বাংলাদেশে আসা সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত নেয়ার জন্য চাপ দিয়েছে বাংলাদেশ৷ একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে মেনে নেয়া এবং তাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করার আহ্বানও জানানো হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
বুধবার ঢাকায় মিয়ানমারের বিশেষ দূত ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী চ টিন-এর সঙ্গে বৈঠকে এসব কথা জানিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক৷ তিনি বলেছেন, ‘‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং এই সমস্যা মিয়ানমারকে সমাধান করতে হবে৷ তবে সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে সহযোগিতা করবে৷'' বুধবার বিকেলে শুরু হয়ে সন্ধ্যায় শেষ হওয়া বৈঠক সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে৷
বুধবার রাতে মিয়ানমারে বিশেষ দূতের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলির সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে৷ এরপর রাতে অথবা বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং হতে পারে৷ মিয়ানমারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী চ টিন মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন৷ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের চাপের কারণেই মিয়ানমারের বিশেষ দূত হিসেবে তিনি ঢাকায় এলেন৷
বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের কথা
জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীদের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, নভেম্বরের ১৯ থেকে ২১ তারিখ, এই তিনদিনে বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে শত শত রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
সহিংসতা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৮৬ জন প্রাণ হারিয়েছে৷ গৃহহীন হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার জন৷ অক্টোবরের ২৭ তারিখে তোলা এই ছবিতে ঐ রাজ্যের একটি গ্রামের বাজার দেখা যাচ্ছে, যেটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল৷ শিশুরা সেখান থেকে বিভিন্ন জিনিস সংগ্রহ করছে৷
ছবি: Reuters/Soe Zeya Tun
পালিয়ে বাঁচা
সহিসংতা থেকে বাঁচতে নভেম্বরের ১৯ থেকে ২১ তারিখ শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীরা৷ উপরের ছবিটি ২১ নভেম্বরের৷ কক্সবাজারের কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রে বসবাসরত রোহিঙ্গা নারীরা নতুন আসা শরণার্থীদের দেখছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
নতুন শরণার্থী
মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন নতুন শরণার্থীরা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
ধরা পড়ায় কান্না
অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত পার হওয়ায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা তাদের ধরেছে৷ মুসলিম নারী ও তাঁর সন্তানরা তাই কাঁদছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
অপেক্ষা
কুটুপালাং ক্যাম্পে ঢোকার অপেক্ষায় নতুন আসা রোহিঙ্গারা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
সন্তানসহ মা
মুসলিম এই রোহিঙ্গা নারী তাঁর সন্তানকে নিয়ে কুটুপালাং শিবিরে ঢোকার অপেক্ষায় আছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
শরণার্থী শিশু
কুটুপালাং শরণার্থী কেন্দ্রের রোহিঙ্গা শিশুরা স্কুলে পড়াশোনার ফাঁকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
আদি বাসিন্দা
কুটুপালাং ক্যাম্পে নিজেদের বাড়িতে শিশুরা৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
বাড়ির আঙিনায়
একজন রোহিঙ্গা নারী তাঁর সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কুটুপালাং শরণার্থী শিবিরে তাঁর বাড়ির সামনে বসে আছেন৷
ছবি: Reuters/M.P.Hossain
9 ছবি1 | 9
বৈঠক সূত্র জানায়, ‘‘বাংলাদেশ মিয়ানমারকে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক৷ তাদের ফেরত নিতে হবে৷ এই সমস্যা যেহেতু মিয়ানমারের, তাই সমাধানও তাদের করতে হবে৷ বাংলাদেশ এই সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের পাশে থেকে সহযোগিতা করবে৷ এবং বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিকভাবেই এই সমস্যার সমাধান চায়৷''
বাংলাদেশ জানিয়েছে, ‘‘১৯৭৮ এবং ১৯৯২ সালে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেরশে আসা রোহিঙ্গাদের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছিল৷ তখন দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে মিয়ানমার স্বীকার করে নিয়েছিল রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আইনগত নাগরিক৷''
বাংলাদেশ আরো জানায়, ‘‘গত তিন দশকে কয়েক লাখ মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে এবং তিন থেকে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে৷ এবং গত অক্টোববরে নতুন করে প্রায় ৭০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে৷''
বাংলাদেশে শরণার্থী, বাংলাদেশের শরণার্থী
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা, ইউএনএইচসিআর-এর এক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশের তালিকায় নবম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ৷ তেমনি বাংলাদেশ থেকেও অনেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে শরণার্থী হয়ে যাচ্ছেন৷
ছবি: Reuters
বাংলাদেশ নবম
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর ‘গ্লোবাল ট্রেন্ডস-২০১৩’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলছে, বিশ্বের শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্থনীতির তুলনায় ধারণক্ষমতার দিকে থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর নবম শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশ৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman
কতজন শরণার্থী?
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে দুটি সরকারি শরণার্থী শিবিরে ৩০ হাজারের মতো মিয়ানমারের (রোহিঙ্গা) শরণার্থী বসবাস করছে বলে জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিবেদন৷ শিবিরের বাইরে আছে আরও দুই থেকে পাঁচ লাখ অনিবন্ধিত ব্যক্তি৷
ছবি: AP
আশ্রয়প্রার্থী
হ্যাঁ৷ বাংলাদেশেও কেউ কেউ আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন৷ ইউএনএইচসিআর ওয়েবসাইটের বাংলাদেশ পাতায় এমন আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা নয়জন বলে জানানো হয়েছে৷ ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সংখ্যাটা এমন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়৷
ছবি: DW/Shaikh Azizur Rahman
বাংলাদেশের শরণার্থী
উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ থেকে অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন৷ অনেকক্ষেত্রে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে রওনা দেন৷ কেউ গন্তব্যে পৌঁছে গ্রেপ্তার হয়ে ফিরে আসেন৷ কেউ বা শরণার্থী পরিচয় পান৷ বাংলাদেশের এমন শরণার্থীর সংখ্যা ৯,৮৩৯ জন৷
ছবি: Reuters
বাংলাদেশের আশ্রয়প্রার্থী
উন্নত বিশ্বে কোনোভাবে ঢুকে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার চল অনেকদিন ধরেই চলছে৷ জাতিসংঘের হিসেবে বাংলাদেশের এমন আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ২২,১২৮ জন৷ সংখ্যাটা ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রযোজ্য৷
ছবি: Reuters
স্বপ্নের শুরু টেকনাফে
বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন অনেক বাংলাদেশি৷ এ জন্য তাঁরা দালালদের অনেক অর্থও দিয়ে থাকেন৷ তাঁদের এই যাত্রা শুরু হয় টেকনাফ থেকে৷
ছবি: DW/Shaikh Azizur Rahman
ছোট নৌকা থেকে বড় নৌকায়
টেকনাফ থেকে প্রথমে ছোট নৌকায় যাত্রা শুরু হয়৷ তারপর একসময় মাছ ধরার বড় নৌকা বা কার্গোতে যাত্রীদের তুলে দেয়া হয়৷ সাধারণত অক্টোবর থেকে পরবর্তী পাঁচ মাসকে সমুদ্র যাত্রার জন্য সঠিক সময় বলে বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: Asiapics
খাবার, পানির অভাব
ইউএনএইচসিআর-এর একটি প্রতিবেদন বলছে, যাঁরা সাগর পথে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেন তাঁদের অনেকে খাবার ও পানির অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ এছাড়া দালালরা অনেক সময় তাঁদের সঙ্গে খারাপ আচরণও করে৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ‘‘আগামী ১৯ জানুয়ারি শুধুমাত্র রোহিঙ্গা বিষয়ে মালয়েশিয়াতে ইসলামি দেশগুলির সংস্থা ওআইসি-র পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আছে এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে একটি শক্ত সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেবার বিষয়ে আলোচনা চলছে৷ বাংলাদেশ সেখানে তার একই অবস্থান তুলে ধরবে৷''
এদিকে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিষয়ক সমন্বয়কারী সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘গত এক সপ্তাহে নতুন করে ২২ হাজার মানুষ রাখাইন রাজ্য থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে৷ ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত করা হিসেব অনুযায়ী, গত ৯ অক্টোবরের পর থেকে হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে৷ তারা কক্সবাজারের রেজিস্টার্ড ক্যাম্প, অস্থায়ী বসতি এবং স্থানীয় লোকজনের আশ্রয়ে বাস করছেন৷''
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ডিসেম্বরে অবিলম্বে রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধের জন্য একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করেছে৷ মিয়ামারের প্রতিবেশী এবং আসিয়ান-এর সদস্য মালয়েশিয়া প্রকাশ্যে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা নির্যাতনের জন্য দায়ী করেছে৷
সি আর আবরার
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিচার্স ইউনিট (রামরু)-র সমন্বয়কারী অধ্যাপক সি আর আবরার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে যে শক্ত অবস্থান এবার নিয়েছে, তা আরো অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল৷ রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই৷ তাই সম্মানজনকভাবে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেয়াই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান৷ মিয়ানমারকে তার নাগরিকদের স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানজনকভাবে ফেরত নিতে হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ৷ বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করছে৷ তাই আমার ধারণা, বাংলাদেশ যে অবস্থান নিয়েছে তার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সমর্থন দেবে৷ তারাও চাইবে, রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের দেশে যাতে সম্মানজনকভাবে ফিরে যেতে পারে৷''