রাঙামাটির লংগদুতে এক যুবলীগ নেতার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঘটেছে তাণ্ডব৷ আদিবাসীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, হয়েছে ভাঙচুর৷ কিন্তু এই খবর প্রকাশ করতে গিয়ে গণমাধ্যমের একাংশ করেছে এক বড় ভুল৷
বিজ্ঞাপন
অগ্নিকাণ্ডের খবরের সঙ্গে ছবি দিতে পারলে খবরটির গুরুত্ব যে বেড়ে যায় তা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই৷ আর মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো স্বাভাবিকভাবেই চাইবে বড় খবরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছবি প্রকাশ করতে৷ লংগদু'র ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে৷ আদিবাসীদের উপর আক্রমণের খবর বড় করে প্রকাশ করা হয়েছে, সঙ্গে প্রকাশ করা হয়েছে আগুন লাগা একটি স্থানের ছবি৷
রিপোর্ট এবং ছবি দু'টো একসঙ্গে দেখলে মনে হবে পরিস্থিতি ভয়াবহ৷ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সবকিছু৷ পরিস্থিতি সত্যিই হয়ত ভয়াবহ সেখানে৷ কিন্তু সেই ভয়াবহতা ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে দৈনিক প্রথম আলো (ইংরেজি সংস্করণ), ইত্তেফাক, সমকাল, যুগান্তরসহ কয়েকটি মূলধারার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা প্রকাশ করেছে পুরনো একটি ছবি, যেটির সঙ্গে লংগদুর ঘটনার কোনো সম্পর্কই নেই৷ প্রশ্ন হচ্ছে, পত্রিকাগুলো এমন ভুল কিভাবে করলো?
আসলে, আলোচিত ছবিটি শুক্রবার ফেসবুকে লংগদুর ছবি হিসেবেই ঘোরাঘুরি করছিল৷ কেউ কেউ যদিও ফেসবুকে লিখেছেন যে, ছবিটি পুরনো, ২০১৬ সালে টঙ্গীতে বয়লার বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ছবি৷ কিন্তু সেটা হয়ত সংশ্লিষ্ট পত্রিকার ফটো এডিটরদের কান অবধি পৌঁছায়নি৷ অথচ একটু সচেতন হলেই বিষয়টি এড়ানো যেতো৷
একটি ছবি ঠিক কবে, কিভাবে ইন্টারনেটে প্রকাশ হয়েছে সেটি জানার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ৷ সাধারণ টেক্সট সার্চ করার মতো এই অপশনটিও সকলের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত৷ যা করতে হয়, তা হচ্ছে, টেক্সটের বদলে যে ছবিটি সম্পর্কে আপনি জানতে আগ্রহী, সেটি সার্চ অপশনে আপলোড করা বা সেটির লিংক দিয়ে দেয়া৷ এরপর গুগল সেই ছবিটি কোথায়, কবে ব্যবহার করা হয়েছে তার লিংক প্রকাশ করে৷ সেসব লিংক একটু ঘাটলেই পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় যে, ছবিটি কোন ঘটনার এবং কখন তোলা হয়ে থাকতে পারে৷
ভূমিপুত্রদের আত্মত্যাগ, ঘরহারা শত পরিবার
৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের সংঘর্ষ থামাতে গুলি চালায় পুলিশ৷ এতে তিন সাঁওতাল নিহত হন, আহত হন অনেকে৷ সেখানে গিয়ে ছবি তুলে এনেছেন খোকন সিং৷
ছবি: bdnews24.com
ঘটনার সূত্রপাত
৬ নভেম্বর রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের বিরোধপূর্ণ জমি নিয়ে চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও সাঁওতালদের সংঘর্ষ থামাতে গুলি চালায় পুলিশ৷ এতে তিন সাঁওতাল নিহত হন, আহত হন অনেকে৷ নিহতরা হলেন শ্যামল হেমব্রম, মংগল মান্ডি, রমেশ টুডু৷
ছবি: bdnews24.com
ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে গুলি
সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের উপর গুলির নির্দেশ কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটরা দিয়েছিলেন বলে স্থানীয় থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন৷ সংঘর্ষের সময় সাঁওতালদের বাড়িঘরে লুটপাট হয়৷ তাদের ঘরে আগুন দেয়া হয় পুলিশের উপস্থিতিতেই৷
ছবি: bdnews24.com
উচ্ছেদ অভিযান
পরে পুলিশ-র্যাব ঐ দিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এক অভিযান চালিয়ে মিলের জমি থেকে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে৷
ছবি: DW/K. Singha
বিক্ষোভের ঝড়
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর গুলিবর্ষণের এই ঘটনায় সমালোচনা চলছে দেশজুড়ে৷ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে৷
ছবি: DW/K. Singha
ট্র্যাক্টর দিয়ে চিহ্ন মুছে দেয়া
একচালা ঘরগুলো পুড়িয়ে দেওয়ার পর চিনিকল কর্তৃপক্ষ ট্র্যাক্টর দিয়ে মাটি সমান করে দিয়েছে৷ নির্যাতিত শালনি মুর্ম ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন পুড়ে যাওয়া ভিটা, মসজিদ, গির্জাঘর, মন্দির, ভূমি রক্ষা কমিটির অফিস ঘর৷ যেগুলোর চিহ্ন ট্র্যাক্টর চালিয়ে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে৷
ছবি: DW/K. Singha
ইতিহাস
সাঁওতাল ও বাঙালিদের ১৮টি গ্রামের ১ হাজার ৮৪০ দশমিক ৩০ একর জমি ১৯৬২ সালে অধিগ্রহণ করে চিনিকল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার গড়ে তুলেছিল৷ চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা ওই জমিতে কয়েকশ’ ঘর তুলে সাঁওতালরা বসবাস করে আসছিল কয়েক বছর ধরে৷ চিনিকল কর্তৃপক্ষ ওই জমি উদ্ধার করতে গেলে সংঘর্ষ বাঁধে৷
ছবি: DW/K. Singha
খোলা আকাশের নীচে কয়েকশ’ পরিবার
চোখে মুখে অজানা আতঙ্ক নিয়ে এখনও খোলা আকাশের নীচে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন৷ ক্যাথলিক মিশন ভিত্তিক সংগঠন ‘মাদার টেরেসা’ তিন কেজি করে চাল, আধা কেজি ভোজ্য তেল, এক কেজি করে আলু সরবরাহ করেছেন ক্ষুদ্র পরিসরে৷ প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল৷
ছবি: DW/K. Singha
ত্রাণ নিতে অস্বীকৃতি
উচ্ছেদ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য দেওয়া সরকারি ত্রাণ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন মাদারপুর ও জয়পুর পল্লীর সাঁওতালরা৷
ছবি: DW/K. Singha
আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল ১৩ নভেম্বর সাঁওতাল পল্লী পরিদর্শন করে ৬ নভেম্বরের ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তির আশ্বাস দিয়েছে৷ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের উপর হামলায় ইন্ধন দেওয়ার জন্য স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদ ও সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
চার সাঁওতাল গ্রেপ্তার
সংঘর্ষের পর গোবিন্দগঞ্জ থানার পুলিশ এ ঘটনায় দু’টি মামলা করে৷ গ্রেপ্তার করা হয় চার সাঁওতালকে৷ রংপুর মেডিকেলে চিকিৎসাধীন সাঁওতালদের কোমরে দড়ি ও হাতকড়া পরানো নিয়ে গণমাধ্যমে খবর আসার পর হাইকোর্টে রিট আবেদনটি হয়৷ হাইকোর্টের নির্দেশের পর পুলিশ সাংবাদিকদের দেখলে হাতকড়া খুলে দেয়, সাংবাদিকরা চলে গেলে ফের হাতকড়া লাগিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনরা৷
ছবি: DW/K. Singha
সাঁওতালদের দাবি
সাঁওতালরা উচ্ছেদকৃত জমিতেই পুনর্বাসন, জমির চার পাশ থেকে চিনিকল কর্তৃপক্ষের কাঁটাতারের বেড়া অপসারণ, আখ চাষ বন্ধ ও তাদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে৷ এছাড়াও এমপি আজাদ ও ইউপি চেয়ারম্যান বুলবুলসহ তাদের উচ্ছেদ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটে সহযোগিতাকারীদের বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে সাঁওতালরা৷
ছবি: DW/K. Singha
11 ছবি1 | 11
টঙ্গীর বয়লার বিস্ফোরণের ছবিটি গুগলে কেউ সার্চ করলেই জানতে পারতো যে এটির সঙ্গে লংগদুর কোনো সম্পর্ক নেই৷ কিন্তু সেটা কেন করা হয়নি তা-ই এক বড় বিস্ময়৷ আর এই বিস্ময়কে রাজনৈতিক রূপ দিতে কেউ কেউ দাবি করেছেন, বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে ইচ্ছাকৃতভাবে মিডিয়া লংগদু নিয়ে অপপ্রচার চালিয়েছে৷
সংবাদমাধ্যম আসলেই এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে কিনা সেই আলোচনা এই ব্লগে না করে বরং জানিয়ে রাখি, পশ্চিমা বিশ্বে এখন ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধ এক বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এজন্য সাংবাদিকদের সংবাদ, ছবি এবং ভিডিও'র সত্যতা যাচাইয়ের বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়৷ বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেরও এটা করা উচিত বলে আমার মনে হয়৷
শেষ করার আগে, ছবির সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে আরো দু'টি প্রয়োজনীয় ওয়েবসাইটের কথা জানিয়ে রাখি৷ এগুলো হচ্ছে টিন আই রিভার্স ইমেজ সার্চ এবং ফটোফরেনসিক ৷ টিন আই অনেকটা গুগলের মতোই কাজ করে, তবে মাঝেমাঝে সাইটটিতে অনেক ছবির সন্ধান পাওয়া যায়, যা গুগলে নেই৷ আর ফটোফরেনসিক একটি ছবি সম্পাদনা করা হয়েছে কিনা কিংবা সেটা কতটা পুরনো, তা জানাতে বেশ সহায়ক৷ এই তিনটি টুল সম্পর্কে ফটো এডিটরদের অবশ্যই জানা উচিত৷
ছবির সত্যতা যাচাই নিয়ে আপনার কি কোনো প্রশ্ন আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷