জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাকে পাশ কাটিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসিচব৷ ঐ চুক্তি অনুযায়ী, দুই বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে মিয়ানমার৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার জাতিসংঘের সদরদপ্তরে আন্তোনিও গুতেরেস এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে ইউএনএইচসিআরকে এই চুক্তির সময় সাথে রাখাটা জরুরি ছিল৷’’ চলতি সপ্তাহে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক শেষে এই ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চুক্তি সই হয়৷ গুতেরেস মহাসচিব হওয়ার আগে ১০ বছর জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হাই কমিশনার ছিলেন৷
২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে৷ আর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে৷ এছাড়া, আরও প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা ২০১৬ সালের অক্টোবরের আগে থেকে বাংলাদেশে অবস্থান করছে৷ এই চার লাখকে এই চুক্তির অধীনে ফেরত নেয়া হবে না৷ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে৷
রোহিঙ্গাদের ইতিহাস
একটা সময় ছিল যখন কয়েকজন রোহিঙ্গা মিয়ানমার সংসদে সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ আর এখন রোহিঙ্গাদের ভোট দেয়ারই অধিকার নেই৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
স্বাধীনতার আগে
বর্তমানে মিয়ানমার নামে পরিচিত দেশে ১২ শতক থেকে মুসলমানরা বাস করছে বলে দাবি অনেক ইতিহাসবিদ ও রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমার যখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন (১৮২৪-১৯৪৮) ছিল তখন বর্তমানের ভারত ও বাংলাদেশ থেকে অনেকে শ্রমিক হিসেবে সেখানে গিয়েছিল৷ তবে তারা যেহেতু ব্রিটিশ আমলে এসেছে তাই স্বাধীনতার পর মিয়ানমার তাদের অবৈধ হিসেবে গণ্য করে৷ প্রতিবেদন পড়তে ‘+’ চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters/Z. Bensemra
রোহিঙ্গা সাংসদ
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সংসদকে জানান, বার্মায় ১৯৫১ সালের নির্বাচনে পাঁচজন ও ১৯৫৬ সালে ছ’জন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ সব মিলিয়ে মিয়ানমার সংসদে মোট ১৭ জন রোহিঙ্গা সাংসদ ছিলেন বলে জানান তিনি৷ এর মধ্যে দুজন ছিলেন নারী৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Gacad
অভ্যুত্থান
১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক অভ্যুত্থান হয়৷ এরপর সব নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধন কার্ড করতে বলা হলেও রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছিল বিদেশি পরিচয়পত্র৷ ফলে রোহিঙ্গাদের জন্য চাকরি ও পড়াশোনার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়৷ ছবিটি ১৯৬২ সালের ৪ মার্চ তৎকালীন বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন থেকে তোলা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFP
প্রথমবার বিতাড়ন
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে তাড়াতে ১৯৭৭ সালে নির্যাতন শুরু করা হয়৷ ফলে ১৯৭৮ সালের মে মাসের মধ্যে প্রায় দু’লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর জুলাইতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ জাতিসংঘও মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল৷ ফলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল মিয়ানমার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/K. Huda
‘গোপন’ চুক্তি
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়া ঐ চুক্তির উপর ‘সিক্রেট’ অর্থাৎ ‘গোপন’ শব্দটি লেখা ছিল৷ ২০১৪ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়টি চুক্তিটি প্রকাশ করে৷ এতে দেখা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে যাঁদের পরিবারের একসময় জাতীয় নিবন্ধন কার্ড ছিল তাঁদের মিয়ানমার সরকার ‘বার্মার বৈধ বাসিন্দা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ চুক্তিটি পড়তে উপরে (+) চিহ্ন ক্লিক করুন৷
ছবি: http://dataspace.princeton.edu
রাষ্ট্রহীন
১৯৮২ সালে পাস হওয়া নতুন নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদের বস্তুত রাষ্ট্রহীন করে দেয়া হয়৷ ঐ আইনে মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতিগত গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম নেই৷ এই আইনের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য পড়াশোনা, চাকরি, ভ্রমণ, ধর্মীয় রীতিনীতি পালন, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া ইত্যাদি সীমিত হয়ে যায়৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভোটের অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়৷
ছবি: Reuters/C. McNaughton
দ্বিতীয় পর্যায়ের বিতাড়ন
১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে আবার রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার৷ ফলে প্রায় আড়াই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল৷ এরপর তাদের ফিরিয়ে নিতে দুই দেশ একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছিল৷ বিবৃতিতে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমারের বাসিন্দা’ এবং ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল৷
সবশেষ ঘটনা
গত আগস্টের এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনে অভিযান শুরু করে৷ ইতিমধ্যে এই অভিযানকে ‘জাতিগত নিধন’ বলে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ৷ নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ছয় লক্ষ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে৷ তবে তাদের ফিরিয়ে নিতে দু’দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে৷
ছবি: DW/M.M. Rahman
8 ছবি1 | 8
গুতেরেস বলেন, ‘‘এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে রোহিঙ্গারা যেন নিজেদের বাড়িতে নিরাপদে ফিরে যেতে পারে, তাদের যেন জোর করে পাঠানো না হয় এবং মিয়ানমারে ফিরে যেন শরণার্থী শিবিরে থাকতে না হয়৷’’ সংবাদ সম্মেলনটি মূলত ছিল ২০১৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে, সে ব্যাপারে৷ সেখানে সাংবাদিকদের গুতেরেস বলেন, ‘‘বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে নিয়ে গিয়ে মিয়ানমারের শরণার্থী শিবিরে যদি রোহিঙ্গাদের রাখা হয়, সেটা হবে খুব খারাপ ব্যাপার৷’’
গত বছরের ডিসেম্বরে রাখাইনে সহিংসতার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয় জাতিসংঘে, পাশাপাশি মিয়ানমারে বিশেষ দূত নিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়৷ খুব শিগগিরই সেই নিয়োগ পক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে জানান জাতিসংঘ মহাসচিব৷
রাখাইনে উত্তেজনা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশের গুলিতে সাত বিক্ষোভকারী নিহত ও ১২ জন আহত হয়েছে৷ মঙ্গলবার রাতে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় মারাউক ইউ শহরে আরাকান রাজ্যের পতন দিবস উপলক্ষে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়েছিল৷ রাখাইন রাজ্য সরকারের সচিব টিন মায়ুং সউয়ি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ‘‘আরাকান পতন দিবসের বার্ষিক স্মরণোৎসব শেষ হওয়ার পর প্রায় চার হাজার মানুষ সরকারি একটি ভবন ঘিরে ফেলে৷ স্মরণোৎসবের সংগঠকরা তাদের আয়োজনের বিষয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো অনুমতিও নেয়নি৷ জনতাকে হটাতে প্রথমে রাবার বুলেট ব্যবহার করে পুলিশ৷ কিন্তু তারা সরে না যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা কর্মীরা গুলি করতে বাধ্য হন৷ কিছু লোক পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়৷''
রাখাইনের বাসিন্দারা আরাকানি হিসেবেও পরিচিত৷ মিয়ানমারের সরকারিভাবে স্বীকৃত ১৩৫টি নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আরাকানিরা অন্যতম৷ ১৭৮৪ সালে বার্মা রাজ্যের কাছে পরাজিত হওয়ার মাধ্যমে আরাকানের পতন হয়৷
এপিবি/এসিবি (এপি, এএফপি, রয়টার্স)
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বিয়ে
শরণার্থী শিবির, তাতে কী? সেখানে তো কোনো আনন্দ আয়োজনে বাধা নেই! শফিকা আর সাদ্দাম তাই নিজেদের নতুন জীবন শুরু করলেন আশ্রয় শিবিরেই৷ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা এই দু’জন রোহিঙ্গা শরণার্থী গত মাসের শেষে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
আনন্দের সেই দিন
শফিকার বয়স ১৮ বছর৷ বিয়ের ঠিক আগে ফটোগ্রাফারকে বিয়ের আংটি আর হাতের মেহেদি দেখাচ্ছেন তিনি৷ অনেকেরই বিশ্বাস, মেহেদির রং নব-দম্পতির জীবনকে রঙিন করে এবং জীবনে খুশির বার্তা নিয়ে আসে৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
বর সাদ্দামের বয়স ২৩ বছর৷ তিনি বিয়ের আসরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন৷ শফিকার সাথে তাঁর বাল্যকালের প্রেম৷ তাঁরা মিয়ানমারের গ্রাম ফয়রা বাজারে থাকতেন৷ কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাঁদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়৷ তবে সেখান থেকে পালিয়ে আসার আগেই তাঁদের বিয়ের সবকিছু ঠিক ছিল৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
বিদায়ের অশ্রু
এখন বিয়েটা হচ্ছে, তবে নিজের দেশে নয়৷ আত্মীয়-পরিজনরা ঘিরে রেখেছে নবপরিণীতাকে৷ বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার মতোই, শফিকা এখন এই তাঁবু ছেড়ে বরের তাঁবুতে গিয়ে উঠবেন৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
অতিথিদের আগমন
বিয়ে উপলক্ষ্যে অন্যান্য শরণার্থী শিবির থেকে অতিথিরা বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছেন৷ শফিকা এবং সাদ্দাম মাত্র তিন মাস আগে বাংলাদেশে আসেন৷ সে সময় কুতুপালং আশ্রয়কেন্দ্রে জরুরি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
আল্লাহর নামে শপথ
অন্যান্য ইসলামি বিয়ের মতোই এই বিয়ের রীতি-নীতি একই ছিল৷ একজন ইমাম তাঁদের বিয়ে পড়ান৷ পরে শফিকা এবং সাদ্দাম আল্লাহ’র উদ্দেশে শুকরিয়া আদায় করে প্রার্থনা করেন৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
বিয়ের অনুষ্ঠান
ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে তরুণরা নেচে গেয়ে অতিথিদের আনন্দ দেন৷ নাচ-গানের মধ্য দিয়ে যেন তাঁরা তাঁদের কষ্টের কথা কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলে যান৷
ছবি: Reuters/D. Sagolj
স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন
বিয়ের পাঁচদিন পর শরণার্থী শিবিরে নতুন জীবন শুরু করেছেন নব-দম্পতি৷ সাদ্দাম রাস্তার পাশে ওষুধ বিক্রি করেন আর শফিকা বাড়ির কাজে ব্যস্ত থাকেন৷
ছবি: Reuters/M. Djurica
আশার আলো
আরো অনেক শরণার্থীদের মতোই এই নব-দম্পতির আশা একসময় তাঁরা নিজেদের বাড়িতে নিরাপদে ফিরে যেতে পারবেন৷