অনেকে আশা করেছিলেন যে লকডাউন পৃথিবীকে স্তব্ধ করলে তা দূষণ থেকে কিছুটা মুক্তি দেবে পরিবেশকে৷ কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন যে এমনটা হয়নি৷
বিজ্ঞাপন
২০১৯ সালে আবহাওয়ায় কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা নতুন মাত্রা ছোঁয়, যা ২০২০ সালেও অপরিবর্তিত থেকেছে৷ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বা ডাব্লিউএমও জানাচ্ছে যে করোনাকালীন লকডাউন এই বাড়তি দূষণকে কমাতে কোনো ভূমিকা রাখেনি৷
কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড গত বছরে রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছয়৷ বাতাসে প্রতি দশ লাখ ভাগের ৪১০ দশমিক পাঁচ শতাংশই কার্বন ডাই অক্সাইড, যা অন্যান্য বছরের তুলনায় এমনকি গত দশকের বার্ষিক বৃদ্ধির হারের তুলনায়ও বেশি৷
জলবায়ু পরিবর্তন: পালটে যাচ্ছে নদীও
কেবল খাবার পানি নয়, অন্য নানা কাজেই নদীর ওপর নির্ভর করতে হয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে৷ কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ এই জল সরবরাহ প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দিচ্ছে৷
ছবি: AFP/Rammb/Noaa/Nesdis
পানির অপর নাম...
বিশ্বের মোট জলের বেশিরভাগই রয়েছে সমুদ্রে৷ মোট জলের কেবল ১০০ ভাগের এক ভাগ নদী দিয়ে বয়ে যায়৷ কিন্তু এই নদীগুলো ছাড়া ভূপৃষ্ঠে মিষ্টি পানি অন্যসব উৎস, যেমন হ্রদ ও জলাভূমি শুকিয়ে যাবে৷ এরই মধ্যে এমন আলামত দেখা যেতে শুরু করেছে৷ কেবল মানবজাতি নয়, প্রাণিজগত ও উদ্ভিদজগতেও পড়ছে এর প্রভাব৷
ছবি: picture-alliance/APA/B. Gindl
দশকের পর দশক
ওপরে আফ্রিকার শাড হ্রদের ১৯৬৩, ১৯৭৩, ১৯৮৭ এবং ১৯৯৭ সালের ছবি দেখানো হয়েছে৷ দেখা যাচ্ছে, মাত্র ৬০ বছরে হ্রদটির আকার ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার থেকে কমে দুই হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও নীচে নেমে এসেছে৷ দীর্ঘদিন ধরে এর জন্য বাঁধ ও সেচব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়েছে৷ কিন্তু গবেষকরা জানতে পেরেছেন, এই অঞ্চলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নদী কোমাদুগুর জলও ধীরে ধীরে তাপমাত্রার ওঠানামার কারণে কমে এসেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/NASA
জীববৈচিত্র্য এবং খাদ্য সংকট
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষ কিভাবে বাধ্য হচ্ছে খাদ্য ও জলের নতুন উৎস খুঁজে নিতে, শাড হ্রদ তার অন্যতম উদাহরণ৷ কৃষক এবং পশু খামারের মালিকেরা জলের জন্য ধীরে ধীরে উর্বর জমির সন্ধানে যাচ্ছেন৷ কিন্তু উর্বর জমি কমে যাওয়ায় অঞ্চলটিতে জমি নিয়ে উত্তেজনাও দেখা দিয়েছে৷ অন্য বিভিন্ন মহাদেশেও অত্যধিক গরমে নদীর জল শুকিয়ে যাওয়া এবং মাছ মরে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/R. F. Bukaty
ইউরোপেও তাপদাহ
২০১৮ সালের গ্রীষ্মে তাপদাহ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, খরস্রোতা রাইন নদীর জল শুকিয়ে খালের আকার ধারণ করে৷ তাপমাত্রা একসময় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছাড়িয়ে যায়৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ মালামাল পরিবহনে রাইন নদীর ওপর নির্ভর করে৷ কিন্তু এক পর্যায়ে প্রশস্ত এ নদী এতটাই অগভীর হয়ে পড়ে যে, কেবল একটি লেন চলাচলের জন্য চালু রাখা সম্ভব হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gambarini
গলে যাচ্ছে হিমবাহ
পানীয় জলের নির্ভরযোগ্য উৎসগুলোও হুমকির মুখে৷ বিভিন্ন পর্বতমালায় জমে থাকা হিমবাহকে জলের আধার মনে করা হয়৷ শীতকালে প্রচুর জল বরফ আকারে জমিয়ে রাখে হিমবাহগুলো৷ গ্রীষ্মকালে সে বরফ গলেই বিভিন্ন নদীতে জল যায়৷ হিমবাহগুলো অন্তত ২০০ কোটি মানুষের জল সরবরাহ করে৷ কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন হিমবাহে বরফ কমতে শুরু করেছে৷ বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ শতাব্দীর শেষের দিকে হিমালয়ের তিন ভাগের এক ভাগ বরফ একেবারে গলে যাবে৷
ছবি: DW/Catherine Davison
হিমালয় ও দক্ষিণ এশিয়া
সিন্ধু অববাহিকার কৃষকেরা বিভিন্ন শস্য চাষের জন্য হিমালয়ের বরফ গলা পানির ওপর নির্ভর করেন৷ পুরো অঞ্চলটি সুপেয় জল ছাড়াও সেচ, মাছ ও পরিবহনের জন্য অনেকাংশেই নির্ভর করে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ওপর৷ এই তিন অববাহিকা দক্ষিণ এশিয়ার অন্তত ১৩ কোটি কৃষক ও ৯০ কোটি বাসিন্দার জলের জোগান দেয়৷
ছবি: Imago/Aurora
দাবানল
ছবিতে দেখানো অস্ট্রেলিয়ার দাবানলের মতো সম্প্রতি অনেক ভয়াবহ দাবানল দেখেছে বিশ্ব৷ জলবায়ু পরিবর্তনের আরেক দিক এটি৷ দাবানল নদীও ক্ষতি করছে৷ অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে গাছ পুড়ে ছাই পড়ছে মারে-ডার্লিং অববাহিকার নদীতে৷ এর ফলে নদীর জল দূষিত হচ্ছে৷ এতে কেবল নদীর জলের ওপর নির্ভরশীল ২৬ লাখ মানুষ নয়, অনেক প্রজাতির প্রাণীও পড়েছে হুমকির মুখে৷
ছবি: Reuters/Maxar Technologies
শ্যাওলা এবং ডেড জোন
কেবল দাবানলের ছাইই যে নদীর ক্ষতি করে, এমনও না৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অতিবৃষ্টির ফলে নানা কারখানার বর্জ্য আরো দ্রুত নদী হয়ে সাগরে গিয়ে পড়ছে৷ এর ফলে নিউ ইয়র্ক উপকূলের মতো বিশাল এলাকা জুড়ে শ্যাওলা জন্মে সেখানকার জীববৈচিত্র্যে প্রভাব ফেলছে৷ কোনো কোনো স্থানে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ডেড জোনের সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/NASA
বৃষ্টি বেশি মানেই সুখবর নয়
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া মিসিসিপি নদীতে নাইট্রোজেন দূষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে৷ অতিবৃষ্টির ফলে আরো বেশি বর্জ্য ও নাইট্রোজেন জমা হচ্ছে নদীর জলে৷ একই সঙ্গে বন্যা ও সংখ্যায় ক্রমশ বাড়তে থাকা হারিকেনও ফেলছে প্রভাব৷
২০১৫ সাল থেকে ক্রমাগত এই কার্বন বৃদ্ধির হার চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে বলে মনে করেন ডাব্লিউএমও সেক্রেটারি জেনারেল প্রফেসার পেটেরি টালাস৷ তিনি বলেন, ‘‘ইতিহাসে এমন বৃদ্ধির হার অভূতপূর্ব, যার কোনো নজির আমাদের কাছে নেই৷''
লকডাউনের প্রভাব নিমিত্তমাত্র
করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ে সব ধরনের যান চলাচল৷ বন্ধ হয়ে পড়ে বিমান চলাচলও৷ ডাব্লিউএমওর বার্ষিক বুলেটিনে প্রকাশিত তথ্য বলছে, অতিমারি নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি বাড়ালে দৈনিক কার্বন নিঃসরণের হার আগের বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ কমে আসে৷ কিন্তু তাতে আত্মতুষ্টির কোনো জায়গা নেই, বলে জানাচ্ছে তারা৷ ডাব্লিউএমও বলছে, এই একই সময়ে বিভিন্ন ফ্যাক্টরি ও কারখানায় উৎপাদনের হারে কমলেও তার কোনো প্রভাব বিশ্বের সার্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে পড়েনি৷
শিল্পক্ষেত্রে কম উৎপাদন হবার প্রভাব বার্ষিক কার্বন নিঃসরণকে ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে সাড়ে সাত শতাংশ কমিয়ে আনবে বলে আশা করা হয়েছিল৷ কিন্তু ডাব্লিউএমও জানাচ্ছে, তা হলেও বাতাসে জমা কার্বনের বিপজ্জনক হারে কোনো পরিবর্তন আসবে না৷
যদিও ২০২০ সালের সম্পূর্ণ তথ্য-পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি, তবে টাসমানিয়া ও হাওয়াইতে অবস্থিত পরিবেশ পরীক্ষাগার থেকে প্রাপ্ত প্রাথমিক তথ্য জানাচ্ছে যে বাতাসে জমাটবাঁধা কার্বনের মাত্রায় কোনো পরিবর্তন এখনও নেই৷
এসএস/কেএম (রয়টার্স, এএফপি, ডিপিএ)
মানুষ কমলে কী উপকার?
এল পাসিনো আর ক্রাইস্টচার্চের দুই সন্ত্রাসী হত্যাযজ্ঞ শুরুর আগে বলেছিল, বিশ্বে মানুষ কম থাকাই ভালো৷ এক গবেষণা বলছে, মানুষ সত্যিই কমবে, একসময় অর্ধেক হয়ে যাবে জাপান আর স্পেনের জনসংখ্যা৷ কিন্তু মানুষ কমলে আসলে কী উপকার?
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eisele
জন্মদানের ক্ষমতা কমছে
বিশ্বে বয়স্ক মানুষ বাড়ছে আর কমে যাচ্ছে উর্বরতা শক্তি, অর্থাৎ সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা৷ বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ল্যান্সেটে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র বলছে, একুশ শতকের শেষ দিকে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জনসংখ্যা কমবে৷তখন জনসংখ্যাবিস্ফোরণ নিয়ে আতঙ্কের স্থান নেবে একটি প্রশ্ন- নতুন প্রজন্ম আসবে কিভাবে?
ছবি: Imago/photothek/U. Grabowsky
৯৭০ কোটি থেকে কমার শুরু
ইন্সটিটিউট ফর হেল্থ মেট্রিস অ্যান্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএমই)-র গবেষণা অনুযায়ী, আগামী চার দশকের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাবে৷ তাই বিশ্বের জনসংখ্যা ৯৭০ কোটিতে পৌঁছে যাবে৷ তারপরই কমতে শুরু করবে মানুষ, এক পর্যায়ে জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৮৮০ কোটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Koch
স্পেন আর জাপান অর্ধেক
গবেষণাটি আরো বলছে, ৮০ বছরের মধ্যে স্পেন আর জাপানের জনসংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে যাবে৷ চীনের জনসংখ্যাও এত কমবে যে, ভারত আর নাইজেরিয়া হয়ে যাবে সবচেয়ে জনবহুল দেশ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Barrientos
স্বাভাবিক ধারায় মাত্র ১২টি দেশ
সোমালিয়া, সাউথ সুদানসহ মাত্র ১২টি দেশে তখন শিশুজন্মের হার স্বাভাবিক থাকবে৷ বাকি সব দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়বে আশঙ্কাজনক হারে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Abdiwahab
সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কা
সারা বিশ্বে শিক্ষার হার বর্তমান ধারায় বাড়তে থাকলে এবং জন্মনিরোধক ঘরে ঘরে পৌঁছে গেলে ২১০০ সালে সারা বিশ্বে জনসংখ্যা ১৫০ কোটি কমে যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Lage
কমলেই লাভ?
মানুষের সংখ্যা কমলে কার্বন নিঃসরণ কমবে, কমবে সারা বিশ্বের খাদ্যের ওপর চাপ ৷ তবে সব মানুষ সমান হারে কার্বন নিঃসরণ করে না৷ তাই হ্যারিসবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষক অরবিন্দ রবিকুমার মনে করেন, মানুষ কমলে জলবায়ুর কল্যাণ হবে এমন ধারণা একেবারেই কাল্পনিক৷
ছবি: Getty Images/AFP/Stringer
জনসংখ্যা কমার অন্ধকার অতীত
জনসংখ্যা কমানো বা নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ অনেক সময় অনেক দেশেই নেয়া হয়েছে৷ বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডায় আদিবাসী নারীদের স্টেরিলাইজ করা হয়৷৷ ১৯৭৬ সালে দাতা গোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ী, একইভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছিল ভারত৷ তখন ৬২ লাখ মানুষকে স্টেরিলাইজ করেছিল ইন্দিরা গান্ধী সরকার৷ চীনেও এই প্রক্রিয়া অবলম্বনের অভিযোগ রয়েছে৷