করোনার প্রকোপে স্তব্ধ হয়ে আছে ভারতের বিনোদন জগত৷ সিনেমা, নাটক, খেলা থেকে সংগীত – কোনো পরিসরই মুক্তভাবে তার কাজ চালিয়ে যেতে পারছে না৷ কিন্তু ঘরে বসে বসেই সংগীতশিল্পীরা ফেসবুকের সাহায্যে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁদের শিল্প৷ মঞ্চের সাথে দর্শকাসনের মধ্যে কোনো ফারাক নেই সেখানে৷ ইন্টারনেটের বদৌলতে, শিল্পী-শিল্প-শ্রোতা সবাই লাইভে একাকার৷ কী ভাবে দেখছেন এই সময়টাকে শিল্পীরা?
বাংলা লোকগানের দল ‘দোহার’-এর তরুণ সদস্য সুদীপ্ত চক্রবর্তী গান গাওয়ার পাশাপাশি তালবাদ্যও বাজান৷ একাধিক ফেসবুক পেজের হয়ে গান শুনিয়েছেন তিনি ইতিমধ্যে৷ তিনি বলেন, ‘‘ফেসবুকে গান শোনানোর এই ধারায় গান শোনানো এখন খুব সহজ হয়ে যাচ্ছে৷ বড় বড় শিল্পীরা যে আবেগের জায়গা থেকে লাইভে এসে গান শোনাচ্ছেন, তা শ্রোতারা বুঝতে পারছেন না৷ আমরা জানি যে, করোনার কোপে অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, হবে৷ স্বাভাবিকভাবেই, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমলে গান-বাজনার অনুষ্ঠানের পেছনে খরচও কমবে৷ কে জানে, ভবিষ্যতে হয়তো কেউ সিনিয়র শিল্পীকেও বলে বসবেন কোনো সহযোগী শিল্পী ছাড়া একাই গাইতে আসতে৷ ওই যে, যেমনটা লাইভে শুনেছিলেন! মিউজিকের যে সার্বিকতা শিল্পীরা শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরতে চান, তা নষ্ট হচ্ছে, হবে৷’’
১৭ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সংগীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের একটি প্রতিবেদন৷ ‘বিনামূল্যে গান শোনাটাই অভ্যেস হয়ে যাবে না তো?’ – শিরোনামের প্রতিবেদনে শিল্পী তুলেছেন এই প্রশ্ন৷ ফেসবুকে লাইভ করে গান শোনাতে এলে শ্রোতারা প্রশংসা করছেন ঠিকই৷ কিন্তু শিল্পের মর্ম সেখানে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়৷ পাশাপাশি, সুদীপ্তর মতোই সেই প্রতিবেদনে লোপামুদ্রা তোলেন সংগীত জগতের সাথে জড়িত অসংখ্য সহযোগীর কথা, যারা সেভাবে মঞ্চে না উঠলেও আলো, ধ্বনি প্রক্ষেপণের মাধ্যমে শিল্পীকে সহায়তা করেন৷ তাদের রোজগারের প্রশ্ন লোপামুদ্রা তুলেছেন সেই প্রতিবেদনে৷ তিনি বলছেন তরুণ কর্মীদের কথা, যারা নিশ্চয়তা বাজি রেখে ভালোবাসার শিল্পের পথে এলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে অসহায়৷ কিন্তু তবুও তিনি সেই প্রতিবেদনে বলেন, ‘‘আমি ইতিবাচক মনের মানুষ৷ নানা অসুবিধার মধ্যেও তাই ভালো দিকটাই মাথায় আসছে৷ হাজার কাজের ব্যস্ততায় এমনিতে রেওয়াজের সময় কম পাই, তাই এখন মন দিয়ে রেওয়াজটা করছি৷ অন্যদের গান শুনছি৷ গান নিয়ে কে কী ভাবছেন সেটাও জানা দরকার৷’’
লোপামুদ্রা মিত্র
This browser does not support the audio element.
সংকটের পরিবেশে শ্রোতা-শিল্পী একাকার
ফেসবুকে গান গাওয়ার-শোনার এই ‘ট্রেন্ড’ শ্রোতার পরিসরকেও বাড়িয়ে তুলেছে৷ ব্যস্ততমশিল্পীর কাছেও এখন পৌঁছে দিচ্ছে গান শুনতে পারার ফুরসতটুকু৷ শুধু তাই নয়, শিল্পীদের গ্ল্যামার ছাড়াও মানবিক, সাংসারিক দিক স্পষ্ট হচ্ছে এই সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমেই৷
শিল্পের বাজার ও শিল্পীর সম্মান ছাড়াও কিছু শিল্পীদের কথায় উঠে আসে বর্তমানের অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে সংঘবদ্ধতার কথা৷ সংগীতশিল্পী ও গবেষক সাহানা বাজপেয়ী ফেসবুকের পাশাপাশি ইন্সটাগ্রামেও নিয়মিত লাইভে এসে তাঁর গুণমুগ্ধদের গান শুনিয়েছেন৷ এছাড়া, অন্য শিল্পীদের অনুষ্ঠান সঞ্চালনাও করছেন৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি অবস্থাতেও সরাসরি গান শোনানোর মধ্যে একটা ব্যক্তিগত ছোঁয়া আছে৷ আমার ঘর থেকে অন্যের ঘরে পৌঁছে যেতে পারার বিষয়টা আছে৷ দর্শকরা আমাদের ঘরের দেওয়াল, বইয়ের তাক, একেবারে নিজস্ব পরিসরের কাছাকাছি এসে পড়েন, যা এতদিন পারেননি৷ এই নৈকট্য আমাদের গান গাওয়া ও শোনা একদম বদলে দিতে পারে৷ এটা কোনো মঞ্চ নয়, যেখানে শিল্পী আলোকিত, অথচ শ্রোতারা অন্ধকারে, এখানে আমরা সবাই সবার ঠিক পাশেই রয়েছি৷’’
ছাদ, ব্যালকনি আর জানালায় একটুখানি স্বাধীন জীবন
দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষ এখন করোনির কারণে ঘরবন্দি। তবে থেমে নেই জীবন, থেমে নেই আনন্দ। বিভিন্ন দেশের ঘরের ছাদ, ব্যালকনি এবং জানালায় চোখ রাখলেও তা বোঝা যায়।
ছবি: Reuters/E. Marciscano
করোনামুক্তির প্রার্থনা
২১ দিনের লকডাউন চলছে ভারতে। আহমেদাবাদের এক হিন্দু পরিবার তাই নবরাত্রি উদযাপনের দিনে জানালার কাছেই প্রার্থনা করছে।
ছবি: Reuters/A. Dave
ব্যালকনিতে পিয়ানোচর্চা
ঘরে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়! বাইরে বেশ সুন্দর আবহাওয়া। তাই স্পেনের বার্সেলোনার এক বাসিন্দা ব্যালকনিতে বসে পড়লেন পিয়ানো নিয়ে।প্রতিবেশীদেরও ভালোই লেগেছে তার এই পিয়ানো চর্চা।
ছবি: Reuters/N. Doce
জানালা যখন গানের মঞ্চ
এমনিতে তার গান শুনতে হয় টিকিট কেটে। তবে হোম কোয়ারান্টাইনে থাকা ফরাসি এই শিল্পী এখন প্যারিসের ফ্লাটের জানালায় দাঁড়িয়ে বিনা টিকিটেই গান শোনান।
ছবি: Reuters/G. Fuentes
গিটার হাতে জানালায়
ক্যালিফোর্নিয়ায় নিজের ঘরের জানালায় বসে গিটার বাজিয়ে গান গাইছেন এক শিল্পী।
ছবি: Reuters/K. Munsch
কুকুর এবং তার মনিব
চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাহার জানালায় এক কুকুর ও তার মনিব।
ছবি: Reuters/D. W. Cerny
কিশোর স্যাক্সোফোন শিল্পী
ইটালির মিলান শহরের এই কিশোরের ঘরে আর মন বসছিল না, তাই বারান্দায় মনের আনন্দে শুরু করেছে স্যাক্সোফোন বাজানো।
ছবি: Reuters/D. Mascolo
প্রতিবেশীদের আনন্দ দিতে
হ্যাঁ, প্রতিবেশীদের আনন্দ দিতে ব্যালকনিতে গিটার বাজিয়ে গান ধরলেন পানামা সিটিরর এক তরুণী।
ছবি: Reuters/E. Marciscano
আরাম করে বই পড়া
নিউ ইয়র্কের এক বাড়ির ব্যালকনিতে আরাম করে বই পড়ছেন একজন।
ছবি: Reuters/L. Jackson
8 ছবি1 | 8
কী বলছেন শ্রোতারা?
বাড়িতে বন্দি থেকে থেকে শিল্পীদের মতো শ্রোতারাও অতিষ্ঠ, মনমরা৷ তাই বেশির ভাগ শিল্পীর ফেসবুকে গান যেন সঞ্জীবনী ওষুধের মতো৷ কমেন্টে লেখেন, ‘দুঃসময়ের নিরাময়’ বা ‘মন ভালো হয়ে যায়’৷ শিল্পীর প্রচেষ্টাকে বাহবা দেন৷ সব মন্তব্য অবশ্য এক রকম নয়৷ অনেক শ্রোতা লাইভ ভিডিওতে লেখেন, ‘‘দুনিয়ায় লোক মরে, আর তুই গান শুনাস?’’
এখন পর্যন্ত পাল্লায় ভারী গানের মধ্যে নিরাময় খোঁজা শ্রোতারাই৷ কিন্তু এই একই শ্রোতা ভবিষ্যতে সঠিক পারিশ্রমিক দিয়ে শিল্পীর শ্রমের মর্যাদা দেবেন কিনা, তা এই মুহূর্তে বলা অসম্ভব৷ শিল্পীদের ওপর দায়িত্ব কঠিন পরিস্থিতিকে তাঁদের শিল্পের সাহায্যে আরেকটু সহনীয় করে তোলার৷ শ্রোতার দায়িত্ব সেই মননের প্রতি আরেকটু শ্রদ্ধাশীল হওয়া৷
শিল্পীদের কেন টাকা নেই?
বাংলাদেশে শিল্পীরা সঙ্গীত জীবনের শেষ দিকে এসে পড়ছেন আর্থিক সঙ্কটে৷ তাদেরকে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে হয় শুভাকাঙ্খী অথবা সরকারের সহযোগিতা নিয়ে৷ কেন এই পরিস্থিতি, কী বলছেন সঙ্গীত শিল্পীরা? পড়ুন ছবিঘরে৷
ছবি: DW/Arafatul Islam
সাবিনা ইয়াসমিন
সঙ্গীতা বলেন, সাউন্ডটেক বলেন, এদের অ্যালবাম বিক্রির উপর কোনো ভাগ আমরা কোনোদিনও পাইনি৷ এককালীন একটা লামসাম দিয়ে দিতো৷ শিল্পীদের কোটি টাকা সবাই লুটেপুটে খাচ্ছে৷ কারা খাচ্ছে আমি জানি না৷ আমাদের আয়ের কিছুই নাই এখন৷ ইউটিউবে আমার হাজার হাজার গান আছে, কোনেকিছুই জানি না কারা আপলোড করছে৷ রয়্যালটির টাকা মেরেকেটে না খেলে কি আমাদের কারো কাছে হাত পাততে হয়?
ছবি: bdnews24.com
আসিফ আকবর
আমাদের দেশে কোন কপিরাইট সোসাইটি নাই, শিল্পীদের কোনো ঐক্য নাই৷ ৪৮ বছরেও আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি নাই যে কারণেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে৷ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে যে রিয়েলিটি শো হয়, বিভিন্ন এফ এম চ্যানেলে আমাদের গান বাজে সেখান থেকে শিল্পী, সুরকার, গীতিকারের ভাগটা কী, সেটা নিয়ে আমাদের কোন নীতিমালা নাই৷ যতদিন পর্যন্ত শিল্পীরা ঐক্যবদ্ধ না হবে ততদিন কোন সমাধান হবে না৷
ছবি: bdnews24
নকিব খান
প্রত্যেকটা শিল্পী শেষ বয়সে এসে কষ্ট পায় এবং চিকিৎসার জন্য যখন অর্থ দরকার হয় তখন দুস্থ শিল্পী হয়ে যায়৷ সব শিল্পীরা মিলে তাকে সাহায্য করতে হয়, এটা খুবই দুঃখজনক, করুণ একটা ব্যাপার, আমাদের শিল্পীদের খুবই কষ্টের একটি জায়গা৷ আমাদের সৃষ্ট গানের কিছুই আমরা পাই না৷ কোম্পানিগুলোতে যারা আছে তারা হয়তো কিছু আয় করছে৷ আমাদের পাশের দেশে ভারতে শিল্পীরা রয়্যালটি পায়, সেজন্য তাদের এতো অভাব থাকে না৷
ছবি: Sazzad Hossain
কুদ্দুস বয়াতী
আমাদের শিল্পীরা মরলে পরে শহীদ মিনারে নিয়া ফুলের মালা দেয়৷ থাকলে দেখে না, কেউ নাই৷ এটা এখন প্রমাণিত৷ আমাদের শিল্পীদের এখন আয় নাই৷ মোবাইল, ইউটিউবের জন্য এক একজন আসে (গান রেকর্ড) করে দুই-তিন হাজার টাকা দেয়৷ ক্যামেরা করে তারা রেখে দেয়, তারপর ইউটিউবে চালায়৷ আমাদের লোকশিল্পীরা খুব কষ্টের মধ্যে আছে৷ যন্ত্রশিল্পীরা স্টুডিওতে বাজিয়ে একটা গানের জন্য মাত্র দুই হাজার টাকা পায়৷
ছবি: DW/S. Kumar Dey
প্রীতম আহমেদ
অনুদান নয় বরং অনিয়ম বন্ধ করার কার্যকর নির্দেশ প্রয়োজন৷ অন্তত একটি মামলার আদালতের রায় প্রয়োজন৷ অবৈধ ভাবে অনুমতিহীন গান বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশনা প্রয়োজন৷ তাহলেই অপরাধীরা শিল্পীদের টাকা লুট করা বন্ধ করবে৷ দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে মিল রেখে শিল্পীদের ৭০% রয়েলিটি নিশ্চিত করতে হবে৷ তবেই একজন শিল্পী সুস্থ ও সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারবে৷
ছবি: Pritom Ahmed
খুরশীদ আলম
সিএনজি ওয়ালাদের সংগঠন আছে বলেই যখন ইচ্ছা তখন সিএনজি বন্ধ করে দিচ্ছে৷ বাস মালিকদের সংগঠন আছে, তারা যখন ইচ্ছা বাস বন্ধ করে দিচ্ছে৷ আমাদের সংগঠন নাই, আমরা পারছি না৷ আমাদের এভাবেই চলতে হবে৷ প্রেসিডেন্টের বেতন বাড়ে, প্রধানমন্ত্রীর বেতন বাড়ে, সচিবের বাড়ে, মন্ত্রীর বাড়ে, এমপির বাড়ে, প্রধান বিচারপতির বাড়ে, কিন্তু শিল্পীদের পেমেন্ট বাড়ানো হয় না৷ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু একটা রেট দিয়ে গেছেন সেটাই এখানো চলছে৷
ছবি: Sazzad Hossain
ব্যরিস্টার তানজীব উল আলম
একজন শিল্পী যখন গানের জন্য স্টুডিও’র সঙ্গে চুক্তি করেন তখন তারা এককালীন পেমেন্ট নিয়ে পুরো গানটাই দিয়ে দেন স্টুডিওকে৷ শিল্পীরা যদি আরেকটু বুদ্ধিমান হতেন তাহলে তারা একবারে টাকা না নিয়ে প্রতিবার প্লে’র জন্য তার সম্মানি চাইতে পারতেন৷ যেটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে হয়৷ ওইসব দেশে কিন্তু পারফর্মিং আর্ট সোসাইটি স্টুডিও’র সঙ্গে শিল্পী নেগোসিয়েশনের কাজটা করে৷ আমাদের দেশের শিল্পীরা এই বিষয়ে অবগত না৷