বিশ্বের সর্বপরিচিত মহানগরীগুলির মধ্যে একটি হলো লন্ডন৷ লন্ডনকে নানাভাবে চেনা যায়: বিগ বেন কিংবা ওয়েস্টমিন্সটার দিয়ে৷ আবার ব্ল্যাক ক্যাব দিয়েও লন্ডনকে চেনা যায়: শুধু প্যাসেঞ্জার হিসেবেই নয়, ট্যাক্সিচালক হিসেবেও৷
বিজ্ঞাপন
ব্রিটেনের রাজধানীর প্রতিটি আনাচকানাচ, রাস্তা, চত্বর কিংবা সেতু চেনেন জেফ থমাস৷ আট বছর আগে ছিলেন লন্ডন পুলিশের কনস্টেবল, তারপর হন লন্ডনের ক্যাবি, মানে ট্যাক্সিচালক৷ জেফ থমাস শুধু রাস্তাঘাটই নয়, শহরের সব অলিগলি চেনেন:
‘‘মল-এ ঢোকার সময় খেয়াল করবেন, জায়গাটা কত চওড়া৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে একটা বিমান নামতে কিংবা উড়তে পারতো – সব ট্র্যাফিক লাইট, ট্র্যাফিক আইল্যান্ড ইত্যাদি সরিয়ে ফেলা যায়...৷''
‘‘ফ্ল্যাগ লাগানো এই ছোট্ট হোটেলটি হলো গোরিং হোটেল; কেট মিডলটন প্রিন্স উইলিয়ামকে বিয়ে করার আগে সিঙ্গল লেডি হিসেবে তাঁর শেষ রজনী কাটিয়েছিলেন এখানে, এই হোটেলেই, বাকিংহ্যাম প্যালেসের খুব কাছে...৷'
লন্ডনের সব ক্যাবির মতো জেফ থমাস জানেন, অভিজাত, নাম-করা পুরুষদের ক্লাবগুলো কোথায়: সেন্ট জেমস গির্জা এলাকায়৷' তবে অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলোকে বাইরে থেকে চেনা শক্ত:
‘‘ওরা গত কয়েক বছরে সব জেন্টলমেন্স ক্লাব-এর নেম প্লেটগুলো সরিয়ে ফেলেছে৷ তার কারণ হলো, আপনি যদি সেই ক্লাবের মেম্বার হন, তাহলে আপনি এমনিতেই জানবেন, ক্লাবটা কোথায়৷ সেটা আপনাকে আলাদা করে বলে দেবার কোনো প্রয়োজন পড়বে না৷ ওরা ক্লাবটাকে জানান দিতে চায় না৷''
লন্ডনের ব্ল্যাক ক্যাব-এর ভাড়া বিশ্বের অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় মাঝামাঝি৷ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে সময় কিন্তু লাগে কিছুটা বেশি, কেননা লন্ডনের কেন্দ্রে যানবাহনের গতি গড়ে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটারের বেশি নয়:
‘‘সিটি অফ লন্ডন নাকি ভাবছে, সারা শহরের জন্য একটা সাধারণ স্পিড লিমিট করবে: ঘণ্টায় ৩০ মাইল৷ আমরা ঠাট্টা করে বলেছি: অ্যাঁ, তার বদলে ঘণ্টায় ২০ মাইল করলেই তো হয়, কেননা তার বেশি এমনিতেই চালানো যায় না৷''
লন্ডনের প্রায় ২০ হাজার ব্ল্যাক ক্যাব ছাড়া বহু বেসরকারি ট্যাক্সি সার্ভিস আছে, যদিও লন্ডনের মানুষ তাদের ক্যাবিদেরই বেশি পছন্দ করেন৷
সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লন্ডন ট্যাক্সির সূচনা৷ ক্যাবিদের তখন প্রথম লাইসেন্স দেওয়া হয়৷ বিংশ শতাব্দীতে মোটরগাড়ি আসার পরেও লন্ডনের ট্যাক্সি কালোই থাকে৷ ব্ল্যাক ক্যাবগুলি লন্ডনের একটা প্রতীক চিহ্ন হয়ে ওঠে, যেমন লন্ডনের লাল দোতলা বাসগুলি৷
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ট্যাক্সি
সারা বিশ্বেই ‘ট্যাক্সি’ আজ শুধু যানবাহন নয়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের একটা জায়গা হয়ে উঠেছে৷ ট্যাক্সিটি নতুন, পুরনো, ভাঙা বা বিলাসবহুল – যাই হোক না কেন, সেটায় বসেই যাত্রী সে দেশটিকে, দেশের মানুষকে দেখতে, ও জানতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উজ্জ্বল হলুদ রঙের ট্যাক্সি
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের হলুদ রঙের এই ট্যাক্সিগুলো পরিচিত ‘ইয়েলো ক্যাব’ নামে৷ বিশ্বখ্যাত এই ট্যাক্সিগুলো মজবুত এবং আয়তনে বেশ বড় হলেও, ১৯৮০ সালের পর থেকে আর তৈরি হয়নি৷ তাছাড়া পুরনো এই ট্যাক্সিগুলো চালাতে বেশি পেট্রোল লাগলেও, আজও নিউ ইয়র্কের রাস্তায় মাঝে মাঝেই এগুলি চোখে পড়ে৷ শোনা যায়, ১৯৯৯ সালে এই হলুদ ক্যাবের দাম নিলামে ১৩৪,৫০০ অ্যামেরিকান ডলার পর্যন্ত উঠেছিল৷
ছবি: imago/Manfred Segerer
মেয়েদের জন্য গোলাপি রঙের ট্যাক্সি
মেক্সিকোয় বড় শহরগুলোর রাস্তা তেমন নিরাপদ নয়৷ তাই মেক্সিকো-সিটি এবং পুয়েব্লার পৌরসভা সেখানে ‘পিংক ক্যাব’ ট্যাক্সি চালু করেছে৷ উজ্জ্বল গোলাপি রঙের এই ট্যাক্সির চালকরা যেমন মেয়ে, তেমনি যাত্রীও শুধুই মেয়ে এবং শিশুরা৷ মজার ব্যাপার হচ্ছে, নারীচালিত এই ট্যাক্সিতে জিপিএস, ইমারজেন্সি বোতাম এবং কসমেটিক্স বক্স – এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সবসময় থাকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অতীতে ফিরে যাওয়া
কিউবার রাস্তায় এখনো পুরনো গাড়ি, মানে ‘ওল্ডটাইমার’ চলতে দেখা যায়৷ এদের মধ্যে অধিকাংশই মার্কিনি৷ ১৯৫০ এবং ৬০-এর দশকের এমন অনেক গাড়ি ইতিমধ্যেই ১০০,০০০ কিলোমিটারের ঘর পার করেছে৷ তাই আজকের এ যুগে ঐ গাড়িগুলোয় চড়া পর্যটকদের জন্য এক অকল্পনীয় অভিজ্ঞতা৷ তার ওপর এগুলো ‘শেয়ার ট্যাক্সির’ মতো কাজ করায়, পথে যাত্রী ওঠা-নামা করে৷ ফলে স্থানীয়দের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় সহজেই৷
ছবি: picture-alliance/Horst Galuschka
ইচ্ছে মতো যাত্রী তোলা
গণ প্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসার ট্যাক্সিগুলিতে কতজন যাত্রী তোলা হবে – তার কোনো নিয়ম-কানুন নেই৷ ফলে ট্যাক্সিতে চালকের ইচ্ছেমতো যাত্রী তোলা হয়৷ তবে এ ছবি শুধু আফ্রিকায় নয়, বাংলাদেশের রাস্তাতেও নিত্যদিনের দৃশ্য৷ আসলে বেশিরভাগ সময় যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য আর কোনো বিকল্প উপায় থাকে না বলেই শেষ পর্যন্ত এরকম ভর্তি ট্যাক্সিতে ওঠেন তাঁরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
দুবাইয়ের ‘লাইফলাইন’ জলট্যাক্সি
এখানে যতগুলো সেতু আছে, তারচেয়েও বেশি আছে জলট্যাক্সি৷ খাঁড়িগুলিতে অবশ্য শুধুমাত্র কাঠের তৈরি জাহাজগুলোরই চলাচলের অনুমোদন আছে৷ তবে ‘আব্রাস’ নামের ছোট্ট এই নৌকাটিও অন্ততপক্ষে ২০ জন মানুষকে তুলতে পারে৷ আর এই জলট্যাক্সিতে শ্রমিক, ম্যানেজার, পর্যটক – যেই উঠুন না কেন, সবার জন্যই ভাড়া মাত্র ২০ সেন্ট৷ সম্ভবত বিশ্বের আর অন্য কোথাও এত কম ভাড়ায় ট্যাক্সি চড়া যায় না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অমানবিক কাজ
জাপানে আবিষ্কৃত রিক্সা প্রথমে এশিয়ার দেশগুলিতে পরিচিতি পেলেও, ইতিমধ্যে সাইকেল রিক্সা হিসেবে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর চল রয়েছে৷ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবশ্য টানা রিক্সা শহরের প্রায় সব জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে৷ আজকের যুগে মানুষ-টানা রিক্সাকে রাজনীতিবিদ সহ অনেকেই অমানবিক বলে মনে করেন৷ তাই তাঁরা এ ধরণের রিক্সা একেবারেই তুলে দেওয়ার পক্ষে৷
ছবি: Gemeinfrei
সন্নাসীরাও ট্যাক্সিতে ওঠেন
থাইল্যান্ডে ট্যাক্সি চড়ে ঘুরে বেড়ানোটা বেশ মজার একটা ‘অ্যাডভেঞ্চার’৷ তবে ওখানকার তিন চাকাওয়ালা ‘টুক-টুক’-এ চড়তে শক্ত নার্ভ আর স্থিতিশীল পাকস্থলী থাকা প্রয়োজন তা না হলে মুসকিল৷ অন্যদিকে আরামদায়ক গাড়ির মধ্যে লিমোজিন অন্যতম৷এই গাড়িতে ওঠার আগে পর্যটকদের ভাড়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা ভালো৷ থাইল্যান্ডে সন্নাসীদের বিশেষ অবস্থানের কারণে তাঁরা এই ব্যয়বহুল লিমোজিনে উঠতে পারেন, তাও আবার বিনা পয়সায়৷
ছবি: picture-alliance/Sebastian Kahnert
বিরক্তিকর!
কম্বোডিয়ায় পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য সাইকেল রিক্সা, মোফাট্যাক্সি, মিনিবাসের মতো নানান যানবাহন রয়েছে৷ তবে ‘পিকআপ’ হচ্ছে সস্তা যানবাহনের একটি৷ আরাম যার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে এতে চড়তে পারেন৷ তবে ‘পিকআপ’-এ চড়ার আগে এটা ধরেই নিতে হবে যে, তাঁকে অন্যান্য যাত্রীদের সাথে কষ্ট করে বসতে হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
সবুজ চা পান
চীনের প্রধান শহরগুলোতে ট্যাক্সিই মূল যানবাহন৷ শুধুমাত্র পেকিংয়েই চলে প্রায় ৬৬,০০০ ট্যাক্সি৷ শুধু তাই নয়, ট্যাক্সিতে খুব কম খরচে এবং সহজে যাতায়াত করা যায়৷ তবে বেশিরভাগ ট্যাক্সি চালক ইংরেজি না জানায়, গন্তব্যস্থলটি চীনাভাষায় লিখে চালককে ধরিয়ে দেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ পর্যটকদের এটাও জানা দরকার যে চীনা ট্যাক্সি চালকরা যখন-তখন সবুজ চা পান করেন৷ তাই আপনাকেও যদি সেই চা খেতে বলা হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জলের ওপর বিলাসবহুল ট্যাক্সি
ইটালির ভেনিস শহরে হাতে গোনা পিচ ঢালা সমান্তরাল রাস্তা রয়েছে৷ কারণ শহরটি রাস্তার বদলে সরু সরু খালে ভর্তি৷ দেড় হাজার বছর আগে ভূমধ্যসাগরের বুকে শহরটির গোড়াপত্তন হয়৷ আর তখন থেকেই ছোট ছোট নালা বা খালের ভেতর দিয়ে চলতো কাঠের তৈরি সোনালি-কালো গন্ডোলা৷ দাঁড় বেয়ে মাঝিরা এই রোম্যান্টিক নৌকা চালান, রাতের বেলায় যাতে ৪০ মিনিট চড়তে খরচ হয় ১০০ ইউরো৷ আজকাল অবশ্য ইলেক্ট্রিক জলট্যাক্সিও পাওয়া যায় ভেনিসে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
10 ছবি1 | 10
লন্ডনের ক্যাবিদের যে পরীক্ষা নেওয়া হয়, তা খুব সোজা নয়৷ জিপিএস ছাড়াই শহরের ২৫ হাজার রাস্তা চিনে উঠতে দুই থেকে চার বছর কেটে যায়৷ কিন্তু শুধু তা দিয়ে ট্যাক্সি লাইসেন্স পাওয়া যায় না:
‘‘আরো অনেক বেশি জানতে হয়: ক্লাব, পাব, লাইব্রেরি, পাবলিক বাথ, শপিং সেন্টার, সরকারি অফিস, বাসের রুট, কোথায় বাস বদলাতে হয় – গির্জা – ট্যাক্সি স্ট্যান্ড – লক্ষ লক্ষ জিনিস, যা জানতে হয়৷''
লন্ডন ক্যাবিদের জ্ঞানই যে শুধু প্রভূত, এমন নয়৷ তাদের ট্যাক্সির কেবিন বেশ বড় আর আরামের; এছাড়া আরো অনেক বিশেষত্ব আছে:
‘‘যেমন এই সুইভেল সিট বা ঘোরানো আসন৷ হয়ত ৯০ বছর বয়সের কোনো যাত্রী, যাঁর পায়ের ব্যথা কিংবা পিঠের ব্যথা, যাঁদের ট্যাক্সিতে ঢুকতে কিংবা বেরোতে কষ্ট হয়: এই সিটটা ঘুরে যাওয়ার ফলে তাঁরা বেরোতে কিংবা ঢুকতে পারেন৷''
সন্ধ্যা নামলে লন্ডনের ‘নিশাচররা' যখন পথে নামেন, তখন শুরু হয় ক্যাবি-দের ‘রাশ আওয়ার'৷ ধনি বা বিখ্যাত ব্যক্তিরা যে নিজেদের লিমোজিন ছেড়ে জেফ থমাস কিংবা তার সতীর্থদের ট্যাক্সিতে চড়েন৷ তার কারণ: ব্ল্যাক ক্যাবে চড়ে জনতার সঙ্গে মিশে যাওয়া যায়, অদৃশ্য থাকা যায়৷ সেজন্য বেশ কয়েকজন তারকা নিজেরাই ব্ল্যাক ক্যাব কিনেছেন, যেমন মডেল কেট মস কিংবা ব্রুনেই-এর সুলতান৷ এমনকি রাণী এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ-এরও নাকি একটা ‘ব্ল্যাক ক্যাব' আছে৷