রাখাইন রাজ্যের এক সাংবাদিক রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে প্রতিবেদন লেখায় বৌদ্ধ কট্টরপন্থিরা তাঁর মাথার দাম ২৯ হাজার ডলার ধার্য করেন৷ এ বছর মার্চ মাসে তাঁর বাড়িতে বোমা হামলা চালানো হয়, পরিবারকে বাধ্য করা হয় ইয়াঙ্গুনে চলে যেতে৷
বিজ্ঞাপন
মিন মিন এর মুখেই শুনুন রাখাইনের কাহিনি৷ ‘‘হাসপাতালে একজন সন্তান সম্ভবা নারী তার স্বামীকে ফোন করতে চাইলে আমি আমার ফোন তাকে দিই৷ এসময় সেখানকার চিকিৎসক বলেন, ‘ঐ মেয়েটিকে সাহায্য করো না, সে একজন মুসলিম৷' এই একটি কথাতেই মিন মিন-এর মনে আমূল পরিবর্তন এনে দেয়৷ মিন মিন জানান, চিকিৎসক ঐ নারীকে বলেন ফোনের জন্য যাতে সে তাকে পয়সা দেয়৷
মিয়ানমানরের পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতওয়েতে মিন মিন-এর বাস৷ যে এলাকাটি বৌদ্ধ ও মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে এখন বেশ পরিচিত৷ বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ট দেশটি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব দিতে নারাজ৷ অথচ এই রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রাখাইন রাজ্যে বসবাস করছে৷ মিয়ানমারের বেশিরভাগ নাগরিকও সরকারের সঙ্গে একমত৷ তাদের মতে, রোহিঙ্গারা অবৈধ অভিবাসী৷ জাতিসংঘ বলছে, ১১ লাখ রোহিঙ্গা বিশ্বের সবচেয়ে নিগৃহীত সংখ্যালঘু৷
রোহিঙ্গা মুসলিমরা তাদের উপর নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে৷ মিন মিন একজন সাংবাদিক৷ যিনি জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডিপিএ-কে জানালেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি জেনে এসেছেন মুসলমানরা তাদের জন্য একটা হুমকি৷ তাই রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে রাখাইন রাজ্য ফিরে পেতে হবে তাদের৷ তবে দীর্ঘ পাঁচ বছর থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় থাকার পর মিন মিন বাস্তব অবস্থা বুঝতে পেরেছেন৷ হাসপাতালে চিকিৎসকের ঐ একটি কথায় তিনি উপলব্ধি করেছেন মিয়ানমারের মুসলমানদের উপর কী ধরনের অত্যাচার হচ্ছে৷
এরপর থেকেই মিন মিন রাখাইন রাজ্যে শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন৷ তিনি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তুলে ধরেন সেখানকার রোহিঙ্গারা কী কী মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে৷ এমনকি চিকিৎসা করাতেও তাদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাও তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে৷
বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের কথা
জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীদের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, নভেম্বরের ১৯ থেকে ২১ তারিখ, এই তিনদিনে বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে শত শত রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
সহিংসতা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৮৬ জন প্রাণ হারিয়েছে৷ গৃহহীন হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার জন৷ অক্টোবরের ২৭ তারিখে তোলা এই ছবিতে ঐ রাজ্যের একটি গ্রামের বাজার দেখা যাচ্ছে, যেটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল৷ শিশুরা সেখান থেকে বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করছে৷
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
পালিয়ে বাঁচা
সহিসংতা থেকে বাঁচতে নভেম্বরের ১৯ থেকে ২১ তারিখ শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীরা৷ উপরের ছবিটি ২১ নভেম্বরের৷ কক্সবাজারের কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রে বসবাসরত রোহিঙ্গা নারীরা নতুন আসা শরণার্থীদের দেখছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
নতুন শরণার্থী
মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন নতুন শরণার্থীরা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
ধরা পড়ায় কান্না
অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত পার হওয়ায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা তাদের ধরেছে৷ মুসলিম নারী ও তাঁর সন্তানরা তাই কাঁদছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
অপেক্ষা
কুটুপালাং ক্যাম্পে ঢোকার অপেক্ষায় নতুন আসা রোহিঙ্গারা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
সন্তানসহ মা
মুসলিম এই রোহিঙ্গা নারী তাঁর সন্তানকে নিয়ে কুটুপালাং শিবিরে ঢোকার অপেক্ষায় আছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
শরণার্থী শিশু
কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রের রোহিঙ্গা শিশুরা স্কুলে পড়াশোনার ফাঁকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
আদি বাসিন্দা
কুটুপালাং ক্যাম্পে নিজেদের বাড়িতে শিশুরা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
বাড়ির আঙিনায়
একজন রোহিঙ্গা নারী তাঁর সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কুটুপালাং শরণার্থী শিবিরে তাঁর বাড়ির সামনে বসে আছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
9 ছবি1 | 9
সংবাদ সংস্থা ডিপিএ-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে মিন মিন বলেন, দু'পক্ষের কেউই কারো কথা শোনে না৷ তাই এ সমস্যার সমাধান হওয়া প্রায় অসম্ভব৷ তবে মিন মিন-এর প্রতিবেদনের কারণে রাখাইনের অধিবাসীরা তার উপর ক্ষুব্ধ হন৷ চলতি বছরের মার্চ মাসে তার সিতওয়ের বাড়িতে বোমা হামলা চালানো হয়৷ তার পরিবারকে ইয়াঙ্গুনে চলে যেতে বাধ্য করা হয়৷ বৌদ্ধ কট্টরপন্থিরা তার মাথার দাম ধার্য করেন ২৯ হাজার ডলার৷
এত হুমকির পরও মিন মিন পিছিয়ে থাকেননি৷ এই মাসেই নতুন পত্রিকা প্রকাশ করেছেন তিনি৷ নাম দিয়েছেন ‘রুট' বা শেকড়৷ সেখানে লেখা প্রতিবেদনগুলোতে তিনি নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন৷ না বৌদ্ধ না মুসলিম কারো পক্ষেই কথা বলেননি তিনি৷
রাখাইন রাজ্যটি অত্যন্ত দরিদ্রদের এলাকা৷ অক্টোবর থেকে এই এলাকাটিতে আবারও শুরু হয়েছে সংঘাত৷ মিয়ানমার সরকারের দাবি রোহিঙ্গারা ন'জন সীমান্ত রক্ষীকে হত্যা করেছে৷ ঐ ঘটনার পর রাখাইন রাজ্যের সাড়ে তিন হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা ঘিরে রাখে সেনাবাহিনী৷ তাদের দাবি, এ সময় রোহিঙ্গারা ছুড়ি আর দা নিয়ে তাদের উপর হামলা চালায়৷ ঐ ঘটনার পর থেকে অন্তত ২০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে৷ এ ঘটনায় নিহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের দাবি, শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ এখনও সংঘাতপূর্ণ এলাকায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷
এপিবি/ডিজি (এপি, ডিপিএ)
রোহিঙ্গাদের ‘যুদ্ধের’ যেন শেষ নেই
ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ অনেক বাংলাদেশিও আছেন তাঁদের মাঝে৷ থাইল্যান্ডে গিয়ে কবরেও ঠাঁই হয়েছে অনেকের! আজকের ছবিঘরটি তাঁদের নিয়েই৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
আটকে পড়া
গত ১০ মে চারটি নৌযানে করে ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশে প্রবেশ করে ৬০০ রোহিঙ্গা৷ একই সময়ে লাংকাওইতে প্রবেশ করে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা৷ সমুদ্র থেকে স্থলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁদের ঘিরে ফেলে৷ ভাগ্যান্বেষণে দেশ ছাড়া মানুষগুলো এখনো মুক্ত নয়৷
ছবি: Reuters/R. Bintang
ক্লান্ত
মানবপাচারকারীরা তাঁদের ছেড়ে যাওয়াতে সমুদ্রবক্ষে বিপদেই পড়েছিলেন রোহিঙ্গারা৷ আনুমানিক সপ্তাহ খানেক সমুদ্রপথে ঘুরে অবশেষে ভীষণ ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত অবস্থায় তাঁরা ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছান৷ দীর্ঘ অর্ধাহার, অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে৷ তাঁদের চিকিৎসা চলছে৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা
প্রতিবছর এভাবেই মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে শত শত রোহিঙ্গা৷ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কিছু বাংলাদেশিও থাকেন সব সময়৷ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী তোলায় অনেক নৌযান ডুবে যায় সাগরে, সলিলসমাধি হয় অনেকের৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম তিন মাসে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ছেড়েছেন অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি৷
ছবি: Asiapics
ওদের কোনো দেশ নেই!
বৌদ্ধপ্রধান দেশ মিয়ানমারে ৮ লক্ষের মতো রোহিঙ্গা মুসলমানের বাস৷ তবে সংখ্যাটা দ্রুতই কমছে৷ বৌদ্ধদের সঙ্গে দাঙ্গার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই৷ মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকারই করে না৷ তাদের মতে, রোহিঙ্গারা ‘বাংলাদেশি অভিবাসী’৷ আবার বাংলাদেশে আশ্রয় নিলে ঐতিহাসিক কারণেই তাঁদের মিয়ানমার থেকে আগত বহিরাগতের মর্যাদা দেয় বাংলাদেশ৷
ছবি: Reuters/R: Bintang
আধুনিক দাস-বাণিজ্য
মানবপাচারকারীদের কাছে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ ছাড়া রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিরা যেন ক্রীতদাস৷ মাত্র ২০০ ডলারের বিনিময়ে নির্বিঘ্নে মালয়েশিয়ায় পৌঁছে দেয়ার কথা বলে নৌযানে তুললেও যাত্রীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়৷ খেতে না দেয়া, ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য করা, শারীরিক নির্যাতন – বলতে গেলে সব ধরণের অত্যাচারই চলে তাঁদের ওপর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Yulinnas
থাইল্যান্ড নিয়ে আতঙ্ক
রোহিঙ্গারা থাইল্যান্ডেও যান৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, ২০১২ সালে আড়াই লাখ মানুষ অবৈধভাবে থাইল্যান্ডে প্রবেশ করেছেন৷ অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য থাইল্যান্ড অবশ্য একেবারেই নিরাপদ ঠিকানা নয়৷ মানবপাচারকারীরা সে দেশে নিয়ে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করে৷ মুক্তিপণ না দিলে মেরেও ফেলা হয়৷ সম্প্রতি মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে বেশ কিছু গণকবরের সন্ধান পেয়েছে থাই সরকার৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
পরিত্যক্ত
থাইল্যান্ড সরকারের অভিযান শুরুর পর অনেক রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশিকে গভীর জঙ্গলে ফেলে পাচারকারীরা পালিয়ে যায়৷ মালয়েশিয়া সীমান্তের কাছের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করে এ পর্যন্ত অন্তত শ’ খানেক অভিবাসন প্রত্যাশীকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে থাই কর্তৃপক্ষ৷