জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির যে কোনো বিকল্প নেই, সেটা এখন সংশয়ের ঊর্দ্ধে৷ লন্ডনের এক পাড়া নিজস্ব উদ্যোগে সৌরশক্তি ব্যবহার করে সমাধানসূত্রের এক দৃষ্টান্ত তুলে ধরছে৷
বিজ্ঞাপন
অবশেষে নতুন সোলার প্যানেল এসে গেছে৷ ফলে পথের আলোকবাতি নিজস্ব শক্তি উৎপাদন করতে পারবে৷ লন্ডনের পূর্বাংশের লিনমাউথ রোডের বাসিন্দারা প্রায় দুই বছর ধরে সেই লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন৷ তাঁরা প্রতিবেশীদেরও সেই উদ্যোগে শামিল করার চেষ্টা চালিয়েছেন৷ আজ তাঁদের স্বপ্ন সফল হতে চলেছে৷ শিল্পী হিসেবে হিলারি পাওয়েল বলেন, ‘‘কিছু একটা হতে চলেছে, জানালায় পাওয়ার স্টেশনের পোস্টার, এমন চাপ তো ছিলই৷ তাই সেই লক্ষ্য পূরণ হবার প্রথম মুহূর্ত অবশ্যই আনন্দের৷ মনও হালকা হয়৷''
চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রকল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা ড্যান এডেলস্টিন নিজেদের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘আমরা গোটা রাস্তার জন্যই সোলার প্যানেল চেয়েছিলাম৷ কিন্তু দ্রুত বুঝলাম, যে সেটা সম্ভব হবে না৷ সবাইকে বুঝিয়ে শুরুতে রাজি করানো সত্যি কঠিন হবে৷''
সৌরশক্তি ব্যবহারের নজির গড়েছে লন্ডনের যে পাড়া
04:00
শিল্পী হিসেবে হিলারি পাওয়েল ও ড্যান এডেলস্টিনের মাথায় এই আইডিয়া এসেছিল৷ প্রথমে তাঁরা গোটা পথের আলোকবাতি একটি গ্রিডের সঙ্গে সংযোগের আশা করেছিলেন৷ কিন্তু কয়েকটি বাড়ির ছাদ সোলার প্যানেল বসানোর উপযুক্ত ছিল না৷ কয়েক জন প্রতিবেশীও সেই উদ্যোগে শামিল হতে চান নি৷ তবে লিনমাউথ রোডের ২৫টি পরিবার অংশ নিয়েছিলো৷ ড্যান বলেন, ‘‘আমার মতে ব্রিটেনজুড়ে অনেক লাখ মানুষ জলবায়ু সংকট সমাধানের লক্ষ্যে অর্থ ঢালতে চায়৷ এখানকার মতো স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট সমাধানসূত্র তুলে ধরলে সাধারণ মানুষের মনে ধরে৷''
অ্যাকটিভিস্টদের মতে, জলবায়ু সংকট মোকাবিলার লক্ষ্যে সরকারের এমন উদ্ভাবনশীল পরিবেশ সৃষ্টির মতো উন্নয়ন প্রকল্পে মদত দেওয়া উচিত৷ ড্যান এডেলস্টিন বলেন, ‘‘আমাদের বিপুল অংকের অর্থের প্রয়োজন৷ বাসভবন, বাসা বা ব্যবসার জায়গাকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে হলে মানুষকে হয় সমান অংকের অর্থ বা ভরতুকি দিতে হবে৷''
হিলারি ও ড্যান সোলার প্যানেল বসানোর দৃশ্যের ভিডিও তুলছেন৷ সেটাই ‘সৌর সড়ক' সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ৷ তাঁদের প্রতিবেশী অ্যাঞ্জেলার আশা, সোলার প্যানেল তাঁর বিদ্যুতের বিল কমাতে সাহায্য করবে৷ তিনি বলেন, ‘‘ছাদের উপর প্যানেল সফল হলে সেটা আমাদের গ্রহের জন্য অনেক ভালো হবে৷ মানুষ তার সুফল দেখতে পারবে৷ এটা সূচনামাত্র৷ অবশ্যই বিল অনেক কমে যাবে৷''
বর্তমানে এমন সৌরশক্তিচালিত ঘরবাড়ি সেখানে বিরল দৃষ্টান্ত৷ ‘অক্টোপাস এনার্জি' নামের ব্রিটেনের এক বড় বিদ্যুৎ কোম্পানি এ ক্ষেত্রে সহযোগী হয়ে নিজেদের পথিকৃৎ হিসেবে দাবি করছে৷ কোম্পানির প্রতিনিধি নিল উলি বলেন, ‘‘ব্রিটেনের গ্রিড সিস্টেম সবচেয়ে সেকেলে প্রণালীগুলির মধ্যে পড়ে৷ পুরোপুরি জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানির উপর নির্ভরশীল৷ সন্ধ্যা ছয়টার মতো পিক টাইমে, যখন মানুষ বাসায় ফিরে রাতের খাবার রান্না করে, তখন সেই চাহিদা মেটাতে গ্রিডে কয়েকশো জেনারেটর চালাতে হয়৷ ফলে মারাত্মক মাত্রায় দূষণ ঘটে৷ সেটা খুব দামীও বটে৷''
সৌরশক্তির বিস্তার: মিনিগ্রিড থেকে সোলার সিটি
সৌরশক্তি এখন বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা জ্বালানি উৎস৷ বিভিন্ন উপায়ে তাই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন কমিউনিটি, এমনকি বড় শহরগুলোও সূর্য থেকে শক্তি উৎপাদন করছে৷
ছবি: ME SOLshare Ltd.
সূর্য থেকে পানীয় জল
ইথিওপিয়ার রিমা গ্রামে পানির ট্যাংক ভর্তি করতে সোলার পাম্প ব্যবহার করা হচ্ছে৷ বিশুদ্ধ খাবার পানির কুয়াটি গ্রাম থেকে বেশ দূরে৷ সোলার পাম্প ব্যবহার করে সেই কুয়া থেকে গ্রাম অবধি পাইপের মাধ্যমে পানি আনা হয়৷ আগে ডিজেল পাম্প ব্যবহার করে এই কাজটি করা হতো৷ কিন্তু তখন প্রায়শই পাম্পটি নষ্ট হতো, কিংবা জ্বালানির অভাবে চালানো যেতো না৷ ২০১৬ সালে সোলার পাম্প চালুর পর থেকে আর কোনো ঝামেলা হচ্ছে না৷
ছবি: Stiftung Solarenergie
পাওয়ার গ্রিড ছাড়াই মোবাইল চার্জ করার ব্যবস্থা
পূর্ব আফ্রিকার অধিকাংশ প্রত্যন্ত অঞ্চল বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বা পাওয়ার গ্রিড-এর বাইরে৷ সেখানে মোবাইল চার্জ দিতে সোলার কিয়স্ক ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ কেনিয়ার অলকিরামেশন গ্রামের এই সোলার কিয়স্কে সামান্য টাকার বিনিময়ে মোবাইল চার্জ দেয়া যায়৷
ছবি: Solarkiosk GmbH
কৃষকদের জন্য বিদ্যুৎ
নিকারাগুয়ার উত্তরের গ্রাম মিরাফ্লোরের বাসিন্দারা মুলত কফি চাষ এবং চিরাচরিত কৃষি কাজ করেন৷ ২০১৩ সাল অবধি এই গ্রামে কোনো বিদ্যুৎ ছিল না৷ এরপর সেখানে সোলার প্যানেল বসানো শুরু হয়৷ বর্তমানে গ্রামটির ছয়শ’র বেশি পরিবার সৌরশক্তি ব্যবহার করছে৷
ছবি: Stefan Jankowiak
পয়সা বাঁচাচ্ছে সৌরশক্তি
জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলের ফ্রাইবুর্গ শহরের এই হাউজিং প্রকল্পে চাহিদার চেয়ে বেশি সৌরশক্তি উৎপাদিত হচ্ছে৷ বিশ বছর আগে তৈরি এই ভবনগুলো এখন শহর উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে৷ আধুনিক এসব ভবনে পুরনো ভবনের তুলনায় বিদ্যুৎ খরচ কম হয়৷ ফলে পরিবেশরক্ষার পাশাপাশি বাসিন্দাদের পয়সাও সাশ্রয় হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Haid
মাইক্রো-গ্রিডের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুৎ
সোলশেয়ার নামে একটি স্টার্টআপ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাইক্রোগ্রিডের মাধ্যমে সস্তা এবং বিশুদ্ধ বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে৷ যেসব বাড়িতে সোলার প্যানেল রয়েছে, তারা তাদের প্রতিবেশি যাদের এখনো প্যানেল নেই তাদের সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ শেয়ার করছে৷ এই ব্যবস্থায় সৌরশক্তি ব্যবহারকারীরা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অন্যদের বিদ্যুৎ দিচ্ছে, যা তাদের জন্য বাড়তি আয়ের এক উৎসও৷ দেশটিতে ডিজেলের বিকল্প হয়ে উঠছে সৌরশক্তি৷
ছবি: ME SOLshare Ltd.
কোভিড মোকাবিলায় সৌরশক্তি
হাইতির তাবার-এ অবস্থিত এই হাসপাতালটির জ্বালানির উৎস ছাদে বসানো সোলার প্যানেল৷ ৭১০ কিলোওয়াটের এই প্যানেলটি দেশটিতে বসানো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্যানেল৷ করোনা রোগীদের এই হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়৷ এখনকার সব চিকিৎসা সরঞ্জাম সৌরবিদ্যুতে চলে৷ আর এই ব্যবস্থা ব্যবহার করায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বছরে পঞ্চাশ হাজার ইউরোর মতো সাশ্রয় হচ্ছে, কেননা, তাদের আর ডিজেল কিনতে হচ্ছে না৷
ছবি: Biohaus-Stiftung.org
পুরো গ্রামের জন্য মিনিগ্রিড
কেনিয়ার তালেক গ্রামে দেড় হাজারের মতো বাসিন্দা রয়েছেন৷ গ্রামটি ২০১৫ সাল থেকে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে৷ তালেক-এর এক কোণায় একটি ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সোলার ফিল্ড তৈরি করা হয়েছে৷ সেটির মাধ্যমে তিনশ’ মানুষের জন্য বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়৷
ছবি: Imago Images/photothek/T. Imo
সৌরশক্তি ছাড়া পানি মিলবে না
মিশরের মরুভূমিতে পানি পাওয়া দুর্লভ ব্যাপার৷ আর এ কারণেই ইল-ওয়াহাট ইল-বাহারিয়া ওয়াসিস-এ এই সোলার প্ল্যান্টটি স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য খুবই প্রয়োজন৷ এই প্ল্যান্টটি দিয়ে ওয়াটার পাম্প চালু করা হয়, যেটি ছাড়া কৃষি কাজ অসম্ভব৷ মরুভূমির অন্য সব স্থানের মতো এখানেও অবশ্য সোলার প্যানেলটির উপর দিয়ে নিয়মিত বালু সরাতে হয়৷
ছবি: Joerg Boethling/imago images
২০২৫ সালের মধ্যে ‘ক্লাইমেট নিউট্রাল’
ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন ২০২৫ সালের মধ্যে ‘ক্লাইমেট নিউট্রাল’ হতে চায়৷ আর এ কারণেই শহরটিতে পুর্নব্যবহারের উপযোগী জ্বালানির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ানো হচ্ছে৷
ছবি: picture alliance / Zoonar
আইডিয়া আদানপ্রদান
জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলের শহর সারবেক-এর বাসিন্দার সংখ্যা ৭,২০০৷ শহরটিতে সৌর, বায়ু এবং বায়োমাস ব্যবস্থায় প্রয়োজনের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়৷ ছোট কমিউনিটির জন্য পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎপাদনের এক মডেলে পরিণত হয়েছে শহরটি৷ ছবিতে মার্কিন একদল প্রতিনিধিকে দেখা যাচ্ছে যারা শহরটির এই মডেল সম্পর্কে জানতে এসেছেন৷
ছবি: Gemeinde Saerbeck/Ulrich Gunka
10 ছবি1 | 10
চলচ্চিত্র পরিচালক ড্যান এডেলস্টিন বলেন, এখন থেকে এমন রান্নার জন্য শক্তি সরাসরি নিজের ছাদ থেকেই আসবে৷ তাঁর মতে, ‘‘পথের বাকি বাসাগুলি প্রথম দশ থেকে বিশটি বাসায় সোলার প্যানেল বসতে দেখবে এবং বুঝবে, যে এই আইডিয়া অবশ্যই কার্যকর করা যায়৷ কয়েকজন শিল্পী মিলে অবাস্তব কোনো পরিকল্পনা করেনি৷ তখন আশা করি আরো মানুষ এমনটা করতে চাইবে৷ সেইসঙ্গে বেশি পরিমাণে সরঞ্জাম কেনার মাধ্যমে আমরা অর্থের সাশ্রয় করতে পারবো বলে আমরা আশা করছি৷ তখন অন্যান্য পাড়াও এই উদ্যোগে শামিল হবে৷''
এটা শুধু সূচনা বলে আশা করছেন হিলারি পাওয়েল ও ড্যান এডেলস্টিন৷ গোটা শহরে মানুষের হাতেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাবিকাঠি তুলে দেওয়া তাঁদের স্বপ্ন৷