রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হাসির ঘটনা বিরল৷ তবে ‘ক্লাউন' দেখে ছেলেমেয়েদের আনন্দে কাঁপা কণ্ঠস্বর সত্যিই এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করে৷ আর এভাবেই গেলো সপ্তাহে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির থেকে ভেসে এসেছে ‘শিশুদের হাসি'৷
বিজ্ঞাপন
দীর্ঘদিন ধরে শোকাবহ আর কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্যে থাকা এই শিশুদেরকে মানসিক ট্রমা থেকে বের করে আনতেই এই আয়োজন৷
মা আর তিন ভাই-বোন নিয়ে মোহাম্মদ নূর কুতুপালংয়ে এক অস্থায়ী কুঁড়েঘরে থাকছে, বাঁচার জন্য একটু খাবার আর পানির অভাবের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে যেতে হচ্ছে তাদের৷ মিয়ানমারের সেনাদের হাতে নৃশংসভাবে তার বাবার মৃত্যুর পর মা আর অন্যদের নিয়ে ১০ বছর বয়সি নূর গত মাসে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে৷
বিষাদময় জীবনে এই সার্কাসই যেন নতুন একটা কিছু নিয়ে এলো৷
নূরের ভাষায়, ‘‘এটা খুবই হাস্যকর ছিল৷ আমি আগে কখনও এমন সার্কাস দেখিনি৷ আমি আর আমার বন্ধুরা খু্ব মজা পেয়েছি৷ আমরা শুধু হেসেছি আর হেসেছি৷''
চরম হতাশাজনক পরিস্থিতিকে খানিকটা হালকা করতে ‘বাংলাদেশে থিয়েটার গ্রুপ'-এর ‘ড্রামা থেরাপি' ব্যবহার করার রেকর্ড আগেও ছিল৷ যেমন, ২০১৩ সালে রানা প্লাজার ধসের ঘটনায় ১১শ' পোশাককর্মীর মৃত্যুর পর একদিকে একটি দল নানান পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক দুর্ঘনায় ৫০জন শিশু নিহত হওয়ায় সেখানে অন্য আরেকটি দল ভিন্ন আরেক ধরনের আয়োজন নিয়ে হাজির হয়েছিল৷ রোহিঙ্গা ক্যাম্প, যেখানে অনেক মানুষ অসুস্থ বা আহত, শোকাবহ পরিবেশ...এমন সব জায়গায় মাঝেমধ্যে এ ধরনের হাস্যরসের দরকার হয়৷
ধর্ষণ আর অপহরণের শিকার রোহিঙ্গা এতিম শিশুরা
মিয়ানমার সেনাদের সীমাহীন নির্যাতনের কারণে গত আড়াই মাসে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে৷ সবচেয়ে দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখে পড়েছে শিশুরা৷ জন ওয়েনস এর ছবিতে উঠে এসেছে সেইসব দুর্দশার কিছু কথা৷
ছবি: DW/J. Owens
গুলি আর ছুরিকাঘাত
গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়েছে৷ তাদেরই একজন মোহাম্মদ বেলাল৷ দৌড়ে পালাতে পেরেছিল ১০ বছর বয়সি এই কিশোর৷ সে জানায়, ‘‘সেদিন সেনাবাহিনী এসে পুরো গ্রাম পুড়িয়ে দেয়৷ আমার মা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, সেসময় তাঁকে গুলি করা হয়৷ আমার বাবা হাঁটতে পারছিলেন না, তারা তাঁকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে৷ আমি নিজ চোখে এসব দেখেছি৷’’
ছবি: DW/J. Owens
আতঙ্কগ্রস্ত
মোহাম্মদ বেলালের বোন নূরও হত্যাযজ্ঞ দেখেছে৷ নিঃসঙ্গ হয়ে সে আর তার ভাই এখন বাংলাদেশে শিশুদের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আছে৷ এখানে সে নিয়মিত খাবার পাচ্ছে এবং খেলতে পারছে৷এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য৷ মিয়ানমারে থাকার সময় তাদের দুই ভাই-বোনকে বেশিরভাগ সময়ই না খেয়ে থাকতে হতো৷ তারপরও সাম্প্রতিক এই ট্রমা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না সে৷ ‘‘আমি আমার বাবা-মা, বাড়ি আর দেশ, সবকিছুই ভীষণ মিস করছি,’’ জানায় নূর৷
ছবি: DW/J. Owens
গভীর সঙ্কট
৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে চলছে এই সঙ্কট৷ সংঘাতে ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত দু’ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে৷ সাম্প্রতিক সেনা নিপীড়নের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ১২ বছর বয়সি রহমান বলে, ‘‘তারা আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়৷ অসুস্থ ছিল বলে আমার মা পালাতেও পারেনি৷’’
ছবি: DW/J. Owens
শিশুদের বাঁচাও
বাবা-মাকে হত্যার দৃশ্য নিজ চোখে দেখার পর দিলু আরা তার বোন রোজিনার সাথে পালায়৷ এখন ক্যাম্পে আছে ৫ বছর বয়সি এই শিশু৷ ‘‘আমি খুব কাঁদছিলাম আর পুরোটা সময়ই আমাদের মাথার উপর দিয়ে বুলেট উড়ে যাচ্ছিল৷ কোনো রকমে আমি পালিয়ে এসেছি,’’ বলে শিশুটি৷ বাবা-মা ছাড়া কুতুপালংয়ে আসা এই শিশুদের সাহয়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন৷ বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের শতকরা ৬০ ভাগই শিশু৷
ছবি: DW/J. Owens
পশুদের মতো শিকার
জাদেদ আলমও বাবা-মা ছাড়া কুতুপালংয়ে এসেছে৷তবে ভাগ্য ভালো বলে সে তার চাচীকে সাথে পায়৷চাচীই এখন তার দেখাশোনা করছেন৷ সে বলছিল ‘মান্দি পাড়া’ নামে এক গ্রামে বেড়ে উঠেছে সে৷ ফুটবল খেলতেও সে খুব পছন্দ করতো৷ তবে সেনা অভিযানের পর থেকে সবকিছুই বদলে যায়৷ সে জানায়, ‘‘তারা আমাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে বলে৷ আমি আমার বাবা-মা’র সাথে দৌড়ে পালাচ্ছিলাম, এমন সময় তাঁদেরকে গুলি করে সেনারা৷ সাথে সাথে মারা যায় তারা৷’’
ছবি: DW/J. Owens
শিশু অপহরণ
এসব ঘটনার সময় সব পরিবারকেই যে আলাদা হতে হয়েছে, তা নয়৷ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রহমান আলী নামে এই ব্যক্তি এই ক্যাম্পে আছেন৷ তবে এখন তিনি তার ১০ বছর বয়সি ছেলে জিফাদকে খুঁজে পাচ্ছেন না৷ ক্যাম্প এলাকায় প্রায় সারা বছরই শিশু অপহরণের গুজব শোনা যায়৷ রহমানের আশংকা, তাঁর ছেলেও পাচারকারীদের হাতে পড়েছে৷ ‘‘আমি খেতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি না৷ আমি মনে হয় পাগলই হয়ে গেছি,’’ বলে রহমান৷
ছবি: DW/J. Owens
‘আমি স্বাভাবিক নেই’
যখন গুলি শুরু হয়, তখন সকিনা খাতুন তাঁর বাচ্চাদের বাঁচাতে প্রাণপণে চেষ্টা করেছে৷ তারপরও ১৫ বছরের ইয়াসমিন আর ২০ বছরের জামালিকে বাঁচাতে পারেননি৷ ঘটনার সময় তারা পাশের গ্রামে ছিল৷ সকিনা বলছিল, ‘‘দাদা-দাদীর সামনে তাদের গলা কেটে হত্যা করা হয়৷ আমি এতটাই অনুভূতি শূণ্য হয়ে পড়েছি যে, এই কষ্টও অনুভব করতে পারছি না৷ তাই এই মুহূর্তে আমি স্বাভাবিক নেই৷’’ দুই সন্তানকে হারালেও বাকি নয় জনকে রক্ষা করতে পেরেছেন তিনি৷
ছবি: DW/J. Owens
হামলা, ধর্ষণ এবং লুটপাট
ইয়াসমিনের বয়স ১৫-র কাছাকাছি৷ তবে তাকে তার চেয়েও কম বয়সি বলে মনে হয়৷ গ্রামে থাকার সময় সে মার্বেল খেলতো আর বাড়ির কাছের মাঠে খেলতো৷ এখন অবশ্য ভিন্ন স্মৃতি তাড়িত করছে তাকে৷ মিয়ানমারের সেনারা তার বাবা ও ভাইদের প্রথমে মারধর ও পরে হত্যা করে৷ একদল সেনা তাকে ধর্ষণও করে৷ এখন ইয়াসমিন কেবল এটুকু বলতে পারে,‘‘আমার শরীরে ভীষণ ব্যথা৷’’
ছবি: DW/J. Owens
8 ছবি1 | 8
‘‘আমাদের একমাত্র লক্ষ্য রোহিঙ্গাদের মুখে হাসি ফোটানো'' বললেন গ্রুপটির অভিনেত্রী রিনা আক্তার পুতুল৷ ‘‘ মানুষকে হাসানোর কাজটি খুবই কঠিন, বিশেষ করে যারা সহিংসতায় তাদের বাবা-মাকে হারিয়েছে,'' যোগ করেন তিনি৷
জাতিসংঘের হিসাব মতে, গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, যার ৬০ ভাগই শিশু৷ রাখাইন রাজ্যে বাবা-মা'র মৃত্যুর পর অনেক শিশু একা একাও পালিয়ে এসেছে৷
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নাট্যচর্চা করছেন ফকির আলী৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি নিশ্চিত যে, আমাদের শো কিছু সময়ের জন্য হলেও তাদের স্মৃতিতে থাকবে৷ এতে তাদের ভয় হয়তো একেবারে চলে যাবে না৷ তবে তাদের আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বেড়ে যাবে৷''
কেবল শিশুরা নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকা বেশিরভাগ মানুষই উপভোগ করেছেন এই সার্কাস৷ কাজেই তাদের এই অক্লান্ত পরিশ্রম সবারই কাজে আসছে কোনো-না-কোনোভাবে৷
ড্রোন থেকে তোলা ছবিতে হাজারো রোহিঙ্গার দেশ ছাড়ার দৃশ্য
00:55
৩৮ বছর বয়সি নিসার আহমেদ বলেন, ‘‘একেবারে মাঝেমধ্যে আমরা এরকম মজা করার সুযোগ পাই৷ এমনকি মুসলমানদের বিয়ে বা অন্যান্য ধর্মীয় উত্সবের সময়ও খুব অল্পই বিনোদনের সুযোগ থাকে৷''
‘‘রাখাইনের জীবন ভয়ানক,'' বললেন ৬৩ বছর বয়সি খাইরুল আমিন৷ তিনি এএফপিকে বলেন, ‘‘শিশু, তরুণ, বয়স্ক সবাই এসে তীব্র এক ভীড় সৃষ্টি করে শো-এর সময়৷''
তিনি আরও বলেন, ‘‘এখানে কোনো টেলিভিশন, থিয়েটার বা সিনেমা নেই৷ সার্বক্ষণিক সঙ্গী হলো, সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়া বা মারা যাওয়ার আতংক৷''
নিজের সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে এই শো দেখেছেন রেহানা৷ হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘‘আমার জীবনে কখনোই আমি এই ধরনের মজা দেখিনি৷''