বুধবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, গত আগস্টে রোহিঙ্গা জঙ্গিরা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের হিন্দু অধিবাসীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল৷
বিজ্ঞাপন
সংস্থাটির মতে, সন্ত্রাসীরা এই হামলা চালায় গত বছরের ২৫ আগস্ট৷ একইদিনে তারা কয়েকটি পুলিশ পোস্টেও হামলা চালিয়েছিল, যেখান থেকে এবারের সংকট শুরু৷
এই ঘটনার পরই মিয়ানমারের সেনা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুবই নিষ্ঠুরভাবে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে, যার ফলে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন, যারা বহু বছর ধরে সে দেশে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার৷
জাতিসংঘ সেনাবাহিনীর এই ক্র্যাকডাউনকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যায়িত করে৷ কিন্তু নানা অপরাধের সঙ্গে রোহিঙ্গা জঙ্গিদেরও যোগসাজশের প্রমাণ মিলেছে, যার মধ্যে রাখাইনের উত্তরতম অঞ্চলে হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনাও আছে৷
গত সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সেনারা এএফপিসহ বেশ কিছু গণমাধ্যমকে সেখানে নিয়ে যায়, এবং কবর খুড়ে বের করে আনা পঁচা গলা মৃতদেহগুলো দেখায়৷ সে সময় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) এই ঘটনার দায় স্বীকার করেনি৷
তবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট বলছে, নতুন একটি তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে যে, উত্তর মংডুতে খ মওঙ সেইক গ্রামে রোহিঙ্গা জঙ্গিরা ৫৩ জনকে হত্যা করেছে, যাদের বেশিরভাগই শিশু৷
‘‘এই নৃশংসতা ততটাই ভয়াবহ, যতটা মিয়ানমারের সেনা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চালিয়েছে,’’ মন্তব্য করেছেন অ্যামনেস্টির ক্রাইসিস রেসপন্স ডিরেক্টর তিরানা হাসান৷
এই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া আটজনের জবানবন্দী থেকে মানবাধিকার সংস্থাটি যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, তাতে বলা হয়, মাস্ক পরা অনেকগুলো লোক হিন্দু অধিবাসীদের চোখ বন্ধ করে হাঁটিয়ে শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়৷
‘‘তারা পুরুষদের জবাই করে৷ আমাদের বলা হচ্ছিল আমরা যেন সেদিকে না তাকাই৷ তাদের হাতে ছুরি ছিল৷ কারো কারো হাতে কোদাল ও লোহার রড ছিল,’’ ১৮ বছর বয়সি রাজ কুমারি এ সব কথা অ্যামনেস্টিকে জানায়৷
আরেকজন অভিযোগ করে বলেন যে, মানুষের যতটা আগ্রহ রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়ে, ততটা আগ্রহ তাদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে তাতে নেই৷
অন্যদিকে, মিয়ানমার সরকারেরও অভিযোগ, আন্তর্জাতিক অঙ্গন রোহিঙ্গাদেরই কেবল চোখে দেখছে, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ যে কতটা সহিংসতার শিকার সেটি দেখছে না৷
ডেভিড ম্যাথিসন নামের এক বিশ্লেষক বলেছেন, যেহেতু এ ধরনের ঘটনাও ঘটেছে, তাহলে তো মিয়ানমার সরকারের অবশ্যই নিরপেক্ষ তদন্ত করতে দেয়া উচিত৷
এএফপিকে তিনি বলেন, ‘‘সাহায্যকারী সংস্থাগুলোকে, বিশ্লেষকদের ও সাংবাদিকদের না প্রবেশ করতে দিলে সবাই তো মিয়ানমারকেই দোষারোপ করবে৷’’
জেডএ/ডিজি (এএফপি)
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷