করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা অবস্থায় সরকারের লকডাউন শিথিলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় পরামর্শক কমিটি৷ কঠোর বিধিনিষেধ ১৪ দিন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে তারা৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, একই সঙ্গে কোরবানির পশুর হাট বন্ধ রেখে প্রয়োজনে ডিজিটাল হাট পরিচালনার ব্যবস্থা করার পরামর্শও দিয়েছে জাতীয় কমিটি৷
কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহর স্বাক্ষরে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা বলা হয়েছে৷
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির ৪১তম সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ এর আগে এই কমিটির সুপারিশের পর সরকার ১ এপ্রিল থেকে কঠোর লকডাউনে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল৷
ঈদের আগে বৃহস্পতিবার থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত সর্বাত্মক এই লকডাউন এক সপ্তাহ শিথিল করে সরকার৷ সরকারি ঘোষণার দুদিন পর কমিটি তাদের পরামর্শ জানাল৷
সংক্রমণের অতি বিস্তারের মধ্যে লকডাউন তুলে নেওয়ায় পরিস্থিতি জটিল রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও৷
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন নিয়মিত বুলেটিনে বলেন, "স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনে করে, এই বিধিনিষেধ শিথিল করা সাপেক্ষে আমাদের সংক্রমণ বৃদ্ধি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে ৷'' এদিকে জাতীয় কারিগরি কমিটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, সরকার লকডাউন শিথিল করে সীমিত পরিসরে কোরবানির হাট পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলেও কিছু বিধিনিষেধ প্রয়োগ এবং শহর এলাকায় কোরবানির পশুর হাটের অনুমতি না দেয়ার সুপারিশ তাদের ৷
এছাড়া বয়স্ক ব্যক্তি এবং অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কোরবানির হাটে না যাওয়া, হাটে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য নির্দিষ্টভাবে আলাদা পথ রাখা, বাজারে আসা সবার জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার কথাও বলেছে তারা ৷
ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে না গিয়ে, যে যেখানে আছেন সেখানে থাকার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে পরামর্শক কমিটি৷
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা
বাংলাদেশে কড়া লকডাউন চলছে৷ বৃহস্পতিবার থেকে অবশ্য ঈদ উপলক্ষ্যে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন শিথিল করা হবে৷ তার আগে করোনা, লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে ঢাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছেন আলোকচিত্রী মর্তূজা রাশেদ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভ্রাম্যমাণ আদালত
মঙ্গলবার ঢাকার কলেজগেটে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বিআরটিএ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হয়েছে৷ কর্তব্যরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে কথা বলে জানা যায়, মূলত সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে, সচেতন করতে এবং কিছুক্ষেত্রে জরিমানা করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তরুণদের মধ্যে উদাসীনতা বেশি
করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে বয়স্করা বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন, এমন ধারণা ছড়িয়ে পড়েছিল৷ সে কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে প্রবল অনীহা আছে বলে মন্তব্য করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ৷ কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতীয় যে ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে সব বয়সের মানুষই সমানভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘সবসময় মাস্ক পরে থাকা যায় না’
পেশায় মৌসুমী ব্যবসায়ী মো. রিপন মিয়া বলেন, ‘‘মানুষ যেমনে মরতাসে, মাস্ক তো আসলে সবার পরা উচিত৷ কিন্তু আমরা যারা কর্ম কইরা খাই, এই গরমে সবসময় মাস্ক পরা সম্ভব হয় না৷ একটু না খুললে হাঁসফাঁস লাগে৷ তাই কিছুক্ষণ পরপর মাস্ক একটু খুইলা রাখি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আমাদের মাস্ক লাগে না’
ঢাকার পীরেরবাগ এলাকায় গিয়ে দেখা গেল সেখানে কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছেন৷ কাছে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব এবং মাস্কের ব্যাপারে জানতে চাইলে একজন মন্তব্য করেন, ‘‘আমরা সবাই সুস্থ, আমাদের মধ্যে করোনার কোনো লক্ষণ নাই৷ তাই এইসব আমাদের লাগে না, ভাই৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘গতবছরের মতো এখন কেউ ভয় পায় না’
ঢাকার মতিঝিল মোড়ে একটি দৈনিক পত্রিকার দোকানে গিয়ে দেখা গেল, দুইজন বিক্রেতার কারো মুখে মাস্ক নেই৷ ছবি তুলতে দেখে একজন তড়িঘড়ি করে মাস্ক মুখে দিলেও আরেকজন ছিলেন নির্বিকার৷ কেন মাস্ক পরেননি জানতে চাইলে জিসান হোসেন বলেন, ‘‘করোনাকে আর কত ভয় পাবো? গতবছর মানুষ যা ভয় পাওয়ার পাইসে, এখন আর কেউ অত ভয় পায় না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঘোর অবিশ্বাস
ঢাকার মতিঝিলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ফল ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘করোনা শনাক্ত আর মৃত্যু নিয়া সরকার যে এত বক্তব্য দেয়, এদের সবাই কি করোনাতেই মারা গেসে? অন্য রোগে মারা যাইতেসে এরকম নাই? শ্বাসকষ্ট হইলেও করোনা হইসে? এগুলি আসলে মানুষরে ভয় দেখানোর জন্য বাড়াইয়া বলে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মনে থাকে না, গরমও লাগে...
এই প্রতিবেদক একাধিকবার সরেজমিনে কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন, রাস্তার অর্ধেক মানুষই ছবি তুলতে দেখলে অথবা পুলিশ আসতে দেখলেই দ্রুত মাস্কটা পরে নেন৷ এমন আচরণের কারণ জানতে চাইলে একজন বলেন, ‘‘কী করুম কন, মাস্ক পরতে মনেও থাকে না, গরমও লাগে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘করোনায় গরিবও মরে, কিন্তু খোঁজ হয় না’
ঢাকার মতিঝিল মোড়ের ভাংতি টাকার ব্যবসায়ী আসমা বেগম করোনার চলমান অবস্থা সম্পর্কে বলেন, ‘‘করোনায় সবাই মরতাসে৷ ধনী-গরিব কোনো বাছবিচার নাই৷ কিন্তু আমরা গরিবরা মরলে খবর হয় না৷ তাই জন্য আমাগোর সবার ধারণা যে, করোনায় গরিব মরে না৷ কিন্তু এইটা ভুল৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘মানুষ খাইতে না পারলে লকডাউন ধুইয়া কি পানি খাইবো?’
ঢাকার কমলাপুরের হকার আব্দুল আজিজ সাধারণ মানুষের মাঝে করোনার ব্যাপারে উদাসীনতার বিষয়ে বলেন, ‘‘মানুষ আর কতদিন ঘরে থাকবে বলেন? সরকার আমাগো খাওয়া খরচ, ঘরভাড়া দেয়? মানুষ খাইতে না পারলে সচেতনতা আর লকডাউন ধুইয়া কি পানি খাইবো?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাস্ক কেনার সামর্থ্যও নেই যাদের...
মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উদাসীনতা দেখা যায়, তাদের বড় একটা অংশ নিম্ন আয়ের মানুষ৷ তাদের অনেকেই বলেন, মাস্ক পরে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করা সম্ভব না৷ তাছাড়া তারা দিন আনেন দিন খান, নিয়মিত মাস্ক কেনার মতো অতিরিক্ত টাকা নেই বলেও জানান তারা৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘সরকারেরও দোষ আছে’
ঢাকার গুলিস্তান মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের হকার জয়নাল ইসলাম বলেন, ‘‘দ্যাশে এই যে এত মানুষ মরতাসে, এর দোষ সরকারেরও আছে৷ মানুষরে টিকা দিতে পারে নাই, হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে পারে না, আয়ের ব্যবস্থা না কইরা খালি লকডাউন দেয়৷ এমনে কি মানুষের জীবন চলে, নাকি দুনিয়া চলে?’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘আগে মানলে এরকম দিন আইতো না’
ব্যক্তিগত গাড়িচালক মো. হানিফ শেখ বলেন, ‘‘গত রোজার ঈদে সরকার গণপরিবহন বন্ধ রাখসিলো যেন মানুষ নড়াচড়া করতে না পারে৷ কিন্তু মানুষ মানে নাই, একজনের গায়ের উপর আরেকজন উইঠা বাড়ি গেসে৷ এই যে এখন হাজার মানুষ মরতাসে, আমার মনে হয় তখন এমন না করলে এরকম দিন আইতো না আজকে৷’’