শুক্রবার ঢাকায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন বা র্যাবের নির্মাণাধীন সদর দপ্তরে একটি আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে৷ এতে হামলাকারী নিহত ও দুই ব়্যাব সদস্য আহত হয়৷ তবে নিহত হামলাকারী কোন জঙ্গি দলের সদস্য তা জানা যায়নি৷
বিজ্ঞাপন
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এক জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে একটি শিশুসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ২৭ ঘণ্টার মাথায় এই আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের গটনা ঘটে৷ বিস্ফোরণে নিহত যুবকের নাম না জানা গেলেও, তার বয়স ২৫ বছর বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ তার পরনে ছিল কালো পাঞ্জাবি৷ বিস্ফোরণে তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়৷ তবে মুখমণ্ডল স্পষ্ট আছে৷
র্যাবের মিডিয়া উইং-এর পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ হামলার পর বিকাল তিনটার দিকে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘‘আনুমানিক দুপুর ১টার দিকে নির্মাণাধীন র্যাব সদর দপ্তরের বাউন্ডারি ওয়ালের নীচ দিয়ে একজন প্রবেশ করে৷ অপরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় ব্যারাকে থাকা র্যাব সদস্যরা তাকে চ্যালেঞ্জ করেন৷ চ্যালেঞ্জ করার সঙ্গে সঙ্গে সে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং তারপরই একটা বিস্ফোরণ ঘটে৷ তার সঙ্গে যে বোমা ছিল, সেই বোমার বিস্ফোরণেই ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়৷''
মুফতি মাহমুদ
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পূর্ব দিকে আশকোনা হাজি ক্যাম্প এলাকায় র্যাবের নির্মাণাধীন এই সদর দপ্তরটির অবস্থান৷ এর কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে র্যাবের বর্তমান সদর দপ্তর, র্যাব-১, বিমানবন্দর এবং বিমানবন্দর থানার অবস্থান৷
প্রত্যক্ষদর্শী মামুনুর রহমান জানান, ‘‘সম্ভবত দুপুর পৌনে একটার পর র্যাব ক্যাম্প থেকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পাই৷ দৌড়ে গিয়ে দেখি সেখানে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে৷ মৃতদেহের ছিন্নভিন্ন অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷''
মুফতি মাহমুদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘নিহত যুবক কোন জঙ্গি গ্রুপের সদস্য, তা এখনো জানা যায়নি৷ তবে বিস্ফোরক ও বিস্ফোরণের ধরন দেখে বলা যায় সে জঙ্গি৷''
এই হামলার পর ওই এলাকায় বোমা নিস্ক্রিয়করণ দল কাজ শুরু করে৷ নিহত যুবকের কোমরে বিস্ফোরকের ভেস্ট ছিল বলে জানায় তারা৷ সেখান থেকে একটি কালো ব্যাগ উদ্ধার করা হয়৷ তবে তাতে কী আছে, তা এখনও জানা যায়নি৷ মরদেহের কাছ থেকে একটি বোমা উদ্ধারের দাবিও করেন তাঁরা৷
আত্মঘাতী বিস্ফোরণে পর বাংলাদেশের বিমান ও স্থলবন্দর, থানা এবং কারাগারের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে৷
Noor Khan - MP3-Stereo
বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো দপ্তরে জঙ্গি হামলার ঘটনা এটাই প্রথম৷ এর আগে আদালত চত্বর এবং পুলিশের ওপর হামলা চালানো হলেও কোনো স্থাপনায় হামলা হয়নি৷ এ বিষয়ে জঙ্গি বিষয়ক গবেষক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হোলি আর্টিজানে হামলা পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মুখে জঙ্গিরা হয়ত আত্মঘাতী হামলার পথ বেছে নিয়েছে৷ এর আগে জঙ্গিরা অভিযানের মুখে আত্মঘাতী হলেও এবার সরাসরি আত্মঘাতি হামলা চালালো, যা আতঙ্কের বিষয়৷''
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে জঙ্গিদের আস্তানায় এক অভিযানে নারীসহ চারজন জঙ্গি এবং এক শিশু নিহত হয়৷ পুলিশের দাবি, তাদের মধ্যে নারীসহ দুই জঙ্গি আত্মঘাতী হয়েছে৷ নূর খান বলেন, ‘‘ঢাকার আত্মঘাতী হামলা চট্টগ্রামে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের প্রতিশোধও হতে পারে৷''
হোলি আর্টিজান হামলার পর জঙ্গিদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে৷ কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ, রূপনগর, আজিমপুর, আশকোনা, গাজীপুরের অভিযানে জঙ্গিরা হয় প্রতিরোধ করেছে অথবা আত্মঘাতী হয়েছে৷ আজিমপুর ও আশকোনায় নারী জঙ্গিরাও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলার চেষ্টা করে৷
নূর খানের মতে, ‘‘জঙ্গিরা অস্থির হয়ে পড়েছে৷ তারা এখন একক বা কম সদস্য নিয়ে হামলা চালাচ্ছে বা প্রতিরোধে সচেষ্ট হচ্ছে, যেটা আত্মঘাতী ইউনিটের পক্ষেই সম্ভব হয়৷ এদের জনবল কমে যাওয়ায় কম জনবল দিয়ে কার্যকর হামলার জন্যও তারা আত্মঘাতী হতে পারে৷''
বাংলাদেশে কি আত্মঘাতী হামলার একটা ‘ট্রেন্ড’ শুরু হলো? লিখুন আপনার মন্তব্য, নীচের ঘরে৷
র্যাব – বিতর্কিত এক বিশেষ বাহিনী
শুরুটা হয়েছিল ২০০৪ সালে৷ সেসময় বাঘা বাঘা জঙ্গিদের কুপোকাত করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় ব়্যাব৷ কিন্তু অসংখ্য ক্রসফায়ার, অপহরণ, হত্যার দায়ে এখন সমালোচিত এই ‘এলিট ফোর্স’৷ র্যাব নিয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/AFP
‘এলিট ফোর্স’
বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র্যাব নামক ‘এলিট ফোর্স’-এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে৷ এই বাহিনীর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ‘‘পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রমকে আরো গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সরকার একটি এলিট ফোর্স গঠনের পরিকল্পনা করে৷’’ তবে এই বাহিনী এখন তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন মহল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সমন্বিত বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠন করা হয়৷ এই বাহিনীর উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান রোধ, দ্রুত অভিযান পরিচালনা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন কার্যক্রমে নিরাপত্তা প্রদান৷
ছবি: Getty Images/AFP
জঙ্গি তৎপরতা দমন
শুরুর দিকের ব়্যাবের কার্যক্রম অবশ্য বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল৷ বিশেষ করে ২০০৫ এবং ২০০৬ সালে বাংলাদেশে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র ইসলামি জঙ্গি তৎপরতা দমনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে র্যাব৷
ছবি: AP
জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার
বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় ২০০৫ সালে একসঙ্গে বোমা ফাটিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা জেএমবির শীর্ষ নেতাদের আটক ব়্যাবের উল্লেখযোগ্য সাফল্য৷ ২০০৬ সালের ২ মার্চ শায়খ আব্দুর রহমান (ছবিতে) এবং ৬ মার্চ সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় ব়্যাব৷ একাজে অবশ্য পুলিশ বাহিনীও তাদের সহায়তা করেছে৷
ছবি: DW
ভুক্তভোগী লিমন
২০১১ সালে লিমন হোসেন নামক এক ১৬ বছর বয়সি কিশোরের পায়ে গুলি করে এক ব়্যাব সদস্য৷ গুলিতে গুরুতর আহত লিমনের বাম পা উরুর নীচ থেকে কেটে ফেলতে হয়৷ এই ঘটনায় ব়্যাবের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ তবে এখনো সুবিচার পায়নি লিমন৷ উল্টো বেশ কিছুদিন কারাভোগ করেছেন তিনি৷
ছবি: DW
‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’
জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য দেখালেও ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব়্যাবের বিরুদ্ধে সমালোচনা ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করে জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বাহিনী ‘সিসটেমেটিক’ উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে৷
ছবি: DW
‘ক্রসফায়ার’
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যালোচনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ব়্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৪ জন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে কমপক্ষে সাতশো হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ব়্যাব জড়িত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আলোচিত সাত খুন
২০১৪ সালের মে মাসে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ৬ কোটি টাকা ঘুসের বিনিময়ে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ এবং খুনের অভিযোগ ওঠে৷ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তিন ব়্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ৷ এই ঘটনার পর ব়্যাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আবারো বিতর্ক শুরু হয়েছে৷
ছবি: DW
প্রতিষ্ঠাতাই করছেন বিলুপ্তির দাবি
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ব়্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন৷ অথচ তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘এলিট ফোর্স’৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিলুপ্তির দাবি নাকচ
বাংলাদেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তর থেকে ব়্যাবকে বিলুপ্তির দাবি উঠলেও বর্তমান সরকার সেধরনের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না৷ বরং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ব়্যাব বিলুপ্তির দাবি নাকচ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাবের কোনো সদস্য আইন ভঙ্গ করলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’