সিঙ্গাপুরে দেয়া এক বক্তৃতায় সুচি বলেন, ‘‘যারা ফিরতে চায়, তাদের ফেরাতে বাংলাদেশকেই ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আমরা শুধু তাদেরকে সীমান্তে স্বাগত জানাতে পারি৷''
মিয়ানমারে ফেরত যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে আলোকপাত না করলেও তিনি বল ঠেলে দিলেন বাংলাদেশের কোর্টেই৷ বললেন, ‘‘বাংলাদেশকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে কত তাড়াতাড়ি তারা এ প্রক্রিয়া শুরু করতে চায়৷''
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসবাদ এখনো বড় হুমকি এবং এর কারণে পুরো অঞ্চল ‘হুমকির মুখে' রয়েছে বলে মনে করেন দেশটির নেত্রী অং সান সুচি৷
সিঙ্গাপুরে দেয়া এক বক্তৃতায় সুচি বলেন, ‘‘রাখাইন রাজ্যে মানবিক সংকট শুরু হওয়ার মূলে ছিল সন্ত্রাসী কার্যক্রম৷ এবং এখনো তা সমানভাবে বিদ্যমান৷''
তিনি বলেন, ‘‘দ্রুত এই নিরাপত্তা হুমকি মোকাবেলা করা না হলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলতেই থাকবে৷ এই হুমকি শুধু মিয়ানমারের জন্য নয়, এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের জন্যও ভয়াবহ ফল বয়ে আনতে পারে৷''
একটা সময় ছিল যখন কয়েকজন রোহিঙ্গা মিয়ানমার সংসদে সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ আর এখন রোহিঙ্গাদের ভোট দেয়ারই অধিকার নেই৷
ছবি: DW/M.M. Rahmanবর্তমানে মিয়ানমার নামে পরিচিত দেশে ১২ শতক থেকে মুসলমানরা বাস করছে বলে দাবি অনেক ইতিহাসবিদ ও রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমার যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন (১৮২৪-১৯৪৮) ছিল তখন বর্তমানের ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেকে শ্রমিক হিসেবে সেখানে গিয়েছিল৷ তবে তারা যেহেতু ব্রিটিশ আমলে এসেছে তাই স্বাধীনতার পর মিয়ানমার তাদের অবৈধ হিসেবে গণ্য করে৷ প্রতিবেদন পড়তে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters/Z. Bensemraবাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সংসদকে জানান, বার্মায় ১৯৫১ সালের নির্বাচনে পাঁচজন ও ১৯৫৬ সালে ছ’জন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ সব মিলিয়ে মিয়ানমার সংসদে মোট ১৭ জন রোহিঙ্গা সাংসদ ছিলেন বলে জানান তিনি৷ এর মধ্যে দুজন ছিলেন নারী৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Gacad১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক অভ্যুত্থান হয়৷ এরপর সব নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধন কার্ড করতে বলা হলেও রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছিল বিদেশি পরিচয়পত্র৷ ফলে রোহিঙ্গাদের জন্য চাকরি ও পড়াশোনার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়৷ ছবিটি ১৯৬২ সালের ৪ মার্চ তৎকালীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন থেকে তোলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFPরোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে তাড়াতে ১৯৭৭ সালে নির্যাতন শুরু করা হয়৷ ফলে ১৯৭৮ সালের মে মাসের মধ্যে প্রায় দু’লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর জুলাইতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ জাতিসংঘও মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল৷ ফলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল মিয়ানমার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/K. Hudaবাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়া ঐ চুক্তির উপর ‘সিক্রেট’ অর্থাৎ ‘গোপন’ শব্দটি লেখা ছিল৷ ২০১৪ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়টি চুক্তিটি প্রকাশ করে৷ এতে দেখা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে যাঁদের পরিবারের একসময় জাতীয় নিবন্ধন কার্ড ছিল তাঁদের মিয়ানমার সরকার ‘বার্মার বৈধ বাসিন্দা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ চুক্তিটি পড়তে উপরে (+) চিহ্ন ক্লিক করুন৷
ছবি: http://dataspace.princeton.edu১৯৮২ সালে পাস হওয়া নতুন নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের বস্তুত রাষ্ট্রহীন করে দেয়া হয়৷ ঐ আইনে মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতিগত গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম নেই৷ এই আইনের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য পড়াশোনা, চাকরি, ভ্রমণ, ধর্মীয় রীতিনীতি পালন, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া ইত্যাদি সীমিত হয়ে যায়৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভোটের অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়৷
ছবি: Reuters/C. McNaughton১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে আবার রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার৷ ফলে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর তাদের ফিরিয়ে নিতে দুই দেশ একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছিল৷ বিবৃতিতে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমারের বাসিন্দা’ এবং ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল৷
গত আগস্টের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান শুরু করে৷ ইতিমধ্যে এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ৷ নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ছয় লক্ষ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে৷ তবে তাদের ফিরিয়ে নিতে দু’দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman গণতন্ত্রের জন্য মিয়ানমারের সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো এই নোবেলবিজয়ীকে৷ কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সেনাসহিংসতার বিরোধিতা করতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন তাঁর সমালোচনায় মুখর বিশ্ব৷ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে জাতিসংঘ এরই মধ্যে ‘জাতিগত নিধন' বলে উল্লেখ করেছে৷
গত বছর সাত লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমার থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে প্রবেশ করে৷ মিয়ানমার অবশ্য বরাবরই সব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে৷ বরং রোহিঙ্গাদেরই পালটা ‘সন্ত্রাসী' ও ‘জঙ্গি' বলে আখ্যা দিয়ে আসছে দেশটির সেনাবাহিনী ও সরকার৷
এডিকে/এসিবি (রয়টার্স)