জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর মতে, বর্ষা মৌসুমে কয়েক ফুট পানির নীচে তলিয়ে যায় নোয়াখালীর হাতিয়ার ঠ্যাঙ্গার চর৷ কোনো বন্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থাই নেই দ্বীপে৷ আর এ অবস্থায় পর্যটন ব্যবসার ক্ষতি করছে এমন অজুহাত তুলে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়ার যে পরিকল্পনা করছে তা উদ্বেগের৷ তাদের মতে, ওই দ্বীপে কক্সবাজার থেকে তালিকাভুক্ত ৩২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে স্থানান্তর ও পুনর্বাসন বাস্তবভিত্তিক নয়৷
এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের মিয়ানমার শরণার্থী বিষয়ক সেলের প্রধান অতিরিক্ত সচিব অমিত কুমার বাউল সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হাতিয়ায় স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে৷'' তিনি জানান, বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার৷ সেখানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর কারণে পর্যটন শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে৷ ক্যাম্পগুলো সরিয়ে নেওয়ার পর সেখানে হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে৷''
বাংলাদেশ সরকারকে এ পরিকল্পনা বাতিল করার অনুরোধ জানিয়েছেন মোহাম্মদ ইসলাম নামে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক নেতা৷ তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন,‘‘বাংলাদেশ সরকারের এমন পদক্ষেপে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে৷'' তাই কক্সবাজারে ক্যাম্প রেখেই বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি৷
বাংলাদেশে শরণার্থী, বাংলাদেশের শরণার্থী
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা, ইউএনএইচসিআর-এর এক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশের তালিকায় নবম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ৷ তেমনি বাংলাদেশ থেকেও অনেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে শরণার্থী হয়ে যাচ্ছেন৷
ছবি: Reuters
বাংলাদেশ নবম
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর ‘গ্লোবাল ট্রেন্ডস-২০১৩’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলছে, বিশ্বের শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্থনীতির তুলনায় ধারণক্ষমতার দিকে থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর নবম শরণার্থী আশ্রয়দাতা দেশ৷
ছবি: Shaikh Azizur Rahman
কতজন শরণার্থী?
দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে দুটি সরকারি শরণার্থী শিবিরে ৩০ হাজারের মতো মিয়ানমারের (রোহিঙ্গা) শরণার্থী বসবাস করছে বলে জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিবেদন৷ শিবিরের বাইরে আছে আরও দুই থেকে পাঁচ লাখ অনিবন্ধিত ব্যক্তি৷
ছবি: AP
আশ্রয়প্রার্থী
হ্যাঁ৷ বাংলাদেশেও কেউ কেউ আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন৷ ইউএনএইচসিআর ওয়েবসাইটের বাংলাদেশ পাতায় এমন আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা নয়জন বলে জানানো হয়েছে৷ ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সংখ্যাটা এমন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়৷
ছবি: DW/Shaikh Azizur Rahman
বাংলাদেশের শরণার্থী
উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ থেকে অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন৷ অনেকক্ষেত্রে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পথে রওনা দেন৷ কেউ গন্তব্যে পৌঁছে গ্রেপ্তার হয়ে ফিরে আসেন৷ কেউ বা শরণার্থী পরিচয় পান৷ বাংলাদেশের এমন শরণার্থীর সংখ্যা ৯,৮৩৯ জন৷
ছবি: Reuters
বাংলাদেশের আশ্রয়প্রার্থী
উন্নত বিশ্বে কোনোভাবে ঢুকে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার চল অনেকদিন ধরেই চলছে৷ জাতিসংঘের হিসেবে বাংলাদেশের এমন আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ২২,১২৮ জন৷ সংখ্যাটা ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রযোজ্য৷
ছবি: Reuters
স্বপ্নের শুরু টেকনাফে
বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন অনেক বাংলাদেশি৷ এ জন্য তাঁরা দালালদের অনেক অর্থও দিয়ে থাকেন৷ তাঁদের এই যাত্রা শুরু হয় টেকনাফ থেকে৷
ছবি: DW/Shaikh Azizur Rahman
ছোট নৌকা থেকে বড় নৌকায়
টেকনাফ থেকে প্রথমে ছোট নৌকায় যাত্রা শুরু হয়৷ তারপর একসময় মাছ ধরার বড় নৌকা বা কার্গোতে যাত্রীদের তুলে দেয়া হয়৷ সাধারণত অক্টোবর থেকে পরবর্তী পাঁচ মাসকে সমুদ্র যাত্রার জন্য সঠিক সময় বলে বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: Asiapics
খাবার, পানির অভাব
ইউএনএইচসিআর-এর একটি প্রতিবেদন বলছে, যাঁরা সাগর পথে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেন তাঁদের অনেকে খাবার ও পানির অভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ এছাড়া দালালরা অনেক সময় তাঁদের সঙ্গে খারাপ আচরণও করে৷
ছবি: Reuters
8 ছবি1 | 8
হাতিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মো. মঈনুদ্দীন এর আগে ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছিলেন, ‘‘হাতিয়ার পূর্ব দিকের ঠ্যাঙ্গার চরে কোনো জনবসতি নেই৷ সেখানে বন বিভাগের ১২ হাজার একর জমি রয়েছে৷ সেই জমি থেকেই ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে নোয়াখালী জেলা প্রশাসন৷''
‘‘আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, জরিপ করে ওই চরের জমি বন বিভাগের কাছ থেকে নিতে হবে৷ তবে এই প্রক্রিয়া শেষ করতে কিছুটা সময় লাগবে৷''
তিনি জানান, ‘‘জায়গাটি হাতিয়া উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরের পথ৷ আমি জায়গা পরিদর্শন করেছি৷ এখানে কোনো মানুষের বসতি এখন নেই৷'' আর নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস সোমবার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘১২ হাজার একর জমির মধ্যে যে ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে বর্ষা মৌসুমে পানিতে তলিয়ে যায় বলে যে কথা বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়৷ আশেপাশের এলাকা তলিয়ে যায়৷''
তিনি বলেন, ‘‘সরকার এখনো উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করেনি৷ শুরু করলে বোঝা যাবে আসলে ঠ্যাঙ্গার চরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কেমন হবে৷ নিশ্চয়ই সেখানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হবে৷'' তাঁর মতে, ‘‘পুরো নোয়াখালী এলাকাই বন্যাপ্রবণ৷ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ দিয়ে বন্যার পানি ঠোকানো হয়৷''
ইন্দোনেশিয়ায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের জীবন
সাগরে মানব পাচারকারীদের অত্যাচার সহ্য করে, দীর্ঘদিন অনাহারে, অর্ধাহারে থেকে, অবশেষে ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছেছেন তাঁরা৷ আচেহ রাজ্যে পৌঁছানো রোহিঙ্গা এবং দরিদ্র বাংলাদেশিদের জীবন কীভাবে কাটছে সেখানে? দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Reuters/Beawiharta
নাম, পরিচয় লেখানো
ইন্দোনেশিয়ার জুলক গ্রামে পৌঁছানোর পরই তাঁদের লাইনে দাঁড়াতে হলো৷ নাম, ঠিকানা সব লিখিয়ে তবেই নিস্তার৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
রোগযন্ত্রণা
কুটা বিনজের জুলোক গ্রামে অনেকে এসেছেন হাঁটাচলার শক্তি হারিয়ে৷ এতদিন সাগরে ভেসেছেন নামমাত্র খেয়ে আর মানব পাচারকারীদের অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে৷ স্থলে পৌঁছানোর আগেই নানা ধরণের অসুখে আক্রান্ত তাঁরা৷ শয্যাশায়ী একজনকে কোলে নিয়েছেন একজন, পাশেই আরেকজন তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন গলায় একটু পানি ঢেলে৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
শান্তি
নৌযানে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে এতদিন৷ ভালো করে বসে একটু বিশ্রাম নেয়ারই উপায় ছিল না, আরাম করে নাওয়া-খাওয়া তো দূরের কথা৷ ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে একটা বাথটাবের দেখা পেতেই তাই গোসল শুরু করলেন কয়েকজন৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
ক্ষুধার্ত শিশু
এক শিশুর হাতে বিস্কুট তুলে দিচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার এক স্বেচ্ছাসেবী৷ খুব কাছ থেকে বিস্কুটের দিকে তাকিয়ে আছে আরেক শিশু৷ চোখই বলছে, অনেকদিন পর ভালো খাবারের দেখা পেয়েছে শিশুটি!
ছবি: Reuters/Beawiharta
শান্তির বারি
তৃষ্ণার্ত সন্তানের মুখে মায়ের হাতের পানি৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা
কোলের শিশুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন এক নারী৷ ইন্দোনেশিয়ায় শুরু হলো দুজনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
6 ছবি1 | 6
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছি মাত্র৷ সরকার শেষ পর্যন্ত ঠ্যাঙ্গার চরে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প স্থানান্তর করবে কিনা – সে সিদ্ধান্ত আমরা এখনো জানি না৷''
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারে দুটি শরণার্থী ক্যাম্পে ৩২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছেন৷ এর বাইরে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে বলে সরকারের হিসাব বলছে৷
মিয়ানমারে জাতিগত ও রাজনৈতিক কারণে নিপীড়নের শিকার মুসলিম রোহিঙ্গারা দুই দশক আগে ব্যাপক হারে বাংলাদেশে ঢোকা শুরু করে৷ এই শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে দীর্ঘ দিন ধরে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ সরকার৷
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজের দেশের নাগরিক হিসেবেও মানতে নারাজ৷ এ নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপও উপেক্ষা করে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে৷
২০১২ সালে মিয়ানমারে নতুন করে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হলে সীমান্তে রোহিঙ্গাদের চাপ বাড়লেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভার বহন করে আসা বাংলাদেশ নতুন করে কাউকে ঢুকতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷
১৯৯১ সাল থেকে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সহায়তা দিয়ে আসছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর৷