র্যাব প্রতিষ্ঠার ২০ বছর: অন্তত ২,৯৫৪ বিচারবহির্ভূত হত্যা
৪ নভেম্বর ২০২৪আসক এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ধারাবাহিকভাবে পর্যবেক্ষণ করে৷ সংবাদপত্র এবং নিজেদের তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতেই এ তালিকা করেছে আসক৷
দেখা গেছে, এ বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে জড়িত পুলিশ, র্যাবসহ সরকারের নানা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ র্যাব ও পুলিশ ছাড়াও যে বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আছে, সেগুলো হলো ডিবি পুলিশ, কোস্টগার্ড, বিজিবি, কোবরা টিম ও আনসার৷ আসকের হিসাবে, গত ২০ বছরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আছে পুলিশের বিরুদ্ধে৷ এরপর আছে র্যাব৷
কেন ২০০৪ থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যার হিসাব?
আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও পরিস্থিতি উন্নয়নের নামে ২০০৪ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা ক গঠন করে৷ সেই সময় মানবাধিকারকর্মীসহ অনেকেই পুলিশ বাহিনীকে যুগোপযোগী এবং পেশাদার বাহিনীতে রূপান্তর করার দাবি করেছিলেন৷ কিন্তু সে দাবিকে পাশ কাটিয়ে র্যাব নামের এলিট ফোর্স গঠন করা হয়৷
মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার প্রথম আলোকে বলেন, র্যাবের গঠন নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন বা কর্মীরা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো উদ্বেগ অথবা শঙ্কা প্রকাশ করেননি৷ কিন্তু পরে এ বাহিনী ‘ক্রসফায়ার'–এর নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকেই সন্ত্রাস দমনের সবচেয়ে সহজ কৌশল হিসেবে বেছে নেয়৷ প্রথম দিকে বেশ কয়েকজন চিহ্নিত দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী এই প্রক্রিয়ায় নির্মূল হওয়ায় জনগণের একাংশ সন্তোষ প্রকাশও করেছেন৷ কিন্তু মানবাধিকারকর্মীদের পক্ষে এদের এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না৷এই বাহিনী গঠনের বছর না ঘুরতেই ‘ক্রসফায়ারে' নিহত হওয়ার সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়৷ পরে তা আরও বেড়েছে৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার প্রথম আলোকে বলেন, ‘র্যাব গঠনের পর থেকেই বাহিনীটি ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টারের মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে৷ একপর্যায়ে পুলিশ বাহিনীকেও এ ধরনের বেআইনি কার্যক্রমে যুক্ত হতে দেখা যায়৷ এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপি সরকারের নেওয়া নীতির পরিবর্তন আমরা লক্ষ করিনি; বরং ধারাবাহিকতা দেখেছি৷ এরপর আওয়ামী লীগ সরকার আসার পরও বাহিনীগুলো সতর্ক তো হয়ইনি; বরং অনেকটা যেন পরম্পরা রক্ষায় ব্যতিব্যস্ত ছিল৷ গত সরকারের আমলের মাদকবিরোধী অভিযানের নামে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অনেক বেশি লক্ষ করা গেছে৷'
২০১১ সালে ‘অগোচরে অপরাধ: বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড' শীর্ষক এক প্রতিবেদন তৈরি করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ সেখানে বলা হয়, ‘র্যাবের বাহিনী গঠনের কয়েক মাসের মধ্যে র্যাবের অভিযানগুলো খুনের একটি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পরিচিতি পায়, যাকে কর্তৃপক্ষ বলছে ‘ক্রসফায়ারে মৃত্যু' এমন অনেক মৃত্যুতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সুস্পষ্ট৷ দেখা যায়, সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তারের পর নির্জন স্থানে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে৷ কোনো কোনো ঘটনায় গ্রেপ্তারের প্রত্যক্ষদর্শী থাকলেও র্যাবের কর্তৃপক্ষ তাদের দাবিতে অটল থেকেছে৷ জানিয়েছে যে ঘটনার শিকার ব্যক্তি ‘ক্রসফায়ার কিংবা গোলাগুলি কিংবা বন্দুকযুদ্ধে' মারা গিয়েছে৷'
বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিন্ন ‘গল্প'
দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাগুলো নানা বাহিনীর মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর এসব বাহিনীর পক্ষ থেকে ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হয়৷ সেসব বর্ণনাসংবলিত প্রেস রিলিজ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরবরাহও করা হয়৷ সেগুলো থেকে দেখা গেছে, বাহিনীর মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও বিচারবহির্ভূত হত্যার বর্ণনা প্রায় অভিন্ন৷ শুধু স্থান, কাল ও ঘটনার পক্ষ-বিপক্ষের ক্ষেত্রেই যা ভিন্নতা৷
বিচারবহির্ভূত হত্যা: কোন সময়ে বাড়ল, কখন কমল
আসকের হিসাব অনুযায়ী, গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালে৷ ওই বছর ৪১২ জন এ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে পুলিশের হাতে, ২১৬টি৷ র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন ১৩৫ জন৷ অন্যান্য বাহিনীর হাতে এ ধরনের হত্যার ঘটনা ঘটে ১৭টি৷
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ ওই বছর দেশে ১৮৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন৷ কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরের বছরই হত্যার ঘটনা ঘটে ৫১টি৷ আসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৪ সালের পর এর আগে বিচারবহির্ভূত কম হত্যা হয় ২০১৩ সালে, ৪২টি৷
আসকের সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় র্যাব আসার পর থেকে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কমে যায়৷ হয়তো র্যাবের পরিস্থিতি দেখে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয়ে ওঠে৷ এখন প্রশ্ন, তাহলে নিষেধাজ্ঞা জারির পর বাহিনীগুলো এ ধরনের ক্রসফায়ার না করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখল কীভাবে? তাহলে আমরা বলতেই পারি, ২০০৪ সাল থেকে সংঘটিত এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ছিল সরকারগুলোর জনমনে ভীতি ছড়ানোর কৌশল৷ একটি সমাজব্যবস্থায় গত ২০ বছরে এত মানুষের জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘটনা নজিরবিহীন৷
বিচার না হওয়া
২০১১ সালে ‘অগোচরে অপরাধ: বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড' শীর্ষক এক প্রতিবেদন তৈরি করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এ ধরনের মৃত্যুকে (বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) সাধারণত দুর্ঘটনাজনিত বলে চালিয়ে দেওয়া হয় কিংবা বলা হয়, র্যাব কর্মকর্তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি করায় ‘ক্রসফায়ার'–এ মারা গিয়েছে৷ অনেক ঘটনায় শিকার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর হত্যা করা হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও এ ধরনের মৃত্যুগুলোর ক্ষেত্রে র্যাব কিংবা সরকারের বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে কখনোই বিচারিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি৷'
সুলতানা কামাল বলছিলেন, সঠিক অর্থে জবাবদিহি করতে হয়নি বলে এই ২০ বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তিন হাজারের কাছে পৌঁছেছে৷ এটি মানবাধিকারের দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং অগ্রহণযোগ্য৷ একটি মানবিক বোধসম্পন্ন সমাজে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো এবং তা সহ্য করা—উভয়ই মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ৷
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কী করে
বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু, নির্বিচার আটক ও গুম—এই চার ধরনের ঘটনাকে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করা হয়৷ কিন্তু জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ পর্যন্ত মাত্র একটি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনার তদন্ত করে৷
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিযান পরিচালনা করে যশোরের কেশবপুর থানা-পুলিশ কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন রজব আলী নামের এক ব্যক্তি৷ এ ঘটনা তদন্ত করে ওই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাকে ‘হত্যাকাণ্ড' বলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন৷ ঘটনার সঙ্গে পুলিশের বক্তব্যের অসংগতিও চিহ্নিত করে কমিশন বলেছিল, এই কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার সত্যতা নেই৷ কমিশনের ওই তদন্তের ঘটনা সাড়া ফেলে৷ কিন্তু ওই প্রথম, ওই শেষ তদন্ত৷
এখন এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পটভূমিতে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচার করার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন আবু আহমেদ ফয়জুল কবির৷ তিনি বলেন, যদি বর্তমান সরকার মনে করে এ ধরনের হতাকাণ্ডের ঘটনা বিচারের আওতায় আনবে, তাহলে যেন সব হত্যারই বিচারের উদ্যোগ নেয়৷ কেননা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো যন্ত্রণা নিয়ে এখনো বেঁচে আছে৷ আর এ দেশের মানবাধিকারকর্মীরা শুরু থেকেই এ হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রতিবাদ করে এসেছে এবং প্রতিকারের আশায় এখনো দাবি করে যাচ্ছে৷
এপিবি/এসিবি (দৈনিক প্রথম আলো)