একজনের মা যৌনকর্মী৷ অন্যজন মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে দিনমান খেটে মরে কলকাতার রাস্তায়৷ বাঙালি ঘরের এই দুটি ছেলের অর্থের অভাব আছে বটে, কিন্তু ফুটবলপ্রতিভায় তাঁরা ধনী৷ সেই সুবাদে লন্ডন যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা!
বিজ্ঞাপন
রাজিব রায় আর অর্ক দে লন্ডনে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর৷ স্বপ্নপূরণ এখন শুধু সময়ের ব্যাপার৷ ভারত জুড়ে ক'দিন আগেই হয়ে গেল ফুটবলপ্রতিভার অন্বেষণ৷ সোনাগাছির যৌনকর্মীর ছেলে রাজিব আর রাস্তার ধারের ছোট্ট চা-দোকানের কর্মী অর্কও গিয়েছিলেন ভারতের গোয়া রাজ্যে অনুষ্ঠিত সেই কর্মসূচিতে নিজেদের যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে৷ ১২০ কোটিরও বেশি মানুষের দেশ থেকে মাত্র ১১ জন খুদে ফুটবলার বেছে নেয়ার সেই পরীক্ষায় সবাইকে চমকে দিয়েছে রাজিব আর অর্ক৷ কঠিন পরীক্ষায় দু'জনই পাশ৷ দু'জনই পেয়েছেন ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের ‘সকার স্কুল'-এ প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার সুযোগ!
এমন সুযোগ যে কোনো কিশোর ফুটবলারের জন্যই আজন্ম লালিত স্বপ্নপূরণের মতো৷ রাজিব আর অর্ক-র আনন্দটা একটু বেশি, কেননা, দু'জনই খুব গরিবঘরের সন্তান৷ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত দু'জনের ছোট্ট জীবনেই জমা হয়েছে অনেক বঞ্চনা আর অবহেলার তিক্ত অভিজ্ঞতা৷ রাজিব তো মা যৌনকর্মী বলে এতদিন শুধু ঘৃণাই পেয়ে এসেছেন৷ অর্ক পিতৃহীন৷ রাস্তার পাশে চা বিক্রি করে কোনোরকমে সংসার চালান তাঁর মা৷ গরিবের সন্তান বলে তিনি-ও কারো কাছ থেকে খুব একটা স্নেহ-ভালোবাসা পাননি৷ তবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবের ‘সকার স্কুল'-এর ডাক পাওয়ার পর দু'জনেরই ভাগ্য ফিরেছে৷ এলাকাবাসী এখন গর্ব করে তাঁদের নিয়ে৷
বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের কথা
পৃথিবীর আদিম এক পেশা পতিতাবৃত্তি৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চালু রয়েছে এই পেশা৷ বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? এই ছবিঘরে তাঁদের অবস্থা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যেভাবে যৌনপল্লীতে আগমন
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে হাজির হন মেয়েরা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিদরিদ্র্য পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা৷ এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের যৌনপল্লীতে আনা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir uz ZAMAN
যৌনকর্মীদের জন্য ‘গরুর ট্যাবলেট’
ফরিদপুরের সরকার অনুমোদিত যৌনপল্লীর ছবি এটি৷ অভিযোগ রয়েছে, পল্লীর মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করেন, যা সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়৷ গরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘ইনজেকশন’
বাংলাদেশের এক যৌনপল্লীর মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়৷ কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়৷ অপ্রাপ্তবয়সিদের স্বাস্থ্য ভালো করতে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় বলে জানান ৫০ বছর বয়সি রোকেয়া৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
অধিকাংশ যৌনকর্মী ‘স্টেরয়েড আসক্ত’
আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থা একশনএইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে৷ তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর৷ বাংলাদেশে দু’লাখের মতো যৌনকর্মী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ
স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একশনএইড৷ সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, ‘‘ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়৷’’
ছবি: GMB Akash
এইচআইভি সংক্রমণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস রোগ হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় প্রকাশ হয়৷ তবে ঠিক কতজন যৌনকর্মী এইচআইভি আক্রান্ত তার হালনাগাদ কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি৷ অনেকক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে খদ্দেরের অনীহা যৌনকর্মীদের মাঝে যৌনরোগ ছড়াতে সহায়ক হচ্ছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ যৌনকর্মী
বাংলাদেশের যৌনপল্লীগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে৷ আর এই পেশায় যাঁরা একবার প্রবেশ করছেন, তাঁদের জীবনেও নানা ঝুঁকি থাকে৷ পতিতাপল্লীতে হামলার খবর কিন্তু মাঝেমাঝেই শোনা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
শত বছরের পুরনো পল্লী উচ্ছেদ
মাদারিপুরের পতিতাপল্লীটি ছিল শত বছরের পুরনো৷ গত বছর এই পল্লী উচ্ছেদ করেছেন স্থানীয়রা৷ এমনকি পল্লীটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের আদেশও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ সেখানে পাঁচশ’র মতো যৌনকর্মী বাস করতেন৷ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের একটি পতিতাপল্লীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এ রকম উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছেন আরো অনেক যৌনকর্মী৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
মধ্যপ্রাচ্যে ‘যৌনদাসী’ বাংলাদেশের মেয়েরা!
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা৷ এ সব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
9 ছবি1 | 9
সুযোগটা পেয়ে রাজিব খুব গর্বিত৷ কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ মা-কে বাঁকা চোখে দেখলেও তাঁর কাছে মা পৃথিবীর আর সব শিশুর মায়ের মতোই প্রিয়৷ বার্তা সংস্থা এএফপিকে রাজিব বলেছে, ‘‘যৌনকর্মীর সন্তান বলে আমি মোটেই লজ্জিত নই৷ আমার জীবনে মা-ই সবচেয়ে বড় প্রেরণা৷ আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মা-কে যৌনপল্লী থেকে দূরে নিয়ে যেতে চাই৷''
রাজিবের মা-ও তা-ই চান৷ অভাবের তাড়নায় ‘নিষিদ্ধপল্লী'-র বাসিন্দা হয়েছেন তিনি৷ অন্যরা তো বটেই, এমনকি দেহের ক্ষুধা মেটাতে যাঁরা তাঁর কাছে আসেন, প্রকাশ্যে তাঁরাও অশ্রদ্ধার চোখেই দেখেন তাঁকে৷ রাজিব সংসারের দারিদ্র্য দূর করার সুযোগ পেয়েছে জেনে তাঁর মা-ও তাই খুশি৷ ছেলে যাতে লন্ডন গিয়ে ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ আরো সুগম করে আসতে পারে– সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে এই বর পাওয়ার আশায় প্রতিদিন মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করেন তিনি৷
রাজিবের প্রিয় ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো৷ অর্ক ভালোবাসে ব্রাজিলের সাম্বা ফুটবল৷ তিন বছর আগে ক্যানসারে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাবা নিজে তাঁকে ফুটবল প্রশিক্ষন দিতেন৷ বাবা ছিলেন ব্রাজিল আর ব্রাজিলের জীবন্ত কিংবদন্তি পেলের ভক্ত৷ পেলের মতো অর্কও স্ট্রাইকার৷ পাড়ার খেলায় সুযোগ পেলেই গোল করেন৷ কোনো ম্যাচে গোল করা মানেই অন্য কোনো দলের হয়ে টাকার বিনিময়ে খেলার সুযোগ পাওয়া৷ এমন সুযোগ প্রায়ই পান অর্ক৷ ফুটবল খেলে যা আয় হয় তার পুরোটাই তুলে দেন তিনি মা সুচন্দার হাতে৷
আজকাল সুচন্দাও শুধু চায়ের দোকান নিয়ে বসে নেই৷ প্রতিদিন সময় করে তিন মাইল দূরের মন্দিরে হেঁটে হেঁটে যেতে হয় তাঁকে৷ রাজিবের মায়ের মতো ঈশ্বরের কাছে তাঁরও একটাই প্রার্থনা – ছেলে বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নপূরণের পথ খুঁজে পেয়েছে, ঈশ্বর যেন মুখ না ফেরান!