ক্রিকেটার তামিম ইকবাল অ্যাসিড আক্রমণকারীদের তাড়া খেয়ে আতঙ্কে স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে লন্ডন থেকে দেশে ফেরেন বলে খবর চাউর হয় এই মাসের প্রথম দিকে৷ পরে তামিম ঘটনাটি অস্বীকার করলেও, লন্ডনে এহেন অপরাধ বেড়েই চলেছে৷
লন্ডনে ক্রমেই বেড়ে যাওয়া অ্যাসিড আক্রমণে সত্যিই ব্যাপক আতঙ্কে রয়েছেন সেখানকার অনেকে৷ বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিন এলাকায় দুই বাংলাদেশির উপর হামলার পর এই আতঙ্ক আরো ছড়িয়ে যায়৷ অনেকেই মনে করছেন ধারাবাহিক এই হামলা বিদ্বেষপ্রসূত৷
এখানকার, বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশিরা মোটামুটি আতঙ্কেই আছেন বলে জানান লন্ডন শহরের বাসিন্দা অজন্তা দেব রায়৷
ডয়চে ভেলেকে অজন্তা বলেন, কারণ হচ্ছে যে ক'টা হামলা হয়েছে, বেশিরভাগই হয়েছে এশিয়ান ব্রাউন স্কিনের মানুষদের উপর বা মুসলিমদের উপর৷ তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়, এটা রেসিয়ালি মটিভেটেড বা ইসলামোফোভিক আক্রমণ৷ তাঁর কথায়, ‘‘বিশেষ করে দেখলে তো আর ধর্ম বোঝা যায় না, তাই ধর্ম নির্বিশেষে সবাই আতঙ্কে আছে৷''
‘পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশিরা আতঙ্কে আছেন’
This browser does not support the audio element.
নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, গতকাল বিকেল বেলা কয়েকজন বন্ধু মিলে বের হয়েছি৷ তেল নিতে বা সিগনালে গাড়ি কয়েকবারই থামাতে হয়েছে, তখন আমরা এতটাই আতঙ্কিত ছিলাম যে, বারবার বলছিলাম, জানালার কাচটা তুলে দাও৷ জানালা খোলা থাকলেই মনে হচ্ছিল, কখন কী ঘটে যায়৷ তিনি জানান, ‘‘পথ চলতে চলতেই আশেপাশে দৃষ্টি চলে যায়, হুডি পরে কেউ হেটে গেলো কিনা৷''
লন্ডনে খুবই সহজলভ্য অ্যাসিড বিক্রিতে সম্পতি কিছুটা কড়াকড়ি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটা ঘোষণা এসেছে, পুলিশ থেকে জরুরি সার্ভিসকে এক হাজার ‘অ্যাসিড এটাক কিটস' দিয়েছে৷ পূর্ব লন্ডনের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পানির বোতল রাখতে বলেছে৷ অ্যাসিড বিক্রির ব্যপারেও সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে৷
তিনি জানান, ‘‘সাধারণত খুবই সহজে অ্যাসিড পাওয়া যায়৷ তবে সম্প্রতি একটু কড়াকড়ি হয়েছে৷''
আতঙ্কে থাকলে অজন্তা আস্থা রাখছেন ব্রিটেনের পুলিশ ও সরকারের উপর৷ ব্রেক্সিটের পর বর্ণবাদী এ ধরনের আচরণ বাড়লেও সরকার শেষ পর্যন্ত সামলে নিবে বলে তাঁর প্রত্যাশা৷
স্ত্রী সন্তানসহ লন্ডনে থাকা তামিম ইকবালকে অ্যাসিড নিয়ে একদল যুবক ধাওয়া করেছিল বলে যে খবর বের হয়, সেটা বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়৷ হঠাৎ দেশে ফিরে আসা তামিম অবশ্য এই ধরনের ঘটনা অস্বীকার করেছিলেন৷
অ্যাসিড সন্ত্রাস!
একটা সময় বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই আসতো নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপের খবর৷ এমন বর্বরোচিত হামলা এখনও হয় কিছু দেশে৷ কয়েকটি দেশ ঘুরে জার্মান ফটোগ্রাফার অ্যান-ক্রিস্টিন ভোর্ল-এর তোলা ছবি নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: DW/M. Griebeler
বাংলাদেশের ফরিদা
ফরিদার স্বামী ছিলেন ড্রাগ এবং জুয়ায় আসক্ত৷ ঋণের দায়ে একসময় বাড়িটাও বিক্রি করে দেয় নেশাগ্রস্ত লোকটি৷ রেগেমেগে ফরিদা বলেছিলেন, এমন স্বামীর সঙ্গে আর ঘর করবেন না৷ সেই রাতেই হলো সর্বনাশ৷ ঘুমন্ত ফরিদার ওপর অ্যাসিড ঢেলে দরজা বন্ধ করে দিল পাষণ্ড স্বামী৷ যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলেন ফরিদা৷ প্রতিবেশীরা এসে দরজা ভেঙে উদ্ধার করে তাঁকে৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
মায়ের স্নেহে, বোনের আদরে...
অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়ার সময় ফরিদা ছিলেন ২৪ বছরের তরুণী৷ ১৭টি অস্ত্রোপচারের পর এখন কিছুটা সুস্থ৷ তবে সারা গায়ে রয়েছে দগদগে ঘায়ের চিহ্ন৷ পুড়ে যাওয়া জায়গাগুলোর ত্বক মসৃণ রাখতে প্রতিদিন মালিশ করে দেন মা৷ নিজের কোনো বাড়ি নেই বলে মায়ের সাথেই বোনের বাড়িতে থাকেন ফরিদা৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
উগান্ডার ফ্লাভিয়া
ফ্লাভিয়ার ওপর এক আগন্তুক অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল ৫ বছর আগে৷ আজও ফ্লাভিয়া জানেন না, কে, কেন তাঁর ওপর হামলা চালালো৷ বিকৃত চেহারা নিয়ে অনেকদিন ঘরেই ছিলেন৷ বাইরে যেতেন না৷ এক সময় ফ্লাভিয়ার মনে হলো, ‘‘এভাবে ঘরের কোণে পড়ে থাকার মানে হয় না৷ জীবন এগিয়ে চলে৷ আমাকেও বেরোতে হবে৷’’
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আনন্দময় নতুন জীবন
এখন প্রতি সপ্তাহে একবার সালসা নাচতে যায় ফ্লাভিয়া৷ আগের সেই রূপ নেই, তাতে কী, বন্ধুদের কাছে তো রূপের চেয়ে গুণের কদর বেশি! ফ্লাভিয়া খুব ভালো নাচ জানেন৷ তাই একবার শুরু করলে বিশ্রামের সুযোগই পান না৷ এভাবে পরিবার আর বন্ধুদের সহায়তায় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন ফ্লাভিয়া৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
ভারতের নীহারি
নীহারির বয়স তখন ১৯৷ একরাতে আত্মহত্যা করার জন্য আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শরীরে৷ স্বামীর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি মনে হয়েছিল তখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
নতুন রূপ
যে ঘরটিতে বসে নীহারি তাঁর চুল ঠিক করছেন এটা ছিল বাবা-মায়ের শোবার ঘর৷ এখানেই নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন৷ দেয়াশলাইয়ের বাক্সে একটা কাঠিই ছিল৷ তা দিয়েই আগুন জ্বালিয়েছিলেন শরীরে৷ তবে এখন আর দুর্বল মনের মেয়েটি নেই নীহারি৷ নিজেকে সামলে নিয়ে একটা সংস্থা গড়েছেন৷ সংস্থাটির নাম, ‘পোড়া মেয়েদের রূপ’৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
পাকিস্তানের নুসরাত
দু-দুবার অ্যাসিড ছোড়া হয়েছে নুসরাতের ওপর৷ প্রথমে স্বামী আর তারপর দেবর৷ ভাগ্যগুণে বেঁচে আছেন নুসরাত৷ ভালোই আছেন এখন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
আশার আলো
দু-দুবার অ্যাসিড হামলার শিকার হওয়ায় মাথার অনেকটা চুলও হারিয়েছেন নুসরাত৷ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মাথার ক্ষতস্থান পুরোপুরি সারিয়ে চুল এবং আগের হেয়ারস্টাইল ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
বন্ধুদের মাঝে...
নিজের ভাবনা, যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে কিংবা গল্প করতে প্রায়ই অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ)-এ যান নুসরাত৷ সেখানে এমন অনেকেই আসেন যাঁদের জীবনও অ্যাসিডে ঝলসে যেতে বসেছিল৷ এখন সকলেই জানেন, তাঁরা আর একা নন৷
ছবি: Ann-Christine Woehrl/Echo Photo Agency
9 ছবি1 | 9
এর কয়েক দিনের মধ্যে লন্ডনে ফের অ্যাসিড হামলা হলে সেটা নিয়ে অনেকে কথা বলেন৷
শামীমা সোবহান নামে একজন ফেসবুকে বলেন, ‘লন্ডনে অ্যাসিড হামলা দিন দিন বেড়েই চলেছে৷ মুসলিম, নন মুসলিম, হেজাবধারী, হেজাব বিহীন, নারী বা পুরুষ নানান ধরনের মানুষের উপর অ্যাসিড হামলা হচ্ছে৷ ইউটিউব, নিউজ পোর্টাল – এ সব দেখেশুনে কোনো উপসংহারে আসা যাচ্ছে না যে কী কারণে এই হামলা বৃদ্ধি পাচ্ছে উক্ত ভদ্র জাতির মাঝে৷ যে যার মতো করে এর ব্যাখ্যা করেছে, যা কখনো বিশ্বাসযোগ্য বা কখনো অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে৷'
এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাব জানিয়ে তিনি বলেন, থাকুক সব কিছু গোপনে, তাদের সুট-কোর্টের স্মার্টনেস অমলিন থাকুক৷ কিন্তু যে কথাটি বলতেই হয়, এই অ্যাসিডদগ্ধ মানুষগুলি যে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে ফুটন্ত আগুনের তাপে দগ্ধ হচ্ছে তার কারণ হিসাবে কী বলবে লন্ডন?
অ্যাসিড নিক্ষেপ বন্ধ না হলে তারাও হয়ত একদিন বিতর্কিত হবে বিশ্বের চোখে৷ সর্বশেষ মঙ্গলবার দুই বাংলাদেশির উপর হামলার পরও সরব হয়েছেন অনেকে৷
সাংবাদিক আফসান চৌধুরী ফেসবুকে একটি খবর শেয়ার দিয়ে লেখেন, ‘যুক্তরাজ্য যেখানে সেখানে অ্যাসিড আক্রমণে লক্ষবস্তু বাংলাদেশিরা৷ হাই কমিশন কি সেখানে কিছু করছে?'