পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর লন্ডন সফরে আরজি কর আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এক প্রবাসী চিকিৎসক। এবার দেশে আসার পর তাকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা পুলিশ।
আরজি কর আন্দোলন ভারত ছাড়িয়ে প্রভাব ফেলেছিল সংবাদের শিরোনামে পরিণত হয়েছিল বিশ্বজুড়ে ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিজ্ঞাপন
আরজি কর আন্দোলনের আঁচ পৌঁছেছিল দূর প্রবাসেও। বিদেশের মাটিতে অন্য অনেক প্রবাসী ভারতীয়ের মতো প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন প্রবাসী চিকিৎসক রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লন্ডনের কেলগ কলেজে আমন্ত্রিত হয়ে ২৭ মার্চ বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন। শিশু ও নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত তার বক্তৃতা চলার সময়ে প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত চিকিৎসক রজতশুভ্র আরজিকরের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখনই প্রচারের আলোয় আসেন লন্ডনে দীর্ঘদিনের প্রবাসী, এখন অবসরপ্রাপ্ত এই চিকিৎসক।
রজতশুভ্র দীর্ঘদিন দেশছাড়া হলেও তার শিকড় রয়ে গিয়েছে কলকাতায়। দক্ষিণ কলকাতার হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে তার মা থাকেন। অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে এসেছেন তিনি। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের একটি চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সকাল থেকেই এই চিকিৎসককে নিয়ে জলঘোলা হচ্ছিল। তার পরিপ্রেক্ষিতে সংহতি জানাতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও বিজেপি সাংসদ সুকান্ত মজুমদার শুক্রবার তার সঙ্গে দেখা করতে যান। এই সাক্ষাৎ ঘিরে তৈরি হয় গন্ডগোল।
হরিশ মুখার্জি রোডে যে জায়গায় রজতশুভ্রর শতাব্দীপ্রাচীন বাড়ি, সেটি হাই সিকিউরিটি জোনের মধ্যে পড়ে। সেখানে যাওয়ার পথে সুকান্তকে বাধা দেয় পুলিশ। এই খবর পেয়ে রজতশুভ্র নিজে সুকান্তর সঙ্গে দেখা করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। ভবানীপুরের পূর্ণ সিনেমা হলের সামনে দুজনের সাক্ষাৎ ও সামান্য বাক্যবিনিময় হয়। সেই সময়ে রাস্তায় যানজট তৈরি হচ্ছে, এই কারণ দেখিয়ে তাদের সরিয়ে দিতে চায় পুলিশ।
এর ফলে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হয়। পুলিশ রজতশুভ্রকে আটক করে। সুকান্ত ও ২৫ জন বিজেপি কর্মীকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাজারে। কিছুক্ষণ পরে ছেড়ে দেয়া হয় প্রবাসী চিকিৎসককে। এর পরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনি।
রজতশুভ্র বলেন, "আমাকে চোর, পকেটমারের মত রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। আমার জন্য যানজট তৈরি হয়নি। আমি বুলেভার্ডে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। সুকান্তর সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বলেছি, ঘুরেই দেখি পুলিশ আমাকে ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে বড় কথা, যেভাবে পুলিশ আমাকে জোর করে গাড়িতে তুলেছে, তেমন কোনো অপরাধ আমি করিনি।"
প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, "আমি ২৫ বছর একটি সভ্য সুশিক্ষিত দেশে কাজ করেছি। এ ধরনের আচরণের কথা ভাবতে পারি না। আমি পুলিশকে বলেছি, আমার মা অসুস্থ। তাই ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন। এটুকুর জন্য কেবল আমি ধন্যবাদ জানাতে পারি।"
এ দিনের ঘটনা নিয়ে আইনি পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রজতশুভ্র। তিনি বলেন, "আমি কোনোদিন আদালতে যাইনি। এ ব্যাপারে বিজেপির লিগাল সেলের সহায়তা নেব। আমার মা একবার উদ্বাস্ত হয়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। আমি মাকে নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে পারি। কিন্তু এত সহজে দেশ ছাড়ব না। তবে আমি ব্রিটিশ নাগরিক। আমাকে এভাবে হেনস্থা করার জন্য জবাবদিহি করতে হবে।"
আরজি করে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুন থেকে মামলার রায়
আরজি করে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুন করার পাঁচ মাস নয় দিন পর রায় এলো। সঞ্জয় রায় দোষী সাব্যস্ত।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ ও খুন
৯ অগাস্ট ২০২৪: কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উদ্ধার হয়েছিল এক নারী চিকিৎসকের দেহ। অভিযোগ উঠেছিল, ওই চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। ঘটনার পাঁচ মাস নয় দিন পরে ১৮ জানুয়ারি, শনিবার সেই ধর্ষণ-খুনের মামলায় রায় ঘোষণা হলো শিয়ালদহ আদালতে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সিভিক ভল্যান্টিয়ার গ্রেপ্তার
১০ অগস্ট: ঘটনার তদন্তে নেমেই এক সিভিক ভল্যান্টিয়ারকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। পরে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তের ভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। সিবিআইও তদন্ত চালিয়ে ধৃত সিভিক ভল্যান্টিয়ারকেই ‘একমাত্র অভিযুক্ত’ হিসাবে বর্ণনা করে আদালতে চার্জশিট পেশ করে। তার দুই দিন পরেই নিহত ছাত্রীর বাড়িতে পৌঁছে তাঁর বাবা, মায়ের সঙ্গে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত
১৩ অগস্ট: সিবি আই তদন্তের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পাঁচ দিনের মাথায় সুপ্রিম কোর্ট নিজে থেকে এই বিষয়ে মামলা শুরু করে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নারীদের রাত দখলের ডাক
১৪ অগস্ট: কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা রাত দখলের ডাক দেন। নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে কাতারে কাতারে মানুষ ‘ন্যায়বিচার’ চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রাস্তায় নামেন। নজিরবিহীন ‘নাগরিক আন্দোলন’ দেখে কলকাতা সহ সারা দেশ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আরজি করে হামলা
১৪ অগস্ট: মধ্যরাতেই দুষ্কৃতী তাণ্ডব চলে আরজি কর হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ে। ভেঙে তছনছ করে ফেলা হয় সরকারি সম্পত্তি সহ আন্দোলনকারীদের অবস্থান মঞ্চ।
ছবি: Subrata Goswami/DW
লালবাজার অভিযান
২ সেপ্টেম্বর: কলকাতা পুলিশ কমিশনারের ইস্তফা চেয়ে মিছিল করে লালবাজার অভিযান জুনিয়র ডাক্তারদের। লালবাজারের দু-শো মিটার আগেই ব্যারিকেড করে আটকে দেওয়া হয় তাদের। সেখানেই অবস্থান শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। অবস্থান তার পরের দিন পর্যন্ত চলে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
পুলিশ কমিশনারের কাছে
৩ সেপ্টেম্বর: জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল কলকাতা পুলিশের তৎকালীন কমিশনার বিনীত গোয়েলের সঙ্গে দেখা করেন। দাবিসনদ-সমেত তার হাতে তুলে দেন একটি ‘প্রতীকী শিরদাঁড়া’।
ছবি: Subrata Goswami/DW
জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান শুরু
১০ সেপ্টেম্বর: সলটলেকের স্বাস্থ্যভবনের সামনে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবস্থান শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকের জন্য তাদের নবান্নে ডাকেন। কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি ছিল, বৈঠকের লাইভ স্ট্রিমিং করতে হবে। লাইভ স্ট্রিমিং না হওয়ায় সেই বৈঠক ভেস্তে যায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
জুনিয়র ডাক্তারদের মঞ্চে
১৪ সেপ্টেম্বর: হঠাৎ করেই সবাইকে চমকে দিয়ে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান মঞ্চে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সন্দীপ ঘোষ গ্রেপ্তার
১৪ সেপ্টেম্বরে: ধর্ষণ-খুনের ওই মামলায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকেও গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা আদালতে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিতে না পারায় সন্দীপ এবং অভিজিৎ দু’জনেই জামিন পান। অভিজিতের জেলমুক্তি হলেও সন্দীপ এখনও জেল হেফাজতে রয়েছেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সরানো হলে পুলিশ কমিশনারকে
১৪ সেপ্টেম্বর, দুই দিনের ব্যর্থ চেষ্টার পর মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে বৈঠক হয়। সরাসরি সম্প্রচার ছাড়াই এই বৈঠকে রাজি হন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সেখানে খানিক ‘পিছু হটে’ সরকার। সরানো হয় পুলিশ কমিশনার বিনীতকে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কর্মবিরতি উঠলো
২০ সেপ্টেম্বর: স্বাস্থ্যভবনের সামনে অবস্থান তুলে কর্মবিরতি আংশিক প্রত্যাহার করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আমরণ অনমশন শুরু
৫ অক্টোবর: ধর্মতলার মোড়ে আমরণ অনশন শুরু করেন জুনিয়র ডাক্তারেরা। সাত জুনিয়র ডাক্তারের পাশাপাশি বহু মানুষ অনশন মঞ্চে এসে প্রতীকী অনশনে অংশ নেন। ১৯ অক্টোবর অনশন মঞ্চে রাজ্যের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ আসেন এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ফোনে কথা বলান। ২১ অক্টোবর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দুই ঘণ্টার বৈঠকের পর ১৭ দিনের দীর্ঘ অনশনের অবসানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
সিবিআইের চার্জশিট
৭ অক্টোবর: ধর্ষণ ও খুনের মামলায় আদালতে চার্জশিট পেশ করে সিবিআই। কলকাতা পুলিশ যে পথে তদন্ত শুরু করেছিল, সিবিআইও সেই পথে হেঁটেই একজনকেই অভিযুক্ত হিসেবে দাড় করায়। ৪ নভেম্বর ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের বিরুদ্ধে চার্জ গঠিত হয় এবং ১১ নভেম্বর থেকে শিয়ালদহ আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ছবি: Subrata Goswami/DW
বিচার শুরু
১১ নভেম্বর: আরজি কর মামলায় মোট ৫০ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে শিয়ালদহ আদালতে। সেই তালিকায় রয়েছেন নিহত চিকিৎসকের পিতা, সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসার, কলকাতা পুলিশের তদন্তকারী অফিসার, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এবং নিহতের কয়েক জন সহপাঠী।
ছবি: Subrata Goswami/DW
রায় দিলেন বিচারক
১৮ জানুয়ারি: শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বান দাস রায় দিলেন। খুন এবং ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হলো সঞ্জয় রায়কে। আদালতে বিচারক অনির্বাণ দাস সঞ্জয়কে বলেন, আপনার বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং খুনের অভিযোগ। আপনার অপরাধ প্রমাণিত। দোষী সাব্যস্ত করা হলো। এই অপরাধে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন সাজা যাবজ্জীবন কারাবাস। সোমবার সাজা ঘোষণা করা হবে। সঞ্জয় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেন, তিনি নির্দোষ, তাকে ফাঁসানো হচ্ছে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
16 ছবি1 | 16
চিকিৎসকের ডিগ্রি নিয়ে জলঘোলা
রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল রজতশুভ্রকে সম্প্রতি একটি নোটিস পাঠিয়েছে। কাউন্সিলের নথিতে প্রবাসী চিকিৎসকের শুধু এমবিবিএস হিসেবে যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু অ্যানাস্থেসিস্ট হিসেবে তিনি যে কাজ করেছেন, সেই যোগ্যতার কথা আপডেট করা নেই কাউন্সিলে। তা সত্ত্বেও কীভাবে তিনি এ নিয়ে প্র্যাকটিস করলেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে মেডিক্যাল কাউন্সিল।"
কাউন্সিলের সহকারী রেজিস্ট্রার দেবাশিস রায়ের বক্তব্য, "আমাদের কাছে একটা অভিযোগ এসেছিল। ওই চিকিৎসক অ্যানাস্থেসিস্ট হিসেবে বিদেশে কাজ করেছেন। কিন্তু মেডিক্যাল কাউন্সিলে তিনি রেজিস্টার্ড শুধু এমবিবিএস হিসেবে। এটা ভারতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিল আইন ২৬ ও ২৮ ধারার পরিপন্থী। অতিরিক্ত যোগ্যতা অর্জন করলে সেটা ২৬ নম্বর ধারায় নথিভুক্ত করতে হয়। আর ২৮ নম্বর ধারায় জানাতে হয় 'চেঞ্জ অফ প্লেস অফ প্র্যাকটিস'-এর বিষয়টি।
এই অভিযোগ পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়েছেন রজতশুভ্র। তিনি বলেন, "আমি ইংল্যান্ডে ডাক্তারি করি, রেজিস্ট্রেশনও সেখানকার। তাহলে পশ্চিমবঙ্গ মেডিক্যাল কাউন্সিলে আপডেটেড তথ্য জানানোর দায় আমার থাকবে কেন? ওই নোটিস ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।"
চিকিৎসক সমাজের একাংশ একে আরজি কর আন্দোলনের প্রতিশোধ হিসেবেই দেখছে। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সুবর্ণ গোস্বামী এই আন্দোলনের প্রথম সারির মুখ। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "রজতশুভ্র আরজিকর আন্দোলনের সময়ে সরব ছিলেন। প্রবাসীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তারপর থেকেই মেডিক্যাল কাউন্সিল এক্তিয়ার বহির্ভূতভাবে রজতশুভ্রকে নিগ্রহ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অবিলম্বে হয়রানি বন্ধ করা উচিত।"
চিকিৎসক সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস-এর সাধারণ সম্পাদক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "লন্ডনের কলেজে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার সময়ে প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে উনি প্রতিবাদ করেছিলেন আরজিকরের মর্মান্তিক ঘটনার। সেই কারণে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে মেডিক্যাল কাউন্সিল, যাতে ওর পেশাগত জীবনে ক্ষতি হয়।"
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম-এর সদস্য অর্জুন দাশগুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "মেডিক্যাল কাউন্সিল হাস্যকর অভিযোগ তুলেছে। এদের মাধ্যমে চিকিৎসকদের হেনস্থা করা হচ্ছে। আরজি কর আন্দোলনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে হয়রানি করা হচ্ছে-- সেটা পুলিশ দিয়ে হোক বা মেডিক্যাল কাউন্সিল দিয়ে। এটাই ঘোর সন্দেহজনক।"
পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক চলছে
মেডিক্যাল কাউন্সিলের অভিযোগ যাই থাক, চিকিৎসককে আটক করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "এরকম ব্যবহার আধা ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছে কাম্য। সুকান্ত যে জোনে ছিলেন, সেটা জেড ক্যাটাগরির জোন নয়। রজতশুভ্রের বাড়ি জেড ক্যাটাগরি জোনের মধ্যেই। তাই সেখান থেকে তাকে হেঁটে আসতে হয়েছে। সুকান্ত একজন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী, তার বাড়িতে আসতে চেয়েছিলেন। রাজ্য সরকার তাকে আসতে দেবে না, এটা বুঝলাম। কিন্তু চিকিৎসক নিজে যদি দেখা করতে আসেন, তাকে আটকানো যায় কী করে? একজন দেখা করতে এসেছেন, তাকে আমি দেখা করতে দেব না, তার বদলে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হল, এটা বর্বর, অসভ্য বিষয়।"
তৃণমূল পর্যবেক্ষক ভাস্কর সিংহরায় বলেন, "বিজেপি ওখানে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে গিয়েছিল। তাই হাই সিকিউরিটি জোনে বিজেপি রাজ্য সভাপতি সাঙ্গপাঙ্গ ও দলীয় পতাকা নিয়ে গিয়েছিলেন। তাকে বলা হয়, চিকিৎসক বাড়িতে নেই। তবু সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে বিশৃংখল পরিস্থিতি তৈরি করেন। সে কারণেই পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। কারো সঙ্গে দেখা করতে দলীয় পতাকা নিয়ে যাওয়ার কথা নয়, অবস্থান করার কথা নয়। একা গেলে কে তাকে আটকাতো?"
ভাস্করের দাবি, "কেলগের ঘটনায় অনুষ্ঠানের সংগঠকরা ওই চিকিৎসককে প্রতিবাদ করার জন্য প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তাকে বেরোতে হয়নি।"
কাউন্সিলের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, "প্রবাসী চিকিৎসক রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলে ডাক্তার হিসেবে নথিভুক্ত। তিনি বাড়তি যোগ্যতা অর্জন করলে, সেই অনুযায়ী কোথাও প্র্যাকটিস করলে, মেডিক্যাল কাউন্সিলে জানানোর কথা। কাউন্সিলের এই আইন উনি লঙ্ঘন করেছেন। তাই নোটস ছিঁড়ে না ফেলে তিনি জবাব দিতে পারতেন।"
কিন্তু হঠাৎ বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত প্রবাসী চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন কেন, এ নিয়েও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, "সুকান্ত মজুমদার কৃতজ্ঞতা থেকেও রজতশুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যেতে পারেন, যে এরকম একটা ইস্যু বিদেশে তুলে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে অস্বস্তিতে ফেলেছেন। এমনটা বিজেপি চাইছে যে, মুখ্যমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়ুন। আবার এমন হতেই পারে যে, বিজেপির মতাদর্শের প্রতি সহমত পোষণ করেন রজতশুভ্র। তাই তিনি কেলগের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এটা বোঝা যাচ্ছে, তারপরে সুকান্ত তার বন্ধু হিসেবে উঠে এসেছেন। এখন তাদের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান। সুকান্ত সেই কারণে গিয়েছেন ওর বাড়ি।"
রজতশুভ্র কি রাজনীতিতে আসতে পারেন? অতীতে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। অনেক বিশিষ্ট মানুষ তৃণমূলেও যোগদান করেছেন। অধ্যাপক বলেন, "চিকিৎসক অবসর নিয়েছেন। তার পেশাগত দিক থেকে আর কিছু পাওয়ার নেই। তিনি ইংল্যান্ডের নাগরিক। এদেশে রাজনীতিতে আসতে গেলে তাকে নাগরিকত্ব পরিবর্তন করতে হবে। ভারতীয় নাগরিক না হলে তিনি এদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।"
রায়ের পর নির্যাতিতার বাবা-মা বলেছেন, ''আমরা বিচার পাইনি। আমার মেয়ে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ছিল, সেকানে এই কাণ্ড হলো। সিবিআই তা প্রমাণ করতে পারলো না যে এটা বিরল থেকে বিরলতম ঘটনা? এটা বিরলতম না হলে কোনটা হবে?'' মা বলেছেন, ''আমার ক্ষতি কেউ পূরণ করতে পারবে না। প্রমাণ হলো, সন্তান মেধাবী হলেই হবে না, বাবা-মা কে প্রভাবশালী হতে হবে। সঞ্জয় রায় একমাত্র খুনি নয় বলে প্রথম থেকেই আমরা মনে করি।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রায়ের পরই প্রতিবাদ মিছিল
সিনিয়র, জুনিয়র চিকিৎসকদের সংগঠনগুলি জানিয়ে দেয়, এই রায় তারা মানছে না। এরপর শিয়ালদহ আদালত চত্বর থেকে মৌলালি পর্যন্ত মিছিল করে যান তারা। মঙ্গলবার হেদুয়া থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত মিছিলের ডাক দেয়া হয়েছে। সিনিয়র ও জুনিয়র ডাক্তাররা বলেছেন, তারা এই রায়ে সন্তুষ্ট নন। তারা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। তারা চান, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সকলের শাস্তি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'লড়াই শেষ হয়নি'
জুনিয়র ডাক্তার আবির তালুকদার ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এটা লড়াইয়ের শেষ হতে পারে না। অনেক পথ চলতে হবে। অন্য দোষীদের সামনে আনতে হবে।''জুনিয়র চিকিৎসকদের নেতা আশফাকউল্লার বক্তব্য, ''আমরা রায় মেনে নিতে পারছি না। আমরা মনে করি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। এই যুদ্ধ চলছে, চলবে। আমরা উচ্চ আদালতে যাবো। শুধু সঞ্জয় নয়, আরো অনেকে জড়িত। তাদের ধরতে হবে।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের বিষয়টি নেই'
আরজি করের জুনিয়র ডাক্তার সৌরভ রায় ডিডাব্লিউকে বলেছেন, আমরা আশা করেছিলাম রায়ে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের বিষয়টি থাকবে। অন্য দোষীদের চিহ্নিত করার জন্য সিবিআইকে বলা হবে। এই ঘটনাকে বিরলের মধ্যে বিরলতম বলে ঘোষণা করা হবে। জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হবে। আমাদের দাবি পূরণ হলো না। ন্য়ায়বিচার পেলাম না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'যেরকম প্রমাণ দেয়া হয়েছে, সেরকম শাস্তি'
জুনিয়র ডাক্তার দেবজ্যোতি দাশগুপ্ত ডি ডাব্লিউকে বলেছেন, ''যেরকম প্রমাণ দিয়েছে, সেরকম রায় হয়েছে। আমরা সকলের শাস্তি চাই। আমরা আইনের উপর ভরসা রেখে আন্দোলন করেছি। অন্যদের শাস্তি চাইছি।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সঞ্জয়ের আইনজীবীর প্রতিক্রিয়া
সঞ্জয় রায়ের আইনজীবী সেঁজুতি চক্রবর্তী বলেছেন, ''আমরা বলেছিলাম, সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, বিরল থেকে বিরলতম মামলা হলেও যদি মানসিকতা বদলের সুযোগ থাকে, তখন ফাঁসি দেয়া হয় না। যখন বিকল্প শাস্তি নেই, তখনই ফাঁসির নির্দেশ দেয়া হবে। জেলে মানুষের সংশোধন হতে পারে। আমার মনে হয়, সঞ্জয় উচ্চ আদালতে যাবে। সঞ্জয় মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ''আমি ফাঁসি চেয়েছিলাম। বিচারক তার রায় দিয়েছেন, তা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমাদের হাত থেকে তদন্তভার নিয়ে নেয়া হয়েছিল। আমাদের হাতে কেসটা থাকলে অনেক আগেই ফাঁসির নির্দেশ পেতাম। আমরা তিনটি কেসে ৫৪ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ফাঁসির অর্ডার করিয়ে দিয়েছি। ''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কী বললেন বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য?
আইনজীবী ও সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “এটা স্বাভাবিক রায়। যথেষ্ঠ কঠিন সাজা। মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ঠিকই করেছেন বলে আমার মনে হয়। মৃত্যুদণ্ড থাকাই উচিত নয়। বিচারক সমস্ত তথ্য প্রমাণ ঘেটে এই রায় দিয়েছেন।”
ছবি: DW
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
রবিন দে ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''খুবই সুপারফিশিয়াল রায়। সকলেই জানেন, অনেকে মিলে এই জঘন্য কাজটা করেছে। ফরেনসিক ল্যাবরেটারি বলেছে, একাধিক মানুষের সিমেন পাওয়া গেছে। কিন্তু সে ব্য়াপারে কোনো রায় এলো না। অসমাপ্ত বিচার বলে মনে হয়। উচ্চ আদালতে নিশ্চয়ই আবেদন জানানো হবে।''