লকডাউনে সংকটে যাত্রা শিল্প ও শিল্পীরা
৩০ এপ্রিল ২০২০বিনোদনের হাজারো উপকরণ চলে আসায় প্রাচীন অনেক কিছুই বাতিল হয়ে গিয়েছে৷ টেলিভিশন ও মোবাইলনির্ভর বিনোদনের এই পৃথিবীতে তবু টিকে আছে কোনো কোনো শিল্প মাধ্যম৷ পশ্চিমবঙ্গের যাত্রাশিল্প তেমনই একটি মাধ্যম৷ এই শিল্প বাংলার অতীত সংস্কৃতির ধারকও বটে৷ টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র শিল্পের যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনই প্রচারের আলোর বাইরে থাকা যাত্রাপালার ক্ষতি তার থেকে কম কিছু নয়৷
পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দুশোটি যাত্রাপালার দলরয়েছে৷ এর মধ্যে শুধু কলকাতায় দলের সংখ্যা ৫০টির মতো৷ প্রতি বছর এই দলগুলি বিভিন্ন ধরনের কাহিনির উপর নির্ভর করে পালা প্রযোজনা করে৷ মূলত গ্রামীণ এলাকায় দলগুলি যাত্রা পরিবেশন করে৷ এক-একটি মরসুমে প্রায় ১২০-১৩০ দিনের মতো যাত্রা মঞ্চস্থ হয়৷ প্রতিটি দলের সঙ্গে বহু মানুষ যুক্ত থাকে৷ অভিনেতা থেকে শুরু করে টেকনিশিয়ান, মঞ্চসজ্জার শিল্পী থেকে মেকআপ আর্টিস্ট৷ প্রত্যেকে তাঁদের রুজি রোজগার করেন এই শিল্পের মাধ্যমে৷ বড় এবং ছোটপর্দার মতই যাত্রার ক্ষেত্রেও নেপথ্যে থেকে যান বড় সংখ্যক কলাকুশলী৷ লকডাউনের ফলে সর্বত্র মানুষ ঘরবন্দি৷ ফলে দর্শকের জমায়েতে যাত্রা পরিবেশনের সুযোগ নেই৷ এর ফলে ক্রমশ গভীর আর্থিক সংকটে ডুবে যাচ্ছে যাত্রা শিল্প৷
বাংলার পালা জগতের প্রবাদপ্রতীম নাট্যকার ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র মেঘদূত গঙ্গোপাধ্যায় ভৈরব অপেরার মাথা৷ কলকাতার শীর্ষস্থানীয় এই যাত্রা দলটি চলতি মরসুমে লকডাউনের জেরে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে৷ মেঘদূত বলেন, ‘‘এই মরসুমে এখনো পর্যন্ত ৯৮ দিন পালা মঞ্চস্থ হয়েছে৷ বুকিংয়ের যা গতিপ্রকৃতি ছিল, তাতে কমপক্ষে ১২০ দিন মঞ্চস্থ করা যেত৷ কিন্তু, আমরা ৪৮-এ এসে থেমে গিয়েছি৷ শো না হওয়ার ফলে আমরা টাকা পাচ্ছি না৷ অভিনেতা থেকে টেকনিশিয়ান, কাউকে টাকা দিতে পারছি না৷’’
যাত্রা জগতের অভিনেতা ও কলাকুশলীরা নানা ধরনের চুক্তিতে তাঁদের সাম্মানিক পেয়ে থাকেন৷ দৈনিক, মাসিক বা মরসুমের ভিত্তিতে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়৷ অভিনয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবার সাম্মানিক নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে৷ যাঁরা অত্যন্ত কম পারিশ্রমিকের কাজ করেন, তাঁদের সঞ্চয় ফুরিয়ে আসছে৷ বরাহনগরে থাকেন বর্ধমানের যাত্রাশিল্পী মীরা দে৷ ৬২ বছরের এই শিল্পীর সঙ্গী প্রতিবন্ধী দিদি৷ মীরা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কাজ হলে পারিশ্রমিক পাই৷ এখন হাতের টাকা ফুরিয়ে এসেছে৷ কয়েকমাস বাড়িভাড়া দিতে পারিনি৷ রেশনের খাদ্যসামগ্রী পাচ্ছি না৷ প্রতিবেশীরা চাল, আলু দিয়ে গিয়েছেন৷ তা দিয়েই কোনো মতে চলছে৷’’ শিল্পীদের সংগঠন যাত্রা প্রহরীর সম্পাদক মিতালি চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চৈত্র-বৈশাখ মাসে অনেক শো হত৷ লকডাউনের জন্য বায়না বাতিল হয়ে যাচ্ছে৷ হাজারখানেক শিল্পী আমাদের সংগঠনের সদস্য৷ মাত্র ৫৫ জনকে আর্থিক সাহায্য দিতে পেরেছি৷’’
যাত্রার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত মানুষজন ছাড়াও অনেক অনুসারী শিল্পের যোগ থাকে৷ এর মধ্যে অন্যতম লাইট ও ডেকরেটিং৷ যাঁরা মঞ্চ বাঁধেন ও আলোর ব্যবস্থা করেন, তাঁরাও কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়েছেন যাত্রা মঞ্চস্থ না হওয়ায়৷ গ্রামীণ অর্থনীতিই যেখানে ভেঙে পড়ছে, সেখানে যাত্রার সুদিন ফিরে পাওয়া মুশকিল৷ মেঘদূতের বক্তব্য, ‘‘প্রত্যেকেই লকডাউনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত৷ একজন দর্শক যাত্রার টিকিট কাটার টাকা কোথা থেকে পাবেন৷ আবার যাঁরা আয়োজক তাঁরাও আগের মতো চাঁদা তুলতে পারবেন না৷ ফলে আমাদের বুকিং কমে যাবে৷ এই পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির সম্ভাবনা দেখছি না৷’’
প্রতি বছর রথযাত্রার দিন যাত্রাশিল্পের শুভ মহরত অনুষ্ঠিত হয়৷ পয়লা বৈশাখের হালখাতার মতো৷ সেদিন থেকে নতুন মরসুমের যাত্রাপালার বুকিং শুরু হয়৷ আগামী আষাঢ় মাসে রথযাত্রা দিনটি এগিয়ে আসছে৷ কিন্তু, কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের যাত্রাদলের কর্তারা জানেন না, এবার তাঁরা ওই শুভদিনে বুকিং শুরু করতে পারবেন কি না৷
৩১ মার্চের ছবিঘরটি দেখুন...