লকডাউনের প্রথম আট দিনে ঢাকায় পাঁচ হাজারের বেশি লোক গ্রেপ্তার হয়েছে৷ জরিমানা করা হয়েছে প্রায় সম পরিমাণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে৷ তারপরও মানুষ বাইরে বের হচ্ছেন৷ আর যারা জরিমানার শিকার হচ্ছেন তাদের অধিকাংশই গরিব মানুষ৷
বিজ্ঞাপন
গত ১ জুলাই থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে কঠোর লকডাউন শুরু হয়৷ শেষ হবে ১৪ জুলাই৷ করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এই কঠোর লকডাউনে যায় প্রশাসন৷ এরইমধ্যে ২৪ ঘন্টায় মৃত্যু ২০০ ছাড়িয়েছে৷ এই পরস্থিতিতে টেকনিক্যাল কমিটি এই লকডাউনের পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে৷ তারা নতুনভাবে কার্ফ্যু জারির সুপারিশ করেছে৷
লকডাউন কার্যকর করতে চার ধরনের আইন ব্যবহার করা হচ্ছে৷ সংক্রামক ব্যাধি আইন, মোটর যান আইন, ডিএমপি অ্যাক্ট এবং মোবাইল কোর্ট৷ সেনা, পুলিশ ও র্যাবের সাথে ৫০টিরও বেশি মোবাইল কোর্ট কাজ করছে৷ আর রাজধানীর প্রবেশ পথ ছাড়াও শহর জুড়ে শতাধিক চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে৷
প্রথম আট দিনে লকডাউনের নির্দেশ অমান্য করে বাইরে বের হওয়ার অভিযোগে মোট চার হাজার ৩৬৭ জনকে জরিমানা করা হয়েছে৷ আটক করা হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৭৪ জনকে৷ এই সময়ে জরিমানা করা হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টাকা৷ শতাধিক প্রতিষ্ঠানকেও জরিমানা করা হয়েছে৷
যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষ৷ তারাও আদালত থেকে জরিমানা দিয়ে ছাড়া পাচ্ছেন৷ তাদেরকে আদালত সর্বোচ্চ ১০০ টাকা জরিমানা করছে৷
এই লকডাউনে জরুরি সেবা ও রিকশা চালু আছে৷ কিন্তু যারা শ্রমজীবী মানুষ দিন আনে দিন খান তাদের কোনো উপায় নেই৷ বিশেষ করে ভাসমান মানুষ এবং দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে যারা কাজ করেন তারা অসহায় অবস্থার মধ্যে আছেন৷ আর যারা ক্ষুদ্র ও ভাসমান দেকানদার তারাও বিপাকে আছেন৷ ৩৩৩-তেও ফোন করে তারা সহায়তা পাচ্ছেন না৷ আবার অনেকে জানেনই না যে ওই নাম্বারে ফোন করলে সহায়তা পাওয়া যায়৷ তারাই মূলত কাজের জন্য বা সহায়তার জন্য বাইরে বের হয়ে জরিমানা ও গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হচ্ছেন৷ মানবাধিকার কর্মী নূর খান গত কয়েকদিন ধরে আদালত পাড়ায় যাচ্ছেন ওইসব মানুষের সাথে কথা বলতে৷ তিনি জানান," যারা আটক হচ্ছেন তাদের ৯৯ ভাগই গরিব মানুষ৷ দিন আনে দিন খায়৷ তারা পেটের দায়ে বের হন৷ তবে অসচেতন থাকায় অনেকেই মাস্ক পরেন না৷” তিনি অভিযোগ করেন," প্রত্যেক থানা এলাকায় কোটা দেয়া আছে৷ সেই গ্রেপ্তারের কোটা পূরণ করা হচ্ছে৷”
ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট আদলতের পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু স্বীকার করেন, "যারা আটক হচেছন তাদের বড় একটি অংশ গরিব মানুষ৷ তবে এর বাইরেও আছেন৷ তারা আইন অমান্য করে নানা অজুহাতে বের হচ্ছেন৷ তাদের ডিএমপি অ্যাক্টে আটক করায় কারাগারে যেতে হচ্ছেনা৷ আদালত জরিমানা করে ছেড়ে দিচ্ছেন৷ তবে কেউ জরিমানা না দিতে পারলে কারাগারে যেতে হচ্ছে৷”
তবে তিনি অভিযোগ করেন," আটকদের প্রিজন ভ্যানে গাদাগাদি করে আদালতে নেয়া হচ্ছে৷ তাতে তাদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে৷ আমরাও বলেছি, আদালতও বলেছেন যে তাদের প্রিজন ভ্যানে সামাজিক দূরত্ব মেনে আদালতে নিতে হবে৷”
নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আব্দুল আউয়াল বলেন," যাদের আটক করা হচ্ছে তাদের বড় একটি অংশ মাস্ক না পরে বিনা কারণে বাইরে বের হন৷ এত কড়াকড়ির পরও তারা মাস্ক ব্যবহার করতে চাননা৷ সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই এই প্রবণতা৷ তাদের কোনো ভাবেই সচেতন করা যাচ্ছে না৷”
লকডাউনে মাদক:
করোনা এবং লকডাউনে ঢাকাসহ সারাদেশে মাদক ব্যবসা ও ব্যবহার বেড়ে গেছে৷ আর নতুন ধরনের মাদক ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে৷ সর্বশেষ ঢাকায় ‘ম্যাাজিক মাশরুম' নামে নতুন একটি মাদকসহ চক্রের সদস্য এবং ব্যবহারকারীদের আটক করেছে পুলিশ৷ পুলিশ জানায়, এখন মাদক ব্যবসায় অনলাইন ও কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এই ম্যাজিক মাশরুম দেশের বাইরে থেকে আনা হয়েছে৷ মাদক ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করছে৷ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন,"করোনা ও লকডাউনকে মাদক ব্যবসায়ীরা একটা সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে৷ আর ঘরে থেকে অবসাদগ্রস্ত হয়ে তরুণরা নতুন করে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন৷”
তার কথা, এব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও পরিবারের সদস্যরা নজর না দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে৷
আব্দুল্লাহ আবু
ঢাকার অলিগলিতে নেই লকডাউনের ছাপ
১ জুলাই থেকে সর্বাত্মক লকডাউনে ঢাকার প্রধান সড়কে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকলেও অলিগলিতে সাধারণ মানুষের চলাচল রয়েছে প্রায় স্বাভাবিক৷ প্রয়োজনে কিংবা অপ্রয়োজনে মানুষের ঘর থেকে বের হওয়া নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কোথায় লকডাউন?
মিরপুরের পীরেরবাগে মঙ্গলবার বিকাল পাঁচটার পর গিয়ে দেখা গেল, স্বাভাবিক দিনের মতোই রাস্তায় মানুষ গিজগিজ করছে৷ কোথাও সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই৷ প্রতিবেদককে দেখে এক পথচারী মন্তব্য করেন, ‘‘সরকারি ছাড়া বাকি সব অফিস আদালত খোলা৷ মানুষ বাসা থেকে বের না হলে কীভাবে হবে?’’ যদিও এই প্রতিবেদক অনেক পথচারীর সাথে কথা বলে জানতে পারেন, অনেকেই বাসা থেকে বিনা প্রয়োজনে অথবা তুচ্ছ প্রয়োজনে বের হয়েছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
চলছে ফুটবল খেলা দেখা
মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা এলাকায় গলির এক হোটেলে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে সকালের নাস্তা করে সবাই টেলিভিশনে ফুটবল খেলা দেখতে বসে গেছেন৷ কেন লকডাউনে এভাবে জটলা পাকিয়ে খেলা দেখছেন জানতে চাইলে কেউ কোনো উত্তর না দিয়েই চলে যান৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘কাম না করলে সরকার খাওয়াইব আমাগোরে?’
ঢাকার ফার্মগেট এলাকার পূর্ব রাজাবাজারে এক গলির ফুটপাথ ঘেঁষে বসেছেন জুতা মেরামতকারী আনন্দ দাস৷ লকডাউনে কেন দোকান খুলে বসেছেন জানতে চাইলে ক্ষোভের সুরে তিনি বলেন, ‘‘করোনা হইলে কী, আমাগো প্যাট তো থাইমা থাকে না৷ বড় স্যারেরা ঘরে বইয়া বেতন পায়, আমগো কেউ এমনে খাওন দিবো না, কাম কইরাই খাওন লাগবো৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শুনতে হয় কটু কথা
ঢাকার গ্রিনরোডের এক গলিতে টিসিবির পণ্য কিনতে ট্রাকের অপেক্ষা করতে দেখা গেল শতাধিক মানুষকে৷ কিন্তু সেখানে সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি তেমনভাবে না পাওয়ায় প্রতিবেদক ছবি তুলতে গেলে একজন মন্তব্য করেন, ‘‘এই যে রিপোর্টার আইসে নেগেটিভ নিউজ করতে৷ কামের কাম কিছু পারে না, এইসব দেখায়া দ্যাশের মানুষের ভাবমূর্তি নষ্ট করতাসে খালি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রতিটি গলির মুখে জটলা
ঢাকার মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়ার এক গলিতে বিকেলে গিয়ে দেখা গেল সেখানে কিছুদূর পরপর কয়েকজন করে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছেন৷ একই দৃশ্য দেখা গেল অন্যান্য গলিতেও৷ কেন বের হয়েছেন জানতে চাইলে একজন বলেন, ‘‘বাসায় আর কতো থাকবো? বিরক্ত হয়ে বাসা থেকে বের হইসি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সাংবাদিক দেখলেই ছুট
ঢাকার আগারগাঁও এলাকার ৬০ ফিটের একাধিক স্থানে তরুণদের পাওয়া গেল যারা কয়েকজন একসাথে বসে মোবাইলে গেম খেলছেন৷ ছবি তুলতে দেখা মাত্র সবাই যে যার মতো ছুটে পালান৷ কথা বলার জন্য ডাকলেও কাউকে পাওয়া যায়নি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মুদি দোকানিদের গুরুতর অভিযোগ
ঢাকার ফার্মগেট এলাকার পূর্ব রাজাবাজারের প্লাজা সুপার স্টোরের স্বত্বাধিকারী আব্দুল মতিন বলেন, সরকার লকডাউনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা রাখার অনুমতি দিলেও তারা সেটা পারছেন না৷ গত ২ জুলাই দোকান খোলা রাখার অপরাধে দুপুরে তার এক কর্মচারীকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ৷ কেন প্রতিবাদ করেননি জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু বললেই মার খেতে হবে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কেনাকাটার শেষ নেই
ঢাকার মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়া এলাকার এক গলিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সন্ধ্যার পরেও ভ্যানে করে বেচাকেনা চলছে৷ কেন এখনো দোকান খোলা জানতে চাইলে বিক্রেতা জানান, মানুষ টুকটাক কিনতে আসছে তাই তিনিও দোকান খোলা রেখেছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
টং দোকানে চিরচেনা ভিড়
ঢাকার খামারবাড়ি এলাকার একটি পার্শ্বরাস্তায় বেশ কয়েকটি চায়ের টং দোকান খোলা রাখতে দেখা যায়৷ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে দেখা যায় খোশমেজাজে বসে চা খাচ্ছেন৷ অনেকের মাস্ক থুতনিতে, আবার কারো মাস্কই নেই৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘হাঁটতে বের হয়েছি’
ঢাকার ফার্মগেট এলাকার পূর্ব তেজতুরিবাজারের বাসিন্দা ব্যবসায়ী নুরুল আমিনকে কেন কঠোর লকডাউনে বের হয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি ডায়াবেটিসের রোগী তাই হাঁটতে বের হয়েছেন৷ বাসার ছাদেও তো হাঁটা যায়, এ কথা বলার পর তিনি জানান, সেখানে হাঁটার সুযোগ নেই৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের সাথে কথা বলে এবং সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাধারণ মানুষকে ঘরে কোনোভাবেই আটকে রাখা যাচ্ছে না, যে-কোনো অজুহাতে তারা বাসা থেকে বের হচ্ছেন৷ এই অবস্থা চলমান থাকলে সরকার যে উদ্দেশ্যে লকডাউন দিয়েছে তা কতটুকু সফল হবে সেটি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাড়ানো হয়েছে পুলিশের নজরদারি
সাধারণ মানুষকে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে না দিতে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ, এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার জসিমউদ্দিন মোল্লা বলেন, ‘‘অলিগলির জটলা সরানোর জন্য পুলিশ পেট্রলিং বাড়ানো হয়েছে৷’’ সরেজমিনে দেখা যায়, পুলিশ দেখলে অলিগলির জটলা কমে আসে কিন্তু তারা চলে গেলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় মানুষ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রধান সড়কেও বেড়েছে গাড়ির সংখ্যা
ঢাকার বেশ কয়েকটি প্রধান সড়ক ঘুরে এবং কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রধান সড়কসহ ছোটবড় সব সড়কে প্রতিদিনই গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে৷ এখন আর শুরুর দিকের মতো যান চলাচল আটকিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করাও সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্তব্যরত একজন ট্রাফিক সদস্য৷