রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় যুবলীগের এক নেতার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আদিবাসীদের চারটি গ্রামের সব বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে৷ আতঙ্কে তারা এখন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছেন৷ উপজেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার ৭নং ইউনিয়ন শাখার যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নুরুল ইসলাম নয়ন (৩৫)-এর লাশ উদ্ধার করা হয়৷ লাশটি উদ্ধার করা হয় খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার চার মাইল এলাকা থেকে৷ স্থানীয় পুলিশ জানায়, দুর্বৃত্তরা তাঁকে হত্যার পর লাশ ফেলে রেখে যায়৷ এরপর থেকেই লংগদু উপজেলা সদরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়৷
শুক্রবার সকাল ৮ টার দিকে লাশ নিয়ে আসা হলে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে৷ লাশ নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়৷ সকাল ১০টার দিকে লংগদু সদরের তিন টিলা এলাকায় মিছিল পৌঁছালে কোনও উসকানি ছাড়াই জনসংহতি সমিতির অফিসসহ এলাকার বাড়িঘর ও দোকানগুলোতে আগুন দেয়া হয়৷ চালানো হয় লুটপাট৷
জনসংহতি সমিতির জেলা শাখার তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘আগুনে প্রায় দুশ’ ঘরবাড়ি ও দোকানপাট সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷’’ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সবাইকে গ্রেফতারেরও দাবি জানান তিনি৷
Moni Sankar - MP3-Stereo
লংগদু উপজেলার আটারকছড়ার ইউপি চেয়ারম্যান মঙ্গল কান্তি চাকমা সংবাদ মাধ্যমকে জানান, বিক্ষোভ মিছিলের সময় প্রশাসনের আশ্বাস পেয়ে তাঁরা ঘর-বাড়িতে ছিলেন৷ তারপরও তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ায় তাঁরা সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন৷ এ সময় আগুনে পুড়ে গুনমালা চাকমা নামে এক বৃদ্ধ নারী মারা গেছেন বলে জানান তিনি৷
জনসংহতিসমিতির লংগদু উপজেলার সাধারণ সম্পাদক মনি শংকর চাকমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা তিনশ’রও বেশি হবে৷ চারটি পাড়ার প্রায় সব বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷’’
তিনি দাবি করেন, গুণমালা চাকমা নিহত হওয়া ছাড়াও আরো দু’জন নিখোঁজ রয়েছেন৷
লংগদু থানার ওসি মো. মোমিনুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সকাল ১০টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত এই হামলা ও আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে৷ ভাড়াটে মোটর সাইকেল চালকরা পাশের গ্রাম থেকে এসে এই হামলা এবং ভাংচুর চালায়৷’’
Oc Momonul Islasm - MP3-Stereo
তিনি বলেন, ‘‘নিহত নুরুল ইসলাম যুবলীগ নেতা হলেও তিনি পেশায় একজন ভাড়াটে মোটর সাইকেল চালক৷ তার সহকর্মীরাই নাশকতা চালিয়েছে৷’’ তবে ওসি এক নারীর মৃত্যুর খবর সত্য নয় বলে দাবি করেছেন৷
এদিকে ওই এলাকার আদিবাসীরা ভয়ে অন্যত্র চলে গেছেন৷তাঁরা আবারও হামলার আশঙ্কা করছেন৷ স্থানীয় সাংবাদিক জিয়াউল হক জিয়া জানান, ‘‘এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করায় লোকজন রাস্তাঘাটে তেমন নেই৷ পরিস্থিতি থমথমে৷ অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে৷’’
ওসি আদিবাসীদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘‘তাঁদের ঘর-বাড়ি সব পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ থাকবে কোথায়? তাই তাঁরা পাশের গ্রামে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে চলে গেছেন৷’’
ভূমিপুত্রদের আত্মত্যাগ, ঘরহারা শত পরিবার
৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের সংঘর্ষ থামাতে গুলি চালায় পুলিশ৷ এতে তিন সাঁওতাল নিহত হন, আহত হন অনেকে৷ সেখানে গিয়ে ছবি তুলে এনেছেন খোকন সিং৷
ছবি: bdnews24.com
ঘটনার সূত্রপাত
৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের সংঘর্ষ থামাতে গুলি চালায় পুলিশ৷ এতে তিন সাঁওতাল নিহত হন, আহত হন অনেকে৷ নিহতরা হলেন শ্যামল হেমব্রম, মংগল মান্ডি, রমেশ টুডু৷
ছবি: bdnews24.com
ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গুলি
সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের উপর গুলির নির্দেশ কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটরা দিয়েছিলেন বলে স্থানীয় থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন৷ সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়৷ তাদের ঘরে আগুন দেয়া হয় পুলিশের উপস্থিতিতেই৷
ছবি: bdnews24.com
উচ্ছেদ অভিযান
পরে পুলিশ-র্যাব ঐ দিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এক অভিযান চালিয়ে মিলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে৷
ছবি: DW/K. Singha
বিক্ষোভের ঝড়
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর গুলিবর্ষণের এই ঘটনায় সমালোচনা চলছে দেশজুড়ে৷ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে৷
ছবি: DW/K. Singha
ট্র্যাক্টর দিয়ে চিহ্ন মুছে দেয়া
একচালা ঘরগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার পর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ট্র্যাক্টর দিয়ে মাটি সমান করে দিয়েছে৷ নির্যাতিত শালনি মুর্ম ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন পুড়ে যাওয়া ভিটা, মসজিদ, গির্জাঘর, মন্দির, ভূমি রক্ষা কমিটির অফিস ঘর৷ যেগুলোর চিহ্ন ট্র্যাক্টর চালিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে৷
ছবি: DW/K. Singha
ইতিহাস
সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল৷ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা ওই জমিতে কয়েকশ’ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস করে আসছিল কয়েক বছর ধরে৷ চিনিকল কর্তৃপক্ষ ওই জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে৷
ছবি: DW/K. Singha
খোলা আকাশের নীচে কয়েকশ’ পরিবার
চোখে মুখে অজানা আতঙ্ক নিয়ে এখনও খোলা আকাশের নীচে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন৷ ক্যাথলিক মিশন ভিত্তিক সংগঠন ‘মাদার টেরেসা’ তিন কেজি করে চাল, আধা কেজি ভোজ্য তেল, এক কেজি করে আলু সরবরাহ করেছেন ক্ষুদ্র পরিসরে৷ প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল৷
ছবি: DW/K. Singha
ত্রাণ নিতে অস্বীকৃতি
উচ্ছেদ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য দেওয়া সরকারি ত্রাণ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন মাদারপুর ও জয়পুর পল্লীর সাঁওতালরা৷
ছবি: DW/K. Singha
আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ১৩ নভেম্বর সাঁওতাল পল্লী পরিদর্শন করে ৬ নভেম্বরের ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আশ্বাস দিয়েছে৷ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের উপর হামলায় ইন্ধন দেওয়ার জন্য স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদ ও সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
চার সাঁওতাল গ্রেপ্তার
সংঘর্ষের পর গোবিন্দগঞ্জ থানার পুলিশ এ ঘটনায় দু’টি মামলা করে৷ গ্রেপ্তার করা হয় চার সাঁওতালকে৷ রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন সাঁওতালদের কোমরে দড়ি ও হাতকড়া পরানো নিয়ে গণমাধ্যমে খবর আসার পর হাইকোর্টে রিট আবেদনটি হয়৷ হাইকোর্টের নির্দেশের পর পুলিশ সাংবাদিকদের দেখলে হাতকড়া খুলে দেয়, সাংবাদিকরা চলে গেলে ফের হাতকড়া লাগিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা৷
ছবি: DW/K. Singha
সাঁওতালদের দাবি
সাঁওতালরা উচ্ছেদকৃত জমিতেই পুনর্বাসন, জমির চার পাশ থেকে চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাঁটাতারের বেড়া অপসারণ, আখ চাষ বন্ধ ও তাদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে৷ এছাড়াও এমপি আজাদ ও ইউপি চেয়ারম্যান বুলবুলসহ তাদের উচ্ছেদ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটে সহযোগিতাকারীদের বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে সাঁওতালরা৷