রোহিঙ্গাদের জন্য টিকার ব্যবস্থা নেই, স্বাস্থ্যবিধিই ভরসা
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৬ জুন ২০২১
রোহিঙ্গাদের জন্য এখন পর্যন্ত কোন পক্ষ থেকে টিকার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি৷ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, তাদের টিকা দেয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে জাতিসংঘের উপর৷ আপাতত তারা স্বাস্থ্যবিধিতেই জোর দিচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
কক্সবাজারে ৩৫টি রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের মধ্যে আটটিতে এখন পরিপূর্ণ লকডাউন চলছে৷ বাকি ক্যাম্পগুলোতে আরোপ করা হয়েছে কড়াকড়ি৷ রোহিঙ্গাদের দেয়ার জন্য টিকার আবেদন জানানো হলেও এখনও তার কোন আভাস মেলেনি৷
দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বসবাস কক্সবাজার ও ভাসানচরসহ ৩৫ টি ক্যাম্পে৷শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মোট ৪৪ হাজার ৭২০ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে৷ এরমধ্যে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৩৪৯ জন৷ গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ২০ জন৷ তবে এখন পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়নি ভাসানচরে৷
কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়ক ডা. তোহা ভুঁইয়া ডয়চে ভেলেকে জানান, এ পর্যন্ত ক্যাম্পে করোনায় ১৮ জন মারা গেছেন৷ তাদের মধ্যে শনিবার মারা গেছেন একজন৷
‘এ পর্যন্ত ক্যাম্পে করোনায় ১৮ জন মারা গেছেন’
শরনার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দোজা নয়ন বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের আটটি ক্যাম্প এখন হটস্পট৷ সেগুলো পুরোপুরি লকডাউন করা হয়েছে৷ শুধু খাদ্য এবং জ্বালানি ছাড়া আর কিছু প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না৷ বাকিগুলোতেও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে৷ কাউকে ক্যাম্পের বাইরে যেতে দেয়া হচ্ছে না৷’’
এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শরণার্থীদের জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে সম্প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইসসিআর)৷ গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সংস্থার মুখপাত্র কোভ্যাক্স উদ্যোগের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চেয়েছেন৷ তবে এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন অগ্রগতির খবর দিতে পারেননি বাংলাদেশের দায়িত্বরতরা৷
শামসুদ্দোজা নয়ন জানান, তাদের পক্ষ থেকে কয়েক দফা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জন্য টিকার আবেদন করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআরের কাছে তারা আবেদন জানিয়েছেন৷ ইউএনএইচসিআরের জেনারেল অ্যাসেম্বলির প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলে তাকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে৷
রোহিঙ্গাদের জন্য টিকার ব্যবস্থা কী?
জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বসবাসরতদের মধ্যে ৪০ বছরের ওপরে রয়েছেন এক লাখ ৮০ হাজার জন৷ ১৮ বছরের উপরে আছেন প্রায় সাত লাখ৷ সেই হিসাবে সবাইকে টিকা দিতে সর্বোচ্চ ১৪ লাখ ডোজ প্রয়োজন৷
আটটি ক্যাম্প এখন হটস্পট
সমস্যা হলো, ভারত সরবরাহ বন্ধ রাখায় বাংলাদেশ নিজেদের নাগরিকদের টিকা দেয়া নিয়েই সংকটে রয়েছে৷ এখন পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার মাত্র তিন ভাগ টিকা পেয়েছেন৷ অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার বিতরণকৃত মোট ৯৯ লাখ ৯৩ হাজার ৯৪৫ ডোজের মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জন৷ দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪১ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩০ জন৷ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের চুক্তি অনুযায়ী সরবরাহ না পাওয়ায় প্রথম ডোজ টিকা নেয়া সবাইকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়া যাচেছ না৷
চীন থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া পাঁচ লাখ টিকার ট্রায়াল শুরু হয়েছে৷ তবে সেই টিকার অগ্রাধিকারে আছে বাংলাদেশে চীনা নাগরিক, চীনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা৷ চীন ও রাশিয়ার সাথে চুক্তির জন্য আলোচনা চলছে৷ এর মধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে বলে রোববার বাংলাদেশে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন৷ কিন্তু রোহিঙ্গাদের জন্য টিকার ব্যবস্থা কিভাবে হবে?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সব কিছু জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হয়৷ জাতিসংঘ ভ্যাকসিন দিলে রোহিঙ্গাদের ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা আছে আমাদের৷’’
বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে বাংলাদেশের তিন কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত সেখান থেকে মিলেছে বায়োএনটেক-ফাইজারের মাত্র এক লাখ ৬২০ ডোজ৷ আগামী সাত দিনের মধ্যে সেই টিকা দেয়া শুরু হবে৷ বাংলাদেশের নাগরিক যারা আগেই নিবন্ধন করেছেন তারা এই টিকা পাবেন৷
এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের জন্য শিগগিরই টিকার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না৷ আপাতত তাই ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের উপর ভরসা করছে সরকার৷
ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা শরনার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মানা ও মাস্ক ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে৷ তাদের বিনামূল্যে মাস্ক দেয়া হচ্ছে, হ্যান্ড স্যনিটাইজরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে৷
২৫ মের ছবিঘর দেখুন...
চীনের সিনোফার্মের টিকাদান কার্যক্রম শুরু
দেশে করোনা সংক্রমণ রোধে চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকাদান শুরু হয়েছে। এ পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাবেন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং কলেজ, মেডিকেল টেকনোলজি কলেজের শিক্ষার্থী এবং চীনের নাগরিকরা।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
প্রাথমিকভাবে চারটি মেডিকেলে টিকাদান
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভির টিকাদান কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ এবং মুগদা মেডিকেল কলেজে চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য মেডিকেল কলেজে এই কার্যক্রম শুরু হবে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাদান
দেশে স্বাস্থ্যসেবায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য টিকা দেয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্টদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে উপহারের মোট পাঁচ লাখ ডোজের মধ্যে দুই লাখের মতো ডোজ দেওয়া হবে শিক্ষার্থীদের। বাকি টিকা চীনের অনুরোধের ভিত্তিতে পাবেন চীনা নাগরিকেরা।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
টিকা কার্যক্রম উদ্বোধন
মঙ্গলবার সকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেকের উপস্থিতিতে ৩ জন শিক্ষার্থীকে টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা মেডিকেলের ২৫৭ জন শিক্ষার্থীসহ মোট এক হাজার জনকে প্রথম দিনে টিকা দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
‘টিকা নিয়ে শুরুতে যে ভয়টা ছিল, সেটি কেটে গেছে‘
প্রথম স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে টিকা নেওয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেলের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী অনন্যা সালাম সমতা জানান, “আমরা অনেকদিন যাবত ক্লাস, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছি না। তাছাড়া ফেব্রুয়ারিতে টিকাদানের শুরুতে যে ভয়টা ছিল, এখন সেটা আর নেই। আমি মনে করি, করোনা প্রতিরোধে টিকার কোনো বিকল্প নেই৷”
ছবি: Rashed Mortuza/DW
নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য মেডিকেলে টিকাদান কার্যক্রমের প্রথমদিনে জরুরি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। টিকাদান বুথের পাশাপাশি টিকা পরবর্তী পর্যবেক্ষণ কক্ষ এবং টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে যেন সঙ্গে সঙ্গে জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সবখানেই।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
চলছে অক্সফোর্ডের টিকাদান কার্যক্রমও
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভির টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধনের পাশাপাশি পৃথক টিকাবুথে দেখা গেল ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্তব্যরত একজন নার্স বলেন, ‘‘যতদিন আমাদের এ টিকার মজুত আছে, ততদিন এ কার্যক্রম চলবে।’’
ছবি: Rashed Mortuza/DW
টিকাটি প্রায় ৮০% কার্যকর
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি ভিত্তিতে চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকার অনুমোদন দেওয়ার পর পাকিস্তান, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এ টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এ টিকার কার্যকারিতা ৮৬ শতাংশের মতো পাওয়া গেছে। তবে গবেষণা বলছে, স্বাভাবিকভাবে এ টিকা গড়ে ৮০ ভাগ কার্যকর।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
‘আমাদের এ সুযোগ লুফে নেওয়া উচিত’
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকাদানের প্রথমদিনে টিকা নিতে আসা ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী নিয়ামুল হক বলেন, “সরকার আমাদের জন্য বিনামূল্যে এ টিকার ব্যবস্থা করেছেন, আমার মনে হয় এ সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই আমাদের তা লুফে নেওয়া উচিত। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটির অনুমোদন দিয়েছে, এর পরে এ টিকা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না।”
ছবি: Rashed Mortuza/DW
এক সপ্তাহের বিরতি
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকাদান কার্যক্রম চালুর প্রথমদিনে হাজার শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে ১ সপ্তাহ বিরতি দেওয়া হবে। টিকাগ্রহীতাদের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না দিলে পরবর্তীতে বাকিদেরও এই টিকাদানে অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
টিকা আনার সর্বোচ্চ চেষ্টার দাবি
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেন, “ভারত তিন কোটি টিকার ডোজ দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের নিজেদের দেশের সংকটের কারণে আমরা মাত্র এক কোটি ডোজ টিকা পেয়েছি। তবে বিকল্প ব্যবস্থায় চীন এবং রাশিয়া থেকে টিকা আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। খুব শীঘ্রই আমরা কাঙ্খিত ফল পাবো বলে আশা করছি।“
ছবি: Rashed Mortuza/DW
চীনের টিকা সর্বসাধারণের জন্য নয়
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকার উপহারের যে পাঁচ লাখ ডোজের চালান চীন সরকার বাংলাদেশকে দিয়েছে, আপাতত সাধারণ মানুষ এ টিকাদান কার্যক্রমের বাইরে থাকবেন বলে জানানো হয়েছে। চীনের সাথে চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর যখন নিয়মিতভাবে টিকার চালান আসবে, তখন সর্বসাধারণকে এই টিকা প্রয়োগের আওতায় আনা হবে বলে জানান দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা।