যুক্তরাজ্যে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একটি অনুষ্ঠান নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তুমুল আলোচনা৷ তিনি ‘মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দেননি' – এ কথা নিয়ে চ্যানেল ফোর প্রতিবেদনও করেছে৷
ছবি: Getty Images/K. Koall
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা বাসস-এর খবরে বলা হয়েছে, ‘‘মঙ্গলবার বিকেলে লন্ডনে ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটে (ওডিআই) ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন গল্প: নীতি, অগ্রগতি ও সম্ভাবনা' শীর্ষক অনুষ্ঠানে মূল বক্তা হিসেবে ভাষণ দেয়ার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
অন্যদিকে লন্ডনের চ্যানেল ফোর-এর প্রধান প্রতিবেদক অ্যালেক্স থমসন তাঁর এক প্রতিবেদনে দাবি করেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর করা সেদেশের মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দেননি৷ বরং প্রধানমন্ত্রী তখন হাসছিলেন৷ চ্যানেল ফোর তাদের প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছে, ‘‘মানবাধিকার বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী৷'
এ নিয়ে ডয়চে ভেলে ঢাকা থেকে টেলিফোনে কথা বলে লন্ডনে বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং সেখানকার আই অন টেলিভিশন চ্যানেলের পরিচালক (নিউজ অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স) বুলবুল হাসানের সঙ্গে৷ তিনি বলেন, ‘‘অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল ‘মিট দ্য প্রেস'-এর আদলে৷ সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়ন, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং ভবিষ্যত উন্নয়ন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন৷ প্রথমে তিনি নিজে বক্তব্য রাখেন এবং পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন৷ অনুষ্ঠাটির একজন সঞ্চালক ছিলেন৷''
বুলবুল হাসান
This browser does not support the audio element.
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা তুলে ধরার পাশাপাশি দেশের রাজনীতি নিয়েও কথা বলেন৷ নিজ সরকারের গত ন'বছরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, গণতান্ত্রিক উন্নয়ন ও ধারবাহিকাতা নিয়ে কথা বলার সময় তারেক রহমান প্রসঙ্গেও কথা বলেন শেখ হাসিনা৷ জানান বুলবুল হাসান৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীকে তারেক রহমান নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি৷ তিনি নিজে থেকেই রাজনৈতিক সিকিউরিটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘ব্রিটেন যেহেতু একটি মুক্ত দেশ, যে কেউ এখানে রাজনৈতি আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারে৷ কিন্তু তারেক রহমান একজন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি৷ তার অপরাধের জন্য আদালত তাকে সাজা দিয়েছে৷ অর্থাৎ রাজনৈতিক কারণে তারেক রহমান ব্রিটেনে আশ্রয় নেয়নি৷' প্রধানমন্ত্রী এ কথাও জানান যে তিনি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এই আলোচনা তারেক রহমানকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া বেগবান করবে৷ এছাড়া তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচ্ছন্নভাবে তাকে আশ্রয় দেয়ায় ব্রিটিশ সরকারের সমালোচনাও করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী৷''
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
9 ছবি1 | 9
বুলবুল হাসান জানান, ‘‘অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে চ্যানেল ফোর-এর সাংবাদিক বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, নিখোঁজ নিয়ে প্রশ্ন করেন৷ কিন্তু প্রশ্নটি নেয়া হয়নি৷ যিনি উপস্থাপনা করছিলেন তিনি মনে করেছেন অনুষ্ঠানটি যে ধারার তাতে এ আলোচনা আনুষ্ঠানটি বিঘ্নিতই করবে৷ ফলে উনি প্রশ্নটি নেননি এবং এড়িয়ে গেছেন৷ তিনি বলছিলেন, ‘উই আর রানিং আউট অফ টাইম৷ তাই আমরা যা প্রশ্ন নিয়েছি, এর বাইরে আর কোনো প্রশ্ন নিচ্ছি না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীও প্রশ্নটির প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাননি বা জবাব দেননি৷ তবে প্রধানমন্ত্রী হেসেছেন৷ ঐ সাংবাদিক এরপর বসে তাঁর প্রশ্নের জবাব না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন৷''
এরপর আর কোনো প্রশ্ন নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বুলবুল হাসান বলেন, ‘‘এরপরও প্রশ্ন নেয়া হয়েছে৷ আগের আলোচনার ধারাবাহিকতায় যেসব প্রশ্ন করা হয় শুধুমাত্র সেগুলোই নেয়া হয়েছে৷''
এদিকে আরেক প্রশ্নের জবাবে বুলবুল হাসান জানান, ‘‘আমরা যতটুকু জানি তারেক রহমানকে স্পেশাল ইমিগ্রেশন ক্রাইটারিয়ায় লন্ডনে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে৷ এটা অনেকটা অ্যাসাইলামের মতো৷ ব্রিটিশ সরকারের কাছে যারা রাজনৈতিক আশ্রয় চান, তাদের একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে ভিসা দেয়া হয়৷ আমরা জেনেছি, প্রথম দফায় ওনাকে অ্যাসাইলাম দেয়ার পর সেটা আবার বাড়ানো হয়েছে৷''