মিয়ানমারের সীমান্ত ছাড়িয়ে এ সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিনিধিরা৷ তাঁরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এ ‘হত্যাযজ্ঞ ও জাতিনিধন' চলতে থাকলে সামনে আরো কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
সোমবার ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান দূত জায়িদ রা'দ আল-হুসেইন বলেন, ‘‘মিয়ানমারের জন্য কঠিন সংকট আসছে, এই সংকট এই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পুরো অঞ্চলের জন্য ক্ষতিকর৷''
প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য
গেল সপ্তাহে মিয়ানমারের রাখাইনে গণকবর পাওয়া যাবার খবর প্রকাশিত হবার পর এমন বক্তব্য এলো জাতিসংঘের কোনো দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে৷
মিয়ানমার গণকবরের বিষয়টি বার বার অস্বীকার করলেও কোনো সাংবাদিক বা জাতিসংঘের তদন্তকারীদের সেখানে যেতে দিচ্ছে না৷ জায়িদ বলেন, রাখাইন অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল ঘরে তুললেও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য চালিয়েছে মিয়ানমার সরকার৷
তিনদিনের সফরে জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত সাক্ষাৎ করছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো বা জোকোভি সঙ্গে৷
শরণার্থী: জলবায়ু পরিবর্তন যার অন্যতম কারণ
বিশ্বে দু’ধরনের শরণার্থী রয়েছে৷ ১. জাতিগত সহিংসতা কিংবা রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে, ২. জলবায়ুর কারণে সৃষ্ট৷ এই দু’ধরনের শরণার্থীই এখন বাংলাদেশের দুশ্চিন্তার কারণ৷ আর এই দু’টো কারণেই বিদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন বাংলাদেশিরা৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
রোহিঙ্গা শরণার্থী
১৯৯১-৯২ সালে আড়াই লক্ষাধিক মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী সামরিক জান্তার নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়৷ ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরের অক্টোবর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আরও ৭৪ হাজার নতুন রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জলবায়ু উদ্বাস্তু: প্রতি সাতজনে একজন
বাংলাদেশের জলবায়ু শরণার্থীদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ক্লাইমেট রিফিউজি’ বা এসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে ৪৫ জনের মধ্যে ১ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে৷ আর বাংলাদেশে সংখ্যাটা হবে প্রতি সাতজনে একজন৷ পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, আগামীতে বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Zakir Hossain Chowdhury
জলবায়ু উদ্বাস্তু: প্রতি বছর ২,০০০ মানুষ আসছে ঢাকায়
আগে কেবল দারিদ্র্যের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসত মানুষ৷ আর এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকায় আশ্রয় নিচ্ছে অনেকে৷ প্রতি বছর নতুন করে দুই হাজার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঢাকায় ঠাঁই নিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সংস্থা আইওএম-এর রিপোর্ট
বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রতি বছর ঢাকার বাইরে থেকে কমপক্ষে ৪ লাখ মানুষ এই শহরে আসছে৷ আর আইওএম বলছে, ঢাকার বস্তিতে যেসব মানুষ থাকে, তার মধ্যে ৭০ ভাগই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘর-বাড়ি হারিয়ে এই শহরে আশ্রয় নিয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. uz Zaman
ইউরোপে শরণার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়ছে
গত বছরের প্রথম তিন মাসে ইটালিতে গিয়েছিল মাত্র একজন বাংলাদেশি শরণার্থী৷ কিন্তু ২০১৭ সালে সেটা আশ্চর্যজনকভাবে বেড়েছে৷ প্রথম তিন মাসে ইটালিতে বাংলাদেশি শরণার্থী এসেছে ২ হাজার ৮শ’ জন৷ নৌকায় ভূ-মধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইটালিতে পৌঁছেছেন তাঁরা৷
ছবি: Reuters/Marina Militare
১০ হাজার ডলারের বিনিময়ে
দালালদের ১০ হাজার মার্কিন ডলার দিয়ে থাকেন এই শরণার্থীরা৷ প্রথমে যান দুবাই বা তুরস্ক, সেখান থেকে লিবিয়া হয়ে ইটালিতে পৌঁছান তাঁরা৷ এই দীর্ঘ ও দুর্গম পথ পাড়ি দিতে তাঁদের অনেকের কয়েক বছর লেগে যায়, প্রাণ হারান কেউ কেউ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Palacios
6 ছবি1 | 6
ওরা ছিল ‘জঙ্গি': মিয়ানমার
রাখাইনের গণকবরের বিষয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে, ঐ এলাকায় ১৯ জন ‘জঙ্গি'-কে হত্যা ও কবর দেয়া হয়েছে৷
এ বিষয়ে এপি গত সপ্তাহে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মোবাইল ফুটেজও নিজস্ব অনুসন্ধান থেকে রিপোর্ট করেছিল যে, রাখাইনের গু দার পিইয়িন গ্রামে অন্তত পাঁচটি গণকবর দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা৷ সেখানে প্রায় চারশ' লোককে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে৷
ঐ প্রতিবেদনের পরই মিয়ানমার তাদের জঙ্গি আখ্যায়িত করেছে এবং সংখ্যাটি ১৯ জনের বেশি নয় বলে জানিয়েছে৷
মিয়ানমারের সরকারি তথ্য কমিটি তাদের ফেসবুক পেজে এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘গু দার পিইয়িন গ্রাম সম্পর্কে এপি যে প্রতিবেদন ছেপেছে, তা সত্য নয়৷''
জাতিসংঘের উদ্বেগ
সব অভিযোগ অস্বীকার করা মিয়ানমারের সাংবাদিক ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের রাখাইনে যেতে না দেয়ার কড়া বিধি নিষেধ নিয়ে খুবই শঙ্কায় ফেলেছে জাতিসংঘকে৷
সংস্থাটির মহাসচিবের এক মুখপাত্র গেল সপ্তাহে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ৷ রাখাইনে প্রবেশে মিয়ানমারের আপত্তিকে তারা খুব সন্দেহের চোখেই দেখছেন৷
এর আগে গত মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ১০ জন রোহিঙ্গার একটি গণকবরের কথা স্বীকার করেছিল৷ তখন মানবাধিকার সংগঠনগুলো একে ‘সাগরের এক বিন্দু' বলে অভিহিত করেছিল৷
মাইনে পা হারালেন বাংলাদেশি
এদিকে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পোতা মাইনে দুই পা হারিয়েছেন এক বাংলাদেশি কৃষক৷ মাইনটি দু'দেশের সীমানার মধ্যকার বাফার জোনে পোতা হয়েছিল৷ শনিবার নাইক্ষংছড়িতে এ ঘটনা ঘটে৷
৪৫ বছর বয়সি ঐ কৃষকের নাম বদিউর রহমান৷ তিনি তাঁর গরু আনতে গিয়েছিলেন৷
নিজের দেশে সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা৷ তবে জাতিসংঘের অনুরোধ সত্ত্বেও সীমান্তে কড়াকড়ি অব্যাহত রেখেছ বাংলাদেশ৷ আজও রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী মনে করে মিয়ানমার৷
আশ্রয়ের সন্ধান
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে সেদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের পরিকল্পিত হামলার জের ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর দমনপীড়ন শুরু করেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী৷ ফলে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ছুটছেন রোহিঙ্গারা৷ সর্বশেষ অস্থিরতায় ইতোমধ্যে প্রাণ গেছে একশ’র বেশি মানুষের৷
ব্যাপক উদ্বাসন
বাংলাদেশের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখান থেকে এক রোহিঙ্গা শিশুকে পার করছেন এক ব্যক্তি৷ মিয়ানমার সরকার দাবি করেছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা সাতটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, একটি চেকপোস্ট এবং এক শহরের দুই প্রান্তে হামলা করেছে৷
ছবি: Getty Images/R.Asad
বৌদ্ধ শরণার্থীরা ছুটছে দক্ষিণের দিকে
নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার বৌদ্ধরাও নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজছেন৷ রোহিঙ্গা মুসলমান এবং রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনা বিরাজ করছে৷ ২০১২ সালে সেখানে রক্তাক্ত দাঙ্গা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রবেশ নিষেধ
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা আশ্রয়প্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন৷ তবে এ সব বাধার মাঝেও তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন৷ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চারলাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
মানবিক সংকট
একটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার কর্মী লিখেছেন: ‘‘অনেক রোহিঙ্গাকে আমরা অসুস্থ অবস্থায় পাচ্ছি৷ এর কারণ তাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশের আগে দীর্ঘসময় সীমান্তে আটকে ছিলেন৷ অসুস্থদের মধ্যে নারী এবং শিশুদের সংখ্যা বেশি৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/M.Alam
বাংলাদেশে স্বাগত নয়
কক্সবাজারের কুতুপালাং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া একদল রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের একটি দ্বীপে সরিয়ে নিতে চাচ্ছে যেটি বর্ষা মৌসুমে অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে থাকে৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
নো ম্যান’স ল্যান্ডের আটকে থাকা
পানির মধ্যে দিয়ে হেঁটে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গা শিশুরা৷ এই মুহূর্তে ছ’হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্তে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷