লকডাউন কি এখনই তোলা উচিত? এই প্রশ্নে বিতর্ক শুরু হয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। অনেকেরই ধারণা, দ্রুত লকডাউন তুলে দিলে সংক্রমণ বাড়বে। অন্যপক্ষ চিন্তিত অর্থনীতি নিয়ে।
বিজ্ঞাপন
কাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে? অর্থনীতি, না কি মানুষের প্রাণ? বিশ্ব জুড়ে এটাই এখন সব চেয়ে বড় প্রশ্ন। করোনার প্রভাবে প্রায় গোটা বিশ্বেই লকডাউন জারি হয়েছিল। তার জেরে অর্থনীতি কার্যত ধসে পড়েছে। ফলে করোনার প্রকোপ না কাটলেও ক্রমশ লকডাউন তুলতে শুরু করেছে বিভিন্ন দেশ। যা নিয়ে বিতর্কও চলছে যথেষ্ট। তবে এই মুহূর্তে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে অ্যামেরিকা।
সোমবার সকাল পর্যন্ত অ্যামেরিকায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১১ লাখ ৮৮ হাজার জন। মৃত্যু হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৯৮ জনের। সংক্রমণের হার এখনও কমেনি। কিন্তু ট্রাম্প জানিয়েছেন, লকডাউন তুলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। বস্তুত, রবিবার থেকেই দেশের জনগণ রাস্তায় বেরোতে শুরু করেছেন। প্রতিবাদ সভায় মাস্ক ছাড়াই অংশগ্রহণ করেছেন। নিউ ইয়র্কের মতো করোনাপ্রবণ জায়গায় রোববার রৌদ্রস্নান করতেও বেরিয়ে পড়েছিলেন মানুষ। যা নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করেছেন ডেবোরা বার্ক্স। হোয়াইট হাউসে করোনা টাস্ক ফোর্সের কো-অর্ডিনেটার তিনি। তাঁর বক্তব্য, এ ভাবে যদি জনগণ রাস্তায় বেরোতে শুরু করেন, তাহলে সংক্রমণ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। বস্তুত, এখনই লকডাউন হাল্কা করে দেওয়ার বিরুদ্ধেও জোড়ালো সওয়াল করেছেন ডেবোরা। ট্রাম্প অবশ্য জানিয়েছেন, অর্থনীতি সচল রাখতে লকডাউন তুলতেই হবে। তবে কোথায় কবে কী ভাবে লকডাউন তোলা হবে, তার সিদ্ধান্ত নেবেন রাজ্যের গভর্নররা।
করোনা যেভাবে পালটে দিচ্ছে কৃষি
করোনা লকডাউন মানবজীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাকে পালটে দিচ্ছে৷ এর বাইরে নয় কৃষিও৷ ছবিঘরে দেখুন কৃষি ও পশুপালনে কী প্রভাব ফেলছে এই মহামারি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Bernetti
খামারে পশুপালন নিয়ে ভাবনা
বিজ্ঞানীরা এখনও জানেন না ঠিক কিভাবে কোভিড-১৯ এর উৎপত্তি হয়েছে৷ তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সোয়াইন ফ্লু এবং বার্ড ফ্লু শূকর এবং মুরগি থেকে ছড়িয়েছে এটা অন্তত নিশ্চিত৷ মহামারির ঝুঁকি বাড়তে থাকা এবং এর সঙ্গে প্রাণীদের সংযোগ পাওয়ায় খামারে পশুপালন নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে চিন্তাভাবনা৷
ছবি: picture alliance/Augenklick/Kunz
বন্যপ্রাণীর ব্যবসা
এখন পর্যন্ত গবেষকেরা ধারণা করছেন নভেল করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে চীনের উহানের বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে৷ মহামারির আগে বন্যপ্রাণীর বিশাল ব্যবসা সম্পর্কে মানুষের ধারণা কমই ছিল৷ কিন্তু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর চীন সরকার দেশজুড়ে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে অন্তত ১৯ হাজার বন্যপ্রাণীর বাজার বন্ধ করে দেয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Bernetti
স্থিতিশীল খাতের সন্ধানে
মহামারি আমাদের খাদ্য সরবরাহেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে৷ লকডাউন ও বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ বন্ধের ফলে এই খাত স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের কাছে খাবার সরবরাহে নানা পন্থা বেছে নিয়েছে৷ পশুচারণ থেকে শুরু করে শ্রমিক সংকট সবক্ষেত্রেই কৃষকেরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন৷ তাদের অপেক্ষা সব স্বাভাবিক হওয়ার অথবা বিকল্প কোনো পথ খুঁজে নেয়ার৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শহুরে চাষবাস বাড়ছে
বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ এখন বাড়িতে আটকা পড়ে আছেন৷ তাদের অনেকেই ছাদে বা বারান্দায় সীমিত পরিসরে হলেও কৃষি কাজ করছেন৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে এটি ভালো ফল বয়ে আনতে পারে৷ ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই শহরে বাস করবে৷ ফলে তখন শহুরে চাষবাস ও খামার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে৷ পাশাপাশি স্বল্প খরচ ও জমির চাহিদার কারণে পরিবেশে তা ভালো প্রভাব ফেলবে৷
ছবি: Imago/UIG
প্রকৃতির ওপর চাপ কমছে
২০৫০ সালের দিকে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছাড়াবে ১০০০ কোটি৷ ফলে খাবারের উৎপাদনও বাড়াতে হবে সে হারেই৷ এতদিন কৃষিজমির পরিমাণ বাড়ানোকেই এর একমাত্র সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা হতো৷ কিন্তু শহরে চাষাবাদ বাড়তে থাকায় এই সংকটের নতুন সমাধান মিলতে পারে৷
ছবি: Kate Evans / Center for International Forestry Research (CIFOR)
উদ্ভিজ্জ আমিষের খোঁজ
মাংসের চাহিদা যত বাড়ছে, স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে৷ এক গবেষণায় দেখা গেছে চীনে উদ্ভিজ্জ পণ্য়ের দিকে মানুষ ঝুঁকছে৷ পশ্চিমা দেশগুলোতেও বেশ কয়েক বছর ধরে এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে৷ করোনা ভাইরাস মহামারি এই প্রবণতা আরো ত্বরান্বিত করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/C. Neibergall
খাদ্য নিরাপত্তা
খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ উন্নত দেশের চেয়ে উন্নয়নশীল দেশে প্রভাব ফেলবে বেশি৷ জাতিসংঘ এরইমধ্য়ে ভয়াবহ খাদ্যসংকটের হুঁশিয়ারি দিয়েছে৷ দুর্ভিক্ষ রোধে জরুরি ত্রাণ সরবরাহ, খাবার সরবরাহের ব্যবস্থার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে নানা ধরনের শস্যের চাষ, কৃষি জমির সুরক্ষাসহ নানা দিক নিয়ে ভাবতে হবে দেশগুলোকে৷
ছবি: DW/K. Makoye
7 ছবি1 | 7
রোববার এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প জানিয়েছেন, এ বছরের শেষের মধ্যেই করোনার টিকা বাজারে চলে আসবে বলে তিনি মনে করেন। তার আগে রেমডিসিভিয়ারের চিকিৎসায় সাড়া মিলেছে বলে ফের জানিয়েছেন তিনি। সোমবার থেকে অ্যামেরিকার বিভিন্ন হাসপাতালে ওষুধটি দেওয়া হবে বলেও হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে জানানো হয়েছে।
অন্য দিকে, মার্কিন সচিব মাইক পম্পেও রোববার আবার বলেছেন, চীনের উহানের একটি পরীক্ষাগার থেকেই যে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ তাঁদের কাছে আছে। যদিও এখনও পর্যন্ত প্রমাণ প্রকাশ করতে চাইছে না অ্যামেরিকা। গত সপ্তাহের শেষে ডনাল্ড ট্রাম্পও একই কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, উহানের পরীক্ষাগার থেকেই যে করোনা ছড়িয়েছে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। বেজিং পাল্টা আক্রমণও করেছিল। চীনের দাবি, নিজের দেশে করোনা পরিস্থিতি সামলাতে পারছেন না বলেই ট্রাম্প তাদের দিকে আঙুল তুলছেন। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, অ্যামেরিকা এবং চীনের এই শব্দযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছবে, তা বলা মুশকিল। অনেকেরই ধারণা, এ ভাবে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ চলতে থাকলে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়বে।
আফ্রিকায় বাহারি করোনা মাস্ক
নাকমুখ ঢাকার মাস্ক সাদামাটা হতে হবে কেন? আফ্রিকার ফ্যাশন ডিজাইনাররা রং ও নক্সার বাহার দিয়ে মাস্ক সাজাচ্ছেন৷ নিজস্বতা বজায় রেখে মানুষকে করোনা সংকটের মোকাবিলা করতে উৎসাহ দিচ্ছেন তাঁরা৷
ছবি: Mizo Ozim
আলজেরিয়ায় মাস্কের উপর ব্যক্তিত্বের ছাপ
আলজেরিয়ার ডিজাইনার মৌনিয়া লাজালি সেলাই করে অসংখ্য মাস্ক তৈরি করে দান করেছেন৷ গায়ক জো বাতুরি তাঁর একটি ডিজাইন তুলে ধরেছেন (ছবিতে দেখা যাচ্ছে)৷ তাঁর মতে, মানুষ নিজস্ব সংস্কৃতি ও রুচিবোধ আঁকড়ে ধরতে চান৷ ফলে এই মাস্ক ফ্যাশন হিসেবে তাঁদের মনে ধরবে৷ এভাবে মানুষ নিজের সুরক্ষার বিষয়টিকে আরো বেশি গুরুত্ব দেবে বলে তাঁর আশা৷
ছবি: Mizo Ozim
রুয়ান্ডায় মাস্কের ঘাটতি পূরণে উদ্যোগ
রুয়ান্ডার দর্জি আলেক্সান্ডার নশিমিয়িমানা (বাম থেকে দ্বিতীয় জন) ডিডাব্লিউ-কে বলেন, দেশে মাস্কের ঘাটতি পূরণ করতে তিনি এমন রঙিন মাস্ক তৈরি করে চলেছেন৷ অধিকাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমা বুঝে সেই মাস্কের দাম যতটা সম্ভব কম রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷ দেশের ওষুধের দোকানে এমন মাস্কের দাম প্রায় দুই মার্কিন ডলার হলেও তিনি মাত্র ৫০ সেন্টে সেগুলি বিক্রি করছেন৷
ছবি: Alexander Bell Nshimiyimana
লাইবেরিয়ায় রংয়ের ছোঁয়া
লাইবেরিয়ার ‘দ্য বম্বশেল ফ্যাক্টরি’র সব কর্মীই নারী৷ পোশাক তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের স্বনির্ভর করে তোলাই কোম্পানির ব্রত৷ বিক্রি হয়নি, এমন স্কার্ট কেটে উজ্জ্বল মাস্ক তৈরি করা হচ্ছে৷ প্রত্যেকটি মাস্ক বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি এমন কোনো গৃহহীন মানুষকে দান করা হয়, যার পক্ষে বাসায় কোয়ারান্টাইনে থাকা সম্ভব নয়৷
ছবি: Marcelle Yhap
কেনিয়ায় কেতাদূরস্ত মাস্ক
কেনিয়ার ফ্যাশন ডিজাইনার ডেভিড আভিডো ‘লুকসলাইক আভিডো’ ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা৷ উদ্বৃত্ত পোশাক কেটে নিজের তৈরি মাস্ক পরে তিনি ছবি তুলিয়েছেন৷ মার্চ মাসে কেনিয়ায় প্রথম করোনা ভাইরাস ধরা পড়ার পর তাঁর কোম্পানি দশ হাজারেরও বেশি মাস্ক তৈরি করে রাজধানী নাইরোবি ও আশেপাশের এলাকায় বিনামূল্যে বিতরণ করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/G. Odhiambo
ক্যামেরুনে ডিজাইনার বোনেরা
অঁজ গুফাক (বামে) ও তাঁর বোন এদমঁদ কেনাং (ডানে) ক্যামেরুনে এমন রংচঙে মাস্ক তৈরি করে চলেছেন৷ সঙ্গে চোখ ঢাকার প্লাস্টিকের অংশও রয়েছে৷ করোনা সংক্রমণের গতি কমাতে ১৩ই এপ্রিল থেকে সরকার প্রকাশ্যে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে৷
ছবি: Edmonde Kennang
টিউনিশিয়ার হাসপাতালে মাস্ক দান
করোনা সংকট শুরু হবার পর অনেক হাসপাতাল মাস্কের ঘাটতির মুখে টিউনিশিয়ার ডিজাইনার মিরিয়াম রিজা-র সঙ্গে যোগাযোগ করে৷ দান করা কাপড় দিয়ে মাস্ক তৈরি করে তিনি বিনামূল্যে হাসপাতালে বিতরণ করছেন৷ সেই কাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে রিজা সেইসব ক্রেতার জন্যও মাস্ক তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন, যাঁদের যথেষ্ট অর্থবল রয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. Belaid
6 ছবি1 | 6
লকডাউন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে অস্ট্রেলিয়াতেও। ধীরে ধীরে সেখানে স্কুল-কলেজ খোলার প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার। তারই মধ্যে সিডনিতে এক স্কুল পড়ুয়ার করোনা ধরা পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছে, এত তাড়াতাড়ি স্কুল-কলেজ খুলে দিলে নতুন করে করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি তৈরি হবে। ফলে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত। জার্মানিতেও স্কুল-কলেজ খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অ্যামেরিকা অবশ্য জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের আগে সেখানে স্কুল-কলেজ খোলা হবে না।
লকডাউন তোলা নিয়ে গোটা বিশ্ব যখন দোলাচলে, তখন করোনা সংক্রমণ পেরিয়ে গেল ৩৫ লাখের গণ্ডি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, সোমবার সকাল পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৬৬ হাজার ১১১। মৃত্যু হয়েছে দুই লাখ ৪৮ হাজার জনের। সুস্থ হয়েছেন ১১ লাখ ৫৪ হাজার জন। কিন্তু চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীদের অনেকেই বলছেন, যে সব দেশে করোনা পরিস্থিতি সামান্য ভালো হয়েছে, সেখানে ফের ফিরে আসতে পারে এই মারণ রোগ। সম্প্রতি আফগানিস্তানে একটি জরিপ হয়েছে। রিপোর্ট বলছে, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাজধানী কাবুলের এক তৃতীয়াংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হবেন। বস্তুত, শুধু কাবুল নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশেই করোনা সংক্রমণ এখনও সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয়নি বলে অনেকে মনে করছেন।