1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রোহিঙ্গাদের চাপে পাহাড়ে ‘পাহাড়ি' বিলীন হওয়ার আশংকা

আসমা মিতা
২৪ অক্টোবর ২০১৭

মানবিকতার প্রশ্নে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হলেও তাঁদের মিয়ানমারে ফেরা নিয়ে সংশয়ে আছেন তিন পার্বত্য জেলার আদিবাসীরা৷ ভবিষ্যতে নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার আশংকাও করছেন তাঁরা৷

Bangladesch Sajek Valley
ছবি: DW/M. Mamun

বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গারঅধিকাংশই থাকছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বা তার কাছাকাছি এলাকায়৷ এর ফলে এরইমধ্যে পাহাড়িদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে বলেও জানিয়েছেন পাহাড়িরা৷

বাংলাদেশের মাটিতে পাহাড়ি জনপদের সংকট নতুন নয়৷ গত কয়েক দশকে নিরবচ্ছিন্ন শান্তির মুখ তাঁরা কখনোই দেখেননি৷ ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি৷এরই মাঝে মিয়ানমার থেকে লাখে লাখে রোহিঙ্গাদের আগমনে জেগেছে নতুন শঙ্কা৷

উবাসিং মারমা

This browser does not support the audio element.

রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর মানবিক দায়িত্ব নিয়ে সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা কুড়িয়েছে৷ কিন্তু পার্বত্য এলাকায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিষয়টি সরকার খুব গুরুত্ব দিচ্ছে কিনা এ নিয়ে সংশয়ের কথা শোনা যাচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলে৷ 

এ কারণে যে পাহাড়িদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা বাড়ছে তা বোঝা গেল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির আদি বাসিন্দা উবাসিং মারমার কথায়৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘পার্বত্য তিন জেলা মিলে আমাদের সংখ্যা ৫ লাখের নীচে৷ সেখানে দেশের সীমানাতে ঢুকে পড়েছে দশ লাখ রোহিঙ্গা৷ আমাদের তো অস্তিত্বই থাকবে না৷ রোহিঙ্গাদের কারণে তো এলাকায় এখন দু'দিন পর পর নানা সহিংসতা হবে৷''

কক্সবাজার সদরের ঠিকাদার ব্যবসায়ী ক্যানুওয়েন চাক-ও সেই আশঙ্কা অস্বীকার করতে পারছেন না৷ খানিকটা সাবধানী অবস্থান থেকেই ডয়চে ভেলেকে তিনি বললেন, ‘‘এখনও কোনো ঝামেলা হয়নি ঠিক৷ কিন্তু অদূর ভবিষ্যতের কথা কে জানে৷''

ক্যানুওয়েন চাক

This browser does not support the audio element.

এমন আশঙ্কার পক্ষে তাঁর পরিষ্কার যুক্তি, ‘‘লোকালদের জন্য আমরা এমনিতেই নানা ঝামেলায় থাকি, সেখানে আবার নতুন মানুষ যোগ হয়েছে৷''

এই ‘নতুন মানুষ' যোগ হওয়ার আগে থেকেই পাহাড়ের মানুষদের সঙ্গী শত বিড়ম্বনা৷ পাহাড়িদের বড় একটা অংশ মনে করছে, রোহিঙ্গাদের আগমন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সঙ্কটে যোগ করেছে আরো নতুন মাত্রা৷ অতীতে জমি হারাতে হয়েছে পাহাড়িদের৷ চলেছে সামরিক-বেসামরিক নানা পক্ষের নির্যাতন৷ রোহিঙ্গা সঙ্কট সেই ইতিহাসকেই যেন ফিরিয়ে আনছে পাহাড়িদের মনে৷

বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি– এই তিন জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম৷ সর্বশেষ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় আদিবাসী আগের তুলনায় বেড়েছে ২ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৪ জন৷ ২০০১ সালে তিন পার্বত্য জেলায় আদিবাসী ছিল ৫ লাখ ৯২ হাজার ৯৭৭ জন৷ ২০১১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৪৫ হাজার ৫৪১ জনে৷ তবে এই বৃদ্ধির কারণ, অন্যান্য এলাকা থেকে আদিবাসীদের এ এলাকায় নিয়ে আসা৷ কিন্তু সাম্প্রতিক এই উদ্যোগ বাদ দিলে বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে পাহাড়ে আদিবাসীর সংখ্যা ক্রমাগতই কমেছে৷

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আছে ১১টি জনগোষ্ঠীর মানুষ৷ তাদের মধ্যে অহমিয়া, খিয়াং, খুমী, গুর্খা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, রাখাইন, ত্রিপুরাসহ আরও বেশ কিছু জনগোষ্ঠীর বসবাস আছে এসব এলাকায়৷ সরকারি হিসেবে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ২৭টি আদিবাসী গোষ্ঠীর৷

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে অন্ততপক্ষে দশটি নৃ-গোষ্ঠী হারিয়ে গেছে, বিলুপ্ত হয়েছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস৷ ১৯৪৭ সালে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৯৭ ভাগ, ১৯৬১ সালে তা কমে ৮৫ ভাগে দাঁড়ায়৷ ১৯৯৭-এ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী ছিল শতকরা ৫২ ভাগ৷

১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংক্ষুব্ধ আদিবাসীদের সঙ্গে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার পর বিদ্রোহের অবসান হয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়৷ তবে এরপরও এ অঞ্চলের পাহাড়ি সম্প্রদায়ের উপর হামলা, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা অনেকবার ঘটেছে৷ 

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তাঁর এক গবেষণায় বলেছেন, ২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষ ছিল ৭৫ শতাংশ৷ আর এখন তা ৪৭ শতাংশ৷

অর্থাৎ, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পরও শতকরা ১০ ভাগ কমেছে৷ অন্যদিকে ঐ অঞ্চলে বাঙালিদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে৷

গত আগস্ট থেকে প্রায় ছয় লাখের মতো রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে৷ এর আগেও বিভিন্ন সময়ে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্বত্য এলাকায় ঢুকেছে রোহিঙ্গারা৷ আগে আসা রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ এরইমধ্যে স্থানীয়দের সহায়তায়, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভোটার হয়েছে৷

সঞ্জীব দ্রং

This browser does not support the audio element.

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এ প্রসঙ্গে অনুযোগের সুরেই ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নাইক্ষ্যংছড়িতে এরইমধ্যে এক রোহিঙ্গা  জনপ্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছেন৷ তাঁর কাছে তো এমনিতেই আমাদের কেউ কোনো সমস্যার সমাধান পায় না৷ আর এই দশ লাখ যদি যোগ হয়, তাহলে যে কী হবে কে জানে৷ তাছাড়া পাহাড়ের অন্যান্য জায়গাতেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থাকায় দিন দিন আমাদের বলার জায়গা কমছে৷ এসব কেউ দেখে না৷'' 

তিনি হতাশা জানিয়ে বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশে কোনো জায়গা নেই, ঘুরেফিরে পাহাড়েই জায়গা দেয়া হয় সবাইকে৷ বিভিন্ন সময় পাহাড়ে আদিবাসী পুনর্বাসন করা হলেও তারা আসলে সেখানে সংখ্যালঘু৷ তাদের বেশিরভাগই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী৷ মিয়ানমারে বৌদ্ধরা মুসলমান হত্যা করছে বলে এ দেশের বৌদ্ধদের অনেকেই নানান হুমকিতে পড়ছেন৷ অথচ রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে নিজেদের ফাণ্ড থেকে অনেকেই অর্থ সহায়তাও দিচ্ছেন৷'' 

আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং আরো বলেন, ‘‘পাহাড়িদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক নিরাপত্তার কথা কেউ ভাবছে না৷ পাহাড়িরা তো অবর্ণণীয় অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে৷ ক্রমশ তাদের অস্তিত্ব কঠিন অনিশ্চয়তায় পৌঁছাবে৷ এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পাহাড়িরা একেবারে  বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকাও তারা করছেন৷একজন পাহাড়ি হিসেবে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন৷''

নিরাপত্তা প্রশ্নে নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল অবশ্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘আমাদের উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে৷ আর এ এলাকায় ১১টি জাতির আদিবাসির বসবাস৷ রামুর ঘটনার পর থেকে এমনিতেই তাদের নিরাপত্তা দিতে নানা ব্যবস্থা ছিল আমাদের৷ এখন তা আরও জোরদার করা হয়েছে৷ পুলিশ, বিজিবি সবাই কাজ করছে৷ আমরা মিলেমিশে থাকতে চাই৷'' তবে তিনিও স্বীকার করেছেন, ‘‘কোথায় যেন এক ধরনের শঙ্কা আছে৷''

তসলিম ইকবাল

This browser does not support the audio element.

তিনি আরও বলেন, ‘‘মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা হয়েছে৷ আমাদের এই এলাকাতেও কিন্তু রাখাইন আছে৷ ফলে কেউ কেউ নানা প্রোপাগান্ডায় কান দিয়ে মনে করছে, সেদেশে রাখাইনরা সহিংসতা করে এসেছে, তাই এদেশের রাখাইনদেরও নিধন করতে হবে৷''

নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে উবাসিং মারমা ডয়চে ভেলেকে জানালেন, নিরাপত্তার জন্য তাঁরা সারা রাত নিজেদের এলাকা পাহাড়া দিচ্ছেন৷ তিনি বলেন,‘‘আমাদের গ্রামে যে কয়েকটা বাড়ি আছে, আমরা সেগুলো পালাক্রমে রাতে পাহাড়া দিই৷ পুলিশও থাকে আমাদের সাথে৷ তবে আমরা নিজেরা অনেক সজাগ থাকি৷''  

তবে লেখক, গবেষক শাহরিয়ার কবির মনে করেন, ছোট্ট এক জনপদে এত বিপুল সংখ্যক মানুষের আগমন পাহাড়িদের জন্য নিঃসন্দেহে শঙ্কার আবহ তৈরি করেছে৷ তাঁর মতে, ‘‘তারা খুবই বিপদের মধ্যে আছে, পাহাড়িরা তো নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে৷''

‘‘রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে হবে এটা একটা বাস্তবতা, তাই বলে নিজ দেশের মানুষের জীবন তো বিপন্ন করা যাবে না৷ এরা বেশি দিন থাকলে জামায়াতে ইসলামী, জঙ্গি, মৌলবাদীরা এদের নানাভাবে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ করবে৷ ইতিমধ্যে করছেও৷ আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে তারা,'' যোগ করেন তিনি৷

শাহরিয়ার কবির

This browser does not support the audio element.

শাহরিয়ার কবির ডয়চে ভেলেকে আরো বলেন, ‘‘দেশের বিশিষ্ট ৪৮ নাগরিক নিয়ে আমরা একটি ‘নাগরিক কমিশন' গঠন করেছি৷ এই কমিশন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও এলাকা পরিদশর্ন করে আগামী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে তিন হাজার পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবে৷ এই কমিশনের প্রধান দাবিই হলো, পাহাড়ের কোথাও রোহিঙ্গা সেটেলমেন্ট করা যাবে না৷ এর বহুমুখী প্রতিক্রিয়া আছে৷ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে পাহাড়িরা৷ কোনোভাবেই  তা হতে দেয়া উচিত হবে না৷ বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই এই বিষয়টি দেখতে হবে৷''

তাঁর মতে, ‘‘আফগান যুদ্ধের পর যেভাবে করা হয়েছিল, এই রোহিঙ্গাদেরও একইভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে ভাগ করে নিতে হবে৷ কারণ, বাংলাদেশ এমনিতেই জনবহুল দেশ৷ এত মানুষের জায়গা দিতে গিয়ে এই দেশের সমস্যা দীর্ঘস্খায়ী করার কোনো মানে হয় না৷''

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ