1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লন্ডনে প্রতিবাদ, কলকাতায় ফিরে আটক প্রবাসী চিকিৎসক

২১ জুন ২০২৫

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফরে আরজি কর আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এক প্রবাসী চিকিৎসক। এবার দেশে আসার পর তাকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা পুলিশ।

চিকিৎসক ধর্ষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ
আরজি কর আন্দোলন ভারত ছাড়িয়ে প্রভাব ফেলেছিল সংবাদের শিরোনামে পরিণত হয়েছিল বিশ্বজুড়ে ছবি: Satyajit Shaw/DW

আরজি কর আন্দোলনের আঁচ পৌঁছেছিল দূর প্রবাসেও। বিদেশের মাটিতে অন্য অনেক প্রবাসী ভারতীয়ের মতো প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন প্রবাসী চিকিৎসক রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লন্ডনের কেলগ কলেজে আমন্ত্রিত হয়ে ২৭ মার্চ বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন। শিশু ও নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত তার বক্তৃতা চলার সময়ে প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত চিকিৎসক রজতশুভ্র আরজিকরের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখনই প্রচারের আলোয় আসেন লন্ডনে দীর্ঘদিনের প্রবাসী, এখন অবসরপ্রাপ্ত এই চিকিৎসক।

রজতশুভ্র দীর্ঘদিন দেশছাড়া হলেও তার শিকড় রয়ে গিয়েছে কলকাতায়। দক্ষিণ কলকাতার হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে তার মা থাকেন। অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে এসেছেন তিনি। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সকাল থেকেই এই চিকিৎসককে নিয়ে জলঘোলা হচ্ছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে সংহতি জানাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি সাংসদ সুকান্ত মজুমদার শুক্রবার তার সঙ্গে দেখা করতে যান। এই সাক্ষাৎ ঘিরে তৈরি হয় গন্ডগোল।

হরিশ মুখার্জি রোডে যে জায়গায় রজতশুভ্রর শতাব্দীপ্রাচীন বাড়ি, সেটি হাই সিকিউরিটি জোনের মধ্যে পড়ে। সেখানে যাওয়ার পথে সুকান্তকে বাধা দেয় পুলিশ। এই খবর পেয়ে রজতশুভ্র নিজে সুকান্তর সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। ভবানীপুরের পূর্ণ সিনেমা হলের সামনে দুজনের সাক্ষাৎ ও সামান্য বাক্যবিনিময় হয়। সেই সময়ে রাস্তায় যানজট তৈরি হচ্ছে, এই কারণ দেখিয়ে তাদের সরিয়ে দিতে চায় পুলিশ।

এর ফলে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুলিশ রজতশুভ্রকে আটক করে। সুকান্ত ও ২৫ জন বিজেপি কর্মীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজারে। কিছুক্ষণ পরে ছেড়ে দেয়া হয় প্রবাসী চিকিৎসককে। এর পরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনি।

রজতশুভ্র বলেন, "আমাকে চোর, পকেটমারের মত রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। আমার জন্য যানজট তৈরি হয়নি। আমি বুলেভার্ডে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। সুকান্তর সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলেছি, ঘুরেই দেখি পুলিশ আমাকে ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে বড় কথা, যেভাবে পুলিশ আমাকে জোর করে গাড়িতে তুলেছে, তেমন কোনো অপরাধ আমি করিনি।"

প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, "আমি ২৫ বছর একটি সভ্য সুশিক্ষিত দেশে কাজ করেছি। এ ধরনের আচরণের কথা ভাবতে পারি না। আমি পুলিশকে বলেছি, আমার মা অসুস্থ। তাই ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন। এটুকুর জন্য কেবল আমি ধন্যবাদ জানাতে পারি।"

এ দিনের ঘটনা নিয়ে আইনি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রজতশুভ্র। তিনি বলেন, "আমি কোনোদিন আদালতে যাইনি। এ ব্যাপারে বিজেপির লিগাল সেলের সহায়তা নেব। আমার মা একবার উদ্বাস্ত হয়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। আমি মাকে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে পারি। কিন্তু এত সহজে দেশ ছাড়ব না। তবে আমি ব্রিটিশ নাগরিক। আমাকে এভাবে হেনস্থা করার জন্য জবাবদিহি করতে হবে।"

চিকিৎসকের ডিগ্রি নিয়ে জলঘোলা

রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল রজতশুভ্রকে সম্প্রতি একটি নোটিস পাঠিয়েছে। কাউন্সিলের নথিতে প্রবাসী চিকিৎসকের শুধু এমবিবিএস হিসেবে যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু অ্যানাস্থেসিস্ট হিসেবে তিনি যে কাজ করেছেন, সেই যোগ্যতার কথা আপডেট করা নেই কাউন্সিলে। তা সত্ত্বেও কীভাবে তিনি এ নিয়ে প্র্যাকটিস করলেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মেডিক্যাল কাউন্সিল।"

কাউন্সিলের সহকারী রেজিস্ট্রার দেবাশিস রায়ের বক্তব্য, "আমাদের কাছে একটা অভিযোগ এসেছিল। ওই চিকিৎসক অ্যানাস্থেসিস্ট হিসেবে বিদেশে কাজ করেছেন। কিন্তু মেডিক্যাল কাউন্সিলে তিনি রেজিস্টার্ড শুধু এমবিবিএস হিসেবে। এটা ভারতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিল আইন ২৬ ও ২৮ ধারার পরিপন্থী। অতিরিক্ত যোগ্যতা অর্জন করলে সেটা ২৬ নম্বর ধারায় নথিভুক্ত করতে হয়। আর ২৮ নম্বর ধারায় জানাতে হয় 'চেঞ্জ অফ প্লেস অফ প্র্যাকটিস'-এর বিষয়টি।

এই অভিযোগ পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছেন রজতশুভ্র। তিনি বলেন, "আমি ইংল্যান্ডে ডাক্তারি করি, রেজিস্ট্রেশনও সেখানকার। তাহলে পশ্চিমবঙ্গ মেডিক্যাল কাউন্সিলে আপডেটেড তথ্য জানানোর দায় আমার থাকবে কেন? ওই নোটিস ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।"

চিকিৎসক সমাজের একাংশ একে আরজি কর আন্দোলনের প্রতিশোধ হিসেবেই দেখছে। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সুবর্ণ গোস্বামী এই আন্দোলনের প্রথম সারির মুখ। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "রজতশুভ্র আরজিকর আন্দোলনের সময়ে সরব ছিলেন। প্রবাসীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারপর থেকেই মেডিক্যাল কাউন্সিল এক্তিয়ার বহির্ভূতভাবে রজতশুভ্রকে নিগ্রহ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অবিলম্বে হয়রানি বন্ধ করা উচিত।"

চিকিৎসক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস-এর সাধারণ সম্পাদক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "লন্ডনের কলেজে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার সময়ে প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে উনি প্রতিবাদ করেছিলেন আরজিকরের মর্মান্তিক ঘটনার। সেই কারণে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে মেডিক্যাল কাউন্সিল, যাতে ওর পেশাগত জীবনে ক্ষতি হয়।"

ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম-এর সদস্য অর্জুন দাশগুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "মেডিক্যাল কাউন্সিল হাস্যকর অভিযোগ তুলেছে। এদের মাধ্যমে চিকিৎসকদের হেনস্থা করা হচ্ছে। আরজি কর আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে হয়রানি করা হচ্ছে-- সেটা পুলিশ দিয়ে হোক বা মেডিক্যাল কাউন্সিল দিয়ে। এটাই ঘোর সন্দেহজনক।"

পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক চলছে

মেডিক্যাল কাউন্সিলের অভিযোগ যাই থাক, চিকিৎসককে আটক করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "এরকম ব্যবহার আধা ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছে কাম্য। সুকান্ত যে জোনে ছিলেন, সেটা জেড ক্যাটাগরির জোন নয়। রজতশুভ্রের বাড়ি জেড ক্যাটাগরি জোনের মধ্যেই। তাই সেখান থেকে তাকে হেঁটে আসতে হয়েছে। সুকান্ত একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী, তার বাড়িতে আসতে চেয়েছিলেন। রাজ্য সরকার তাকে আসতে দেবে না, এটা বুঝলাম। কিন্তু চিকিৎসক নিজে যদি দেখা করতে আসেন, তাকে আটকানো যায় কী করে? একজন দেখা করতে এসেছেন, তাকে আমি দেখা করতে দেব না, তার বদলে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হল, এটা বর্বর, অসভ্য বিষয়।"

তৃণমূল পর্যবেক্ষক ভাস্কর সিংহরায় বলেন, "বিজেপি ওখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে গিয়েছিল। তাই হাই সিকিউরিটি জোনে বিজেপি রাজ্য সভাপতি সাঙ্গপাঙ্গ ও দলীয় পতাকা নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে বলা হয়, চিকিৎসক বাড়িতে নেই। তবু সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে বিশৃংখল পরিস্থিতি তৈরি করেন। সে কারণেই পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। কারো সঙ্গে দেখা করতে দলীয় পতাকা নিয়ে যাওয়ার কথা নয়, অবস্থান করার কথা নয়। একা গেলে কে তাকে আটকাতো?"

ভাস্করের দাবি, "কেলগের ঘটনায় অনুষ্ঠানের সংগঠকরা ওই চিকিৎসককে প্রতিবাদ করার জন্য প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাকে বেরোতে হয়নি।"

কাউন্সিলের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, "প্রবাসী চিকিৎসক রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে ডাক্তার হিসেবে নথিভুক্ত। তিনি বাড়তি যোগ্যতা অর্জন করলে, সেই অনুযায়ী কোথাও প্র্যাকটিস করলে, মেডিক্যাল কাউন্সিলে জানানোর কথা। কাউন্সিলের এই আইন উনি লঙ্ঘন করেছেন। তাই নোটস ছিঁড়ে না ফেলে তিনি জবাব দিতে পারতেন।"

কিন্তু হঠাৎ বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত প্রবাসী চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন কেন, এ নিয়েও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, "সুকান্ত মজুমদার কৃতজ্ঞতা থেকেও রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যেতে পারেন, যে এরকম একটা ইস্যু বিদেশে তুলে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন। এমনটা বিজেপি চাইছে যে, মুখ্যমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়ুন। আবার এমন হতেই পারে যে, বিজেপির মতাদর্শের প্রতি সহমত পোষণ করেন রজতশুভ্র। তাই তিনি কেলগের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এটা বোঝা যাচ্ছে, তারপরে সুকান্ত তার বন্ধু হিসেবে উঠে এসেছেন। এখন তাদের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান। সুকান্ত সেই কারণে গিয়েছেন ওর বাড়ি।"

রজতশুভ্র কি রাজনীতিতে আসতে পারেন? অতীতে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। অনেক বিশিষ্ট মানুষ তৃণমূলেও যোগদান করেছেন। অধ্যাপক বলেন, "চিকিৎসক অবসর নিয়েছেন। তার পেশাগত দিক থেকে আর কিছু পাওয়ার নেই। তিনি ইংল্যান্ডের নাগরিক। এদেশে রাজনীতিতে আসতে গেলে তাকে নাগরিকত্ব পরিবর্তন করতে হবে। ভারতীয় নাগরিক না হলে তিনি এদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।"

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ