not support the audio element.
রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের আর্থিক চাপে পড়তে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পেছনে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়৷ সেজন্য সেখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন নিয়োগ করতে হয়েছে৷ এর ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ছে৷ আর এই ব্যয়টা খরচ হচ্ছে বাজেট থেকে৷ অথচ রোহিঙ্গা সমস্যা না থাকলে এই টাকা অন্য জায়গায় ব্যয় করা যেত৷ সেটা করা গেলে দেশের কিছু মানুষ তো অন্তত ভালো থাকত!''
তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ খুব বড় ধরনের চাপে পড়বে না বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের ওই এলাকা থেকে বাইরে আসতে না দিলে ভালো হবে৷ তাঁদের জন্য আমাদের বড় আকারে সাহায্য দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেই আমরা এই খরচগুলো পাব৷ তবে তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতসহ অন্যান্য কাজে আমাদের কিছু লোকবল ওখানে দেয়া লেগেছে৷ সেজন্য প্রশাসনিক ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে৷''
আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এখন স্থানীয় নাগরিকরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন৷ দিন দিন পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠছে৷ এমন পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ জরুরি৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে এক পর্যায়ে দেশ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে৷ সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একসময় এ সব ভুলে যাবে৷ অন্য সমস্যার ভিড়ে তখন এটা ক্ষুদ্র ইস্যুতে পরিণত হবে৷
‘পরিবেশ এবং বনভূমির কথা চিন্তা করলে রোহিঙ্গাদের জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ’
This browser does not support the audio element.
জানা গেছে, ওই এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে৷ ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে৷ নিয়ম অনুযায়ী আশ্রিতরা কোনো কাজে নিয়োজিত হতে পারবে না, কিন্তু তারা অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লবণ মাঠ, চিংড়ি হ্যাচারি, চাষাবাদের কাজসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়েছে৷ এতে স্থানীয় দরিদ্র শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে৷ উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে শিক্ষাব্যবস্থা একদম ভেঙে পড়েছে৷ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছেন৷ সেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অর্ধেকেরও কম৷ স্থানীয় কট্টরপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের কর্মী যোগাতে অনেক রোহিঙ্গা যুবককে কাছে টানছে বলেও অভিযোগ আছে৷ রোহিঙ্গারা যদি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে৷
তাছাড়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ এর জন্য তাঁরা দেশীয় দালালদের সহায়তায় ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করছেন৷ সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন জানান, ‘‘আমরা জানতে পেরেছি, মাত্র ১৪ হাজার টাকার বিনিময়ে এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের ন্যাশনাল আইডি (এনআইডি) পাচ্ছে রোহিঙ্গারা৷ এভাবে এনআইডি নিয়ে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে৷'' তিনি বলেন, কোনো সম্প্রদায়কে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দীর্ঘদিন আটকে রাখা যায় না৷ ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা তরুণরা সপ্তাহে একদিন রেশন তুলবে আর বাকি দিনগুলো বসে থাকবে, তা হবে না৷ তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দেখা দেবে৷ তারা ক্যাম্প থেকে গোপনে বেরিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
8 ছবি1 | 8
কক্সবাজারে পর্যটনে ধস নামার আশঙ্কা
রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে ধস নামার আশঙ্কা আছে৷ এখনই রোহিঙ্গা নারীদের কক্সবাজারে অবাধে চলাফেরা করতে দেখেছেন অনেকে৷ দেহ ব্যবসায়ও অনেক নারীকে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে৷ এ নিয়ে স্থানীয়রা উদ্বিগ্ন, উদ্বিগ্ন প্রশাসনও৷ এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজারকে অনেকেই পাশ কাটিয়ে অন্য পর্যটনকেন্দ্রে চলে যেতে পারেন৷ এমনটা হলে কক্সবাজারের পর্যটনে ভয়াবহ ধস নামতে পারে৷
কক্সবাজারের প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজারে সাড়ে তিনশ' হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস ও কটেজ রয়েছে৷ পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীদের অনেককেই হোটেল-মোটেলে দেহব্যবসায় পাওয়া যাচ্ছে৷ এঁদের মধ্যে এইডস আক্রান্তরাও রয়েছেন৷ তাঁদের সঙ্গে পর্যটকসহ হোটেল-মোটেল শ্রমিকদের শারীরিক মেলামেশায় বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় অনেকে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ায় দেশে এইডস ছড়ানোর আশঙ্কা আছে৷
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলায় তাঁরা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন৷ এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের কাছেও তাঁরা আশ্রয় নিচ্ছেন৷ পুরনো রোহিঙ্গারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ' করে নানা রকম অবৈধ ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত রয়েছেন৷ কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ৷ অভাব অনটনে পড়া রোহিঙ্গা নারীরা যদি কক্সবাজারে অবাধে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অনেকেই সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন৷ এমনকি দেশের মানুষও পরিবার নিয়ে সেখানে যেতে অনাগ্রহ দেখাবেন৷
ধর্ষণ আর অপহরণের শিকার রোহিঙ্গা এতিম শিশুরা
মিয়ানমার সেনাদের সীমাহীন নির্যাতনের কারণে গত আড়াই মাসে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে৷ সবচেয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখে পড়েছে শিশুরা৷ জন ওয়েনস এর ছবিতে উঠে এসেছে সেইসব দুর্দশার কিছু কথা৷
ছবি: DW/J. Owens
গুলি আর ছুরিকাঘাত
গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়েছে৷ তাদেরই একজন মোহাম্মদ বেলাল৷ দৌড়ে পালাতে পেরেছিল ১০ বছর বয়সি এই কিশোর৷ সে জানায়, ‘‘সেদিন সেনাবাহিনী এসে পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়৷ আমার মা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেসময় তাঁকে গুলি করা হয়৷ আমার বাবা হাঁটতে পারছিলেন না, তারা তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে৷ আমি নিজ চোখে এসব দেখেছি৷’’
ছবি: DW/J. Owens
আতঙ্কগ্রস্ত
মোহাম্মদ বেলালের বোন নূরও হত্যাযজ্ঞ দেখেছে৷ নিঃসঙ্গ হয়ে সে আর তার ভাই এখন বাংলাদেশে শিশুদের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আছে৷ এখানে সে নিয়মিত খাবার পাচ্ছে এবং খেলতে পারছে৷এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য৷ মিয়ানমারে থাকার সময় তাদের দুই ভাই-বোনকে বেশিরভাগ সময়ই না খেয়ে থাকতে হতো৷ তারপরও সাম্প্রতিক এই ট্রমা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না সে৷ ‘‘আমি আমার বাবা-মা, বাড়ি আর দেশ, সবকিছুই ভীষণ মিস করছি,’’ জানায় নূর৷
ছবি: DW/J. Owens
গভীর সঙ্কট
৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে চলছে এই সঙ্কট৷ সংঘাতে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দু’ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে৷ সাম্প্রতিক সেনা নিপীড়নের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ১২ বছর বয়সি রহমান বলে, ‘‘তারা আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ অসুস্থ ছিল বলে আমার মা পালাতেও পারেনি৷’’
ছবি: DW/J. Owens
শিশুদের বাঁচাও
বাবা-মাকে হত্যার দৃশ্য নিজ চোখে দেখার পর দিলু আরা তার বোন রোজিনার সাথে পালায়৷ এখন ক্যাম্পে আছে ৫ বছর বয়সি এই শিশু৷ ‘‘আমি খুব কাঁদছিলাম আর পুরোটা সময়ই আমাদের মাথার উপর দিয়ে বুলেট উড়ে যাচ্ছিল৷ কোনো রকমে আমি পালিয়ে এসেছি,’’ বলে শিশুটি৷ বাবা-মা ছাড়া কুতুপালংয়ে আসা এই শিশুদের সাহয়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন৷ বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের শতকরা ৬০ ভাগই শিশু৷
ছবি: DW/J. Owens
পশুদের মতো শিকার
জাদেদ আলমও বাবা-মা ছাড়া কুতুপালংয়ে এসেছে৷তবে ভাগ্য ভালো বলে সে তার চাচীকে সাথে পায়৷চাচীই এখন তার দেখাশোনা করছেন৷ সে বলছিল ‘মান্দি পাড়া’ নামে এক গ্রামে বেড়ে উঠেছে সে৷ ফুটবল খেলতেও সে খুব পছন্দ করতো৷ তবে সেনা অভিযানের পর থেকে সবকিছুই বদলে যায়৷ সে জানায়, ‘‘তারা আমাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে বলে৷ আমি আমার বাবা-মা’র সাথে দৌড়ে পালাচ্ছিলাম, এমন সময় তাঁদেরকে গুলি করে সেনারা৷ সাথে সাথে মারা যায় তারা৷’’
ছবি: DW/J. Owens
শিশু অপহরণ
এসব ঘটনার সময় সব পরিবারকেই যে আলাদা হতে হয়েছে, তা নয়৷ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রহমান আলী নামে এই ব্যক্তি এই ক্যাম্পে আছেন৷ তবে এখন তিনি তার ১০ বছর বয়সি ছেলে জিফাদকে খুঁজে পাচ্ছেন না৷ ক্যাম্প এলাকায় প্রায় সারা বছরই শিশু অপহরণের গুজব শোনা যায়৷ রহমানের আশংকা, তাঁর ছেলেও পাচারকারীদের হাতে পড়েছে৷ ‘‘আমি খেতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি না৷ আমি মনে হয় পাগলই হয়ে গেছি,’’ বলে রহমান৷
ছবি: DW/J. Owens
‘আমি স্বাভাবিক নেই’
যখন গুলি শুরু হয়, তখন সকিনা খাতুন তাঁর বাচ্চাদের বাঁচাতে প্রাণপণে চেষ্টা করেছে৷ তারপরও ১৫ বছরের ইয়াসমিন আর ২০ বছরের জামালিকে বাঁচাতে পারেননি৷ ঘটনার সময় তারা পাশের গ্রামে ছিল৷ সকিনা বলছিল, ‘‘দাদা-দাদীর সামনে তাদের গলা কেটে হত্যা করা হয়৷ আমি এতটাই অনুভূতি শূণ্য হয়ে পড়েছি যে, এই কষ্টও অনুভব করতে পারছি না৷ তাই এই মুহূর্তে আমি স্বাভাবিক নেই৷’’ দুই সন্তানকে হারালেও বাকি নয় জনকে রক্ষা করতে পেরেছেন তিনি৷
ছবি: DW/J. Owens
হামলা, ধর্ষণ এবং লুটপাট
ইয়াসমিনের বয়স ১৫-র কাছাকাছি৷ তবে তাকে তার চেয়েও কম বয়সি বলে মনে হয়৷ গ্রামে থাকার সময় সে মার্বেল খেলতো আর বাড়ির কাছের মাঠে খেলতো৷ এখন অবশ্য ভিন্ন স্মৃতি তাড়িত করছে তাকে৷ মিয়ানমারের সেনারা তার বাবা ও ভাইদের প্রথমে মারধর ও পরে হত্যা করে৷ একদল সেনা তাকে ধর্ষণও করে৷ এখন ইয়াসমিন কেবল এটুকু বলতে পারে,‘‘আমার শরীরে ভীষণ ব্যথা৷’’
ছবি: DW/J. Owens
8 ছবি1 | 8
রয়েছে নিরাপত্তা ঝুঁকি
বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে কট্টরপন্থি মনোভাবাপন্ন যুবকদের কাছে টানার চেষ্টা করছে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন৷ এত বেকার যুবকের মধ্যে হতাশা কাজ করা স্বাভাবিক৷ জঙ্গি সংগঠনগুলো এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে৷ মৌলবাদী দলগুলোও যে এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে, এমন তথ্যের কথা জানিয়েছেন গোয়েন্দারা৷ রোহিঙ্গা যুবকরা মাদক পাচারে আগে থেকেই জড়িত৷ বাংলাদেশে ইয়াবা যা ঢোকে তার ৯০ ভাগই মিয়ানমার থেকে৷ ইয়াবা এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা৷ তাঁদের এ সব কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে এ দেশের কিছু মানুষ৷ অভিযোগ রয়েছে, এবারও পালিয়ে আসার সময় অনেক রোহিঙ্গা সঙ্গে করে কিছু ইয়াবাও এনেছেন৷ তাঁরা যখন দলে দলে এখানে ঢোকেন, তখন তাঁদের তল্লাশি করে ঢোকানোর কোনো সুযোগ ছিল না৷
নিরাপত্তা বিশেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বলা হচ্ছে আরসার ২০০ সদস্য দা-কুড়াল এবং কিছু ছোট অস্ত্র নিয়ে একই সময়ে সেনা ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারসহ ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়েছে৷ আমার যতটুকু সামরিক জ্ঞান আছে, তাতে মনে হচ্ছে, অত অল্পসংখ্যক মানুষের, এত কম সময়ে একটা নিয়মিত বাহিনীর পক্ষে এ ধরনের হামলা চালানো কিছুতেই সম্ভব নয়৷ বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিতে তারা (মিয়ানমার সেনাবাহিনী) তাদের লোক দিয়ে এ হামলা করিয়েছে কিনা, সেটা চিন্তা করতে হবে৷'' তিনি বলেন, প্রচুরসংখ্যক ৯-১০ বছরের শিশু কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছে৷ যাদের সামনে বাবা-মাকে হত্যা করা হয়েছে এবং বোনকে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ তারা এক সময়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে৷ তেমনটা হলে এটা শুধু মিয়ানমারের জন্যই নয়, আশ্রয়দাতা দেশের জন্যও নেতিবাচক হতে পারে৷ তাই ওইসব শিশুর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে৷
পাহাড়-বনের অপূরণীয় ক্ষতি
কক্সবাজারের উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের দু'পাশে কালো রঙের পলিথিন দিয়ে বানানো হয়েছে শত শত ঝুপড়িঘর৷ যতদূর চোখ যায় একই চিত্র৷ পাহাড়-বনাঞ্চল এখন আর কিছুই চোখে পড়ে না৷ পাহাড়গুলো কেটে এই ঝুপড়িঘরগুলো বানানো হয়েছে৷ বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে চার হাজার একর পাহাড় কেটে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি করা হয়েছে৷ এই ঝুপড়িঘরগুলো রোহিঙ্গারা নিজেরাই তৈরি করেছে৷ ফলে ওই এলাকায় ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটু ভারী বৃষ্টিপাত হলেই ধসে পড়তে পারে পাহাড়৷ এতে বহু মানুষ হতাহতের আশঙ্কাও করা হচ্ছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ‘‘মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি৷ কিন্তু পাহাড়গুলো কেটে তারা যে আবাসস্থল বানাচ্ছে, তাতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল৷ এক সময় হয়ত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে, নতুন করে হয়ত গাছও লাগানো যাবে, কিন্তু পাহাড়গুলোর ক্ষতি আর পূরণ করা যাবে না৷ অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে তো আর পাহাড়ের কাটা জায়গা পূরণ করা যাবে না৷ এই পাহাড়গুলো ১৫-২০ মিলিয়ন বছরের (দেড় থেকে দু'কোটি বছর) পুরনো৷ পাহাড়গুলো কাটার ফলে এখন বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মধ্যে পানি ঢুকে পড়বে৷ এতে যে কোনো সময় পাহাড় ধসে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে৷ ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েছেই৷ আর যাতে ক্ষতি না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে৷ এখনই ব্যবস্থা না নিলে আমাদের এই ক্ষতি আর পূরণ করা সম্ভব হবে না৷
কক্সবাজার জেলা বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির জানান, উখিয়া রেঞ্জে কুতুপালং, থাইংখালী ও আশপাশের পাহাড়ের প্রায় তিন হাজার একর জায়গায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে৷ এছাড়া টেকনাফ রেঞ্জে ৪৫০ একর, পুটিবুনিয়া রেঞ্জের ৫০ একর এবং শিলখালী রেঞ্জের ৩৭৫ একর পাহাড়ি বন কেটে রোহিঙ্গা বসতি করা হয়েছে৷
কক্সবাজার এলাকার পাহাড় ও বন নিয়ে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক ড. দানেশ মিয়া৷ এই অধ্যাপক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পরিবেশ এবং বনভূমির কথা চিন্তা করলে রোহিঙ্গাদের জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ৷ সবাইকে রান্না করে খেতে হচ্ছে৷ এক লক্ষ চুলা যদি থাকে, সেই এক লক্ষ চুলার জন্য প্রতিদিন যদি ন্যূনতম পাঁচ কেজি জ্বালানি ধরি, তাহলে প্রতিদিন পাঁচ লক্ষ কেজি কাঠ পুড়ছে৷ এগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের উখিয়া টেকনাফের জঙ্গল থেকে যাচ্ছে৷ এই অবস্থা অব্যহত থাকলে বনভূমির বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে৷''
স্থানীয় পরিবেশবাদীদের হিসাব অনুসারে, পাহাড়ের আশেপাশের জায়গা ধরলে রোহিঙ্গাদের বস্তির জায়গার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার একর৷ এই বিপুল পরিমাণে পাহাড় কাটায় এলাকায় মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদী ও স্থানীয় ব্যক্তিরা৷ যে কোনো সময় বড় রকমের পাহাড়ধস ঘটার আশঙ্কায় তাঁরা উদ্বিগ্ন৷
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷
রোহিঙ্গা সংকট: কার কী অবস্থান?
হিংসালীলা ও বৈরি মনোভাবের মুখে মিয়ানমার থেকে দলে দলে পালাতে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের৷ তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সমাজে সহানুভূতি সত্ত্বেও মূলত কৌশলগত কারণে বিভিন্ন দেশ ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Armangue/AP
বাংলাদেশ
মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশেই আশ্রয় নিচ্ছে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ এত সংখ্যক মানুষকে আশ্রয় দেওয়া অবশ্যই বিশাল চ্যালেঞ্জ৷ আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয়ের উদ্যোগ চলছে৷ শরণার্থীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে তাদের আঙুলের ছাপ সংগ্রহ নিয়ে তথ্যভাণ্ডার গড়ার কথা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/Z. H. Chowdhury
ভারত
দেশের উত্তর পূর্বে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে এবং চীনের প্রভাব সীমিত রাখতে ভারতের একের পর এক সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে চলেছে৷ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রথম মিয়ানমার সফরে গিয়ে সে দেশের সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন৷ রাখাইনের অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যেও প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Sharma
তুরস্ক
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তুরস্ক৷ শুধু কথায় নয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য দিতেও তৎপর সে দেশ৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে যাবতীয় সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন৷ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরতেও তৎপর হতে চায় তুরস্ক৷
ছবি: picture-alliance/abaca/K. Ozer
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়া মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয়ের আশ্বাস দিয়েছে৷ তবে অন্যান্য নথিপত্রহীন বহিরাগতদের মতো তাদেরও নির্দিষ্ট কেন্দ্রে আটক রাখা হবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷ উল্লেখ্য, মালয়েশিয়া জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেশনে স্বাক্ষর করেনি৷ তাই সেখানে শরণার্থীরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ছবি: Reuters/Stringer
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি-র প্রতি অগাধ আস্থা দেখিয়েছিলেন৷ বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এখনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়নি৷ মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর দুশ্চিন্তা প্রকাশ করলেও সরাসরি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো কূটনৈতিক অবস্থান নেয় নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Watson
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সহযোগিতা দাবি করেছে৷ সেইসঙ্গে এই সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন বন্ধ করার ডাক দিয়েছে ইইউ৷ শরণার্থীদের সহায়তা করতে বাংলাদেশে ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর অঙ্গীকার করেছে এই রাষ্ট্রজোট৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
চীন
মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে চীনের দীর্ঘ ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে৷ সে দেশে কৌশলগত স্বার্থের খাতিরেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সরকারের বিরোধিতা করছে না চীন৷ জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমারের সরকারের জন্য জরুরি৷
ছবি: Reuters/R. Dela Pena
রাশিয়া
চীনের মতো রাশিয়াও মিয়ানমারের সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে৷ জাতিসংঘে সে দেশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে এই দুই ভেটো শক্তি৷ এদিকে রাশিয়ার মুসলিম-প্রধান চেচনিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে মস্কোর উপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Z.Bairakov
জাতিসংঘ
জাতিসংধের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির মোকাবিলার উদ্যোগ নিচ্ছে৷ জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে হিংসালীলা বন্ধ করার ডাক দিয়েছেন৷ প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নানের নেতৃত্বে এক কমিশন পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে৷ তবে নিরাপত্তা পরিষদ এখনো প্রকাশ্যে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি৷