২৩,০০০ রোহিঙ্গাকে ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক মানবাধিকার তদন্তকারী এক কর্মকর্তা৷ তাঁর মতে দ্বীপটি সম্ভবত বসবাস উপযোগী নয়, ফলে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে৷
বিজ্ঞাপন
৭,৩০,০০০ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ক্যাম্পের উপর চাপ কমাতে কক্সবাজার থেকে তাদেরকে হাতিয়ার ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ সরকার৷ কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে জায়গাটিকে বসবাস অনুপযোগী হিসেবে অভিহিত করে এই পরিকল্পনার সমালোচনা করে আসছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন৷
জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংঘি লি গেল জানুয়ারিতে দ্বীপটি সফর করেছেন৷ সোমবার এ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার কাছে নিজের মতামত জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘এই সফরের পরও বেশ কিছু বিষয়ে আমি এখনও নিশ্চিত নই, বিশেষ করে দ্বীপটি সত্যিকার অর্থেই বসবাস উপযোগী কিনা৷''
অপরিকল্পিতভাবে এবং শরণার্থীদের মতামত না নিয়ে স্থানান্তর পরিকল্পনা হাতে নেয়ায় নতুন সংকট তৈরি হতে পারে বলেও জানান তিনি৷
তবে বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সাথে সরকার আলোচনা করেছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব শাহ কামাল৷ তিনি বলেন, ‘‘সংস্থাগুলো এই বিষয়ে সম্মতি জানিয়েছে৷ স্থানান্তর প্রক্রিয়াসহ অন্য সব বিষয় তাদের সাথে আমরা এখন চূড়ান্ত করছি৷'' আবাসন, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাঁধ নির্মাণ, সাইক্লোন শেল্টার সেন্টারসহ সব ধরণের সুযোগ সুবিধাই সেখানে নিশ্চিত করা হয়েছে বলেও তিনি রয়টার্সকে জানিয়েছেন৷ ‘‘আমরা একটি বাঁধ তৈরি করেছি, কাজেই বন্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই,'' বলেন তিনি৷
রোহিঙ্গা শিবির গড়তে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জায়গা দিতে গিয়ে টেকনাফ ও উখিয়ার বনভূমি ও পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে শরণার্থী শিবির৷ এভাবে পরিবেশের ক্ষতি করার ফল ভয়াবহ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: DW/Jibon Ahmed
বুলডোজার দিয়ে সমান করা হচ্ছে পাহাড়
কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়ায় শরণার্থী শিবির গড়ে তুলতে নির্বিচারে পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা৷ প্রতিদিন বুলডোজার দিয়ে পাহাড় কেটে মাটি সমান করা হচ্ছে৷ রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন আবাসন তৈরির নামে এসব পাহাড় কাটছে আন্তর্জাতিক কয়েকটি এনজিও এবং দাতাসংস্থা৷
ছবি: DW/Jibon Ahmed
পাহাড়ের বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ
পাহাড়গুলোর কোনোটাতেই এখন আর সবুজের চিহ্ন অবশিষ্ট নেই৷ কেটে ফেলা হয়েছে বড় বড় গাছ৷ লতাপাতা-গুল্ম কিছুই আর নেই৷ মাটি কেটে ঘর বানানোর কারণে পাহাড়ের আকৃতিও বদলে গেছে৷ সবুজ বনাঞ্চল উজাড় হয়ে সেই পাহাড়গুলো এখন পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে৷
ছবি: DW/Jibon Ahmed
পাহাড়ের বুক চিড়ে রাস্তা
প্রতিদিন নতুন করে কাটা হচ্ছে পাহাড়৷ তার বুক চিড়ে তৈরি হচ্ছে রোহিঙ্গাদের জন্য রাস্তা৷ এই কাটা পাহাড়ে একসময় ছিল হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আনাগোনা৷ নির্বিচারে বন ও পাহাড় কাটার ফলে এ অঞ্চলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা৷ এ কারণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কাও করছেন তাঁরা৷
ছবি: DW/Jibon Ahmed
১৫টি ফুটবল মাঠের সমান পাহাড় কাটা হচ্ছে
রোহিঙ্গাদের আবাসন তৈরি করতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ১৫টির মতো ফুটবল মাঠের সমান পাহাড় কেটে তৈরি করছে শরণার্থী শিবির৷ পাহাড় কেটে, ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে এসব ঝুপড়ি৷ সবুজ পাহাড়-বনাঞ্চল উধাও৷ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কোনোরকমে মাথা গোঁজার জন্য গড়ে তুলেছে এই ঝুপড়ি৷
ছবি: DW/Jibon Ahmed
ছিল পাহাড়, হয়ে গেছে সমতল
একসময় এই জায়গায় ছিলউঁচু উঁচু পাহাড়৷ চলাচল করত হাতি৷ আর এখন বন্যপ্রাণীর পরিবর্তে রোহিঙ্গাদের বসবাস৷ বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে পাঁচ হাজার একর বনভূমিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো গড়ে ওঠার কথা বলা হলেও বাস্তবে ১০ হাজার একরেরও বেশি বনভূমিতে রোহিঙ্গারা অবস্থান করছেন৷ তাঁরা বসতি গড়ে তুলতে নতুন নতুন বনভূমি দখল করে গাছ কেটে পাহাড় ন্যাড়া করে ফেলছেন৷
ছবি: DW/Jibon Ahmed
পাহাড়ের ছড়া ভরাট করে তৈরি হচ্ছে রাস্তা
পাহাড়ের ভেতরে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া সব জলধারা, অর্থাৎ ছড়াগুলো এখন মৃতপ্রায়৷ বালুখালীর গহিন অরণ্যের ভেতরে ছিল এ ছড়াটি৷ পাহাড়ের পানি নামতো এই ছড়া দিয়ে৷ বর্তমানে এ ছড়া ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পের মধ্যকার সংযোগ সড়ক৷
ছবি: DW/Jibon Ahmed
জ্বালানির চাহিদা মেটাতে বন ধ্বংস
উখিয়ায় পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের বসতি৷ পাহাড় কেটে বসবাসরত রোহিঙ্গারা জ্বালানির চাহিদা মেটাতে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে সবুজ বন৷ এর ফলে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
ছবি: DW/Jibon Ahmed
7 ছবি1 | 7
তদন্তের জন্য বাংলাদেশে আইসিসি কর্মকর্তারা
সহিংসতা ও মানবিক সাহায্যের অভাবে গেল নভেম্বর থেকে ১০,০০০ নাগরিক মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন বলে জেনেভা ফোরামকে জানিয়েছেন লি৷ তিনি মিয়ানমারের নৃশংসতার অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসির কাছে তুলে ধরতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহবান জানান৷
এদিকে, রোহিঙ্গা বিতাড়নের ঘটনায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা যায় কিনা প্রাথমিকভাবে তা খতিয়ে দেখতে আইসিসির কর্মকর্তারা বাংলাদেশে এসেছেন বলেও জানিয়েছেন লি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি খুবই আশাবাদী৷ এটি অভূতপূর্ব একটি ঘটনা৷ এটা খুবই ছোট পদক্ষেপ৷ কিন্তু আমার আশা এর মাধ্যমে বিচারের বড় দুয়ার খুলে যাবে৷'' মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বিতাড়নের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে গত সেপ্টেম্বরে প্রাথমিক পরীক্ষা শুরু করেন আইসিসির তদন্ত কর্মকর্তারা৷ যদিও মিয়ানমার এখনও এই আদালতের সদস্য নয়৷ সে কারণে মিয়ানমারের বিচার করার অধিকার তাদের নেই বলে মন্তব্য করেছেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কিয়াও মো তুন৷