দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ান ও ডায়লগ পার্টনার অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার বিশেষ শীর্ষ সম্মেলনে এ বিষয়ে আলোচনা হয়৷ সেখানে দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা স্বীকার করেন, রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারেনি এই জোট৷
বিজ্ঞাপন
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আসিয়ান-অস্ট্রেলিয়ার সম্মেলন তিন দিনের এই বিশেষ সম্মেলন শেষ হয় রোববার৷ বৈঠকে মিলিত হন শীর্ষ নেতারা৷ সেই বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের নেতা অং সান সু চি'র ওপর চাপ প্রয়োগ করেন আসিয়ানের নেতারা৷
রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাঁর অস্বাভাবিক নির্লিপ্ততা ও সামরিক বাহিনীর পক্ষে সাফাই গাওয়া নিয়ে সারা বিশ্বে চরম সমালোচনার মুখে আছেন সু চি৷ তাঁর দেশের সামরিক বাহিনীর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো এবং সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার দেশ ত্যাগে বাধ্য হওয়াকে ‘জাতি নিধন' বলে বরাবরই উল্লেখ করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা৷
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া মুসলিম রোহিঙ্গাদের ফের দেশে ফেরানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে৷ সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই রাখাইন প্রদেশে ঘরে ফেরা রোহিঙ্গাদের জন্য ক্যাম্প তৈরির কাজ শুরু করেছে মিয়ানমার সরকার৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: Reuters
রোহিঙ্গা ক্যাম্প
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা, ত্রাণ এবং পুনর্বাসন মন্ত্রক ক্যাম্প তৈরির কাজ করছে৷ পুরো অঞ্চলটিকে ঘিরে দেওয়া হয়েছে কাঁটাতার দিয়ে৷ ক্যাম্পে জাতিসংঘের তরফ থেকে এইড দেওয়া হবে৷ তবে জাতিসংঘ জানিয়েছে, তাদের এইড প্রদানকারী সংস্থাকে ক্যাম্পে ঢোকার সমস্ত ব্যবস্থাপনা করে দিতে হবে৷ খবর, ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ ক্যাম্পে থাকতে পারবেন৷
ছবি: Reuters
অতন্দ্র প্রহরা
ইতিমধ্যেই ক্যাম্পের বাইরে মিয়ানমার সরকার পুলিশ মোতায়েন করেছে৷ ক্যাম্পে যাতে নতুন করে কোনো সমস্যা না হয়, তার দিকে নজর রাখার জন্যই নাকি অতন্দ্র প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷
ছবি: Reuters
শেষ পর্যায়ের কাজ
ক্যাম্প তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে বলে জানানো হয়েছে সরকারের তরফ থেকে৷ বাংলাদেশের শিবির থেকে রোহিঙ্গারা ফিরলেই তাদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করা হবে৷
ছবি: Reuters
অভিবাসন দফতরের উপস্থিতি
মিয়ানমারের অভিবাসন দফতরের কর্মীরাও নিয়মিত যাচ্ছেন ক্যাম্পে৷ রোহিঙ্গারা ফিরতে শুরু করলে তাঁদের সমস্ত তথ্য নথিভুক্ত করার জন্য অভিবাসন দফতরের অফিসও তৈরি হয়েছে ক্যাম্পে৷
ছবি: Reuters
কাজ চলছে পুরোদমে
শেষ পর্যায়ের কাজে হাত লাগিয়েছেন রাখাইন প্রদেশের সাধারণ মানুষও৷ দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য বহু শ্রমিককে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ক্যাম্পে৷
ছবি: picture-alliance/AP/T. Zaw
জেলখানার মতো
বলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে ক্যাম্পে৷ যদিও কেউ কেউ বলছেন, বাইরে থেকে ক্যাম্পটিকে দেখতে লাগছে জেলখানার মতো৷
ছবি: Reuters
হেলিকপ্টার দর্শন
ইতিমধ্যেই ক্যাম্প তৈরির কাজ দেখে গিয়েছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার সংস্থাগুলি৷ হেলিকপ্টারে করে তাদের এলাকা ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে৷
ছবি: Reuters
7 ছবি1 | 7
সম্মেলনের সমাপনী সংবাদ সম্মেলনে আয়োজক দেশ অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল বলেন যে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছে৷ ‘‘আজ আমরা রাখাইন রাজ্যের অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি৷ অং সান সু চি-ও বিষয়টি নিয়ে আমাদের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলেছেন৷'' বলছিলেন টার্নবুল৷ ‘‘এটুকু বলতে পারি, খুবই ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে৷''
সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন আসিয়ানের চলতি বছরের চেয়ারম্যান সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লং৷ তিনি স্বীকার করেন যে, আসিয়ান দেশগুলো বিষয়টি নিয়ে বিচলিত হলেও কার্যকর কিছু করতে পারেনি৷
‘‘বিষয়টি আসিয়ান দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের৷ কিন্তু এখনো কোনো সমাধানের পথ বের করা যায়নি৷'' বলছিলেন লি৷
দুই শীর্ষ নেতাই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানকে সমর্থন জানাবেন বলে জানিয়েছেন৷ যাঁরা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তাঁদের সহযোগিতা করবেন বলেও জানান৷
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দশ রাষ্ট্রের জোট আসিয়ান৷ এর মধ্যে আছে ব্রুনেই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন্স, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম৷ অস্ট্রেলিয়া এই জোটের ডায়লগ পার্টনার৷
এই জোটের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা এক সদস্য রাষ্ট্র অন্য সদস্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায় না৷ কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা চুপ থাকতে পারেনি৷ বিশেষ করে মালয়েশিয়া বিষয়টি নিয়ে বরাবরই উচ্চকণ্ঠ ছিল৷ তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আসিয়ান নেতৃত্বাধীন স্বাধীন তদন্তের আহ্বানও জানিয়েছে৷
শনিবারের আলোচনায় মালয়েশিয়ার নেতা নাজিব রাজাক সু চি'র ওপর চাপ প্রয়োগ করেন৷ বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ৷ এটি ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গিবাদী দলগুলোকে উস্কে দিতে পারে৷
রবিবারের সংবাদ সম্মেলনে অবশ্য সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি বলেন, রাখাইন অঞ্চলে উগ্রবাদ ছড়িয়েছে সিঙ্গাপুরের কাছে এমন কোনো গোয়েন্দা তথ্য নেই৷ ‘‘তবে বিষয়টিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না৷ নজর রাখতে হবে৷'' বলেন তিনি৷
বৈঠকের বাইরে সু চি এখনো কোনো বক্তব্য দেননি৷ সোমবার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তিনি৷এরপর মঙ্গলবার সিডনির লোয়ি ইন্সটিটিউটে বক্তব্য দেয়ার কথা রয়েছে তাঁর৷
এই শীর্ষ সম্মেলন থেকে ২৯ দফা ঘোষণা এসেছে৷ সেখানে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, দক্ষিণ চীন সাগরের পরিস্থিতি মোকাবেলা ও কোরীয় উপদ্বীপে চলমান সংকট নিয়ে ঘোষণা এসেছে৷ তবে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি৷ এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আসিয়ান দেশগুলোর নিরাপত্তা বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে৷
এদিকে, এই সম্মেলনকে ঘিরে রোহিঙ্গা ইস্যুসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চলমান নানা সংকটের বিরুদ্ধে হাজারো মানুষ প্রতিবাদ করেছেন অস্ট্রেলিয়ায়৷ তারা সু চি'র প্রতিকৃতিতে হিটলারের গোঁফ লাগিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷