লাইভ স্ট্রিমিংয়ে বদলে যাচ্ছে মিডিয়া
৩১ জুলাই ২০২০ভাবুন, রাফায়েল নাদাল আর ফেডেরার গল্প করছেন তাদের টেনিস ভুবন আর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে৷ কিংবা নাদাল আর মারের মধ্যে চলছে নানা খুনসুঁটি৷ ফুটবলের ভদ্রস্থ মানুষ স্প্যানিশ তারকা আন্দ্রে ইনিয়েস্তা তুলে ধরছেন তার জীবনের দর্শন আর অজানা কাহিনী৷ ক্রিস মার্টিন, জন লিজেন্ড, বুনো, মারায়া ক্যারি থেকে শুরু করে বিশ্ব সঙ্গীতের তারকারা একের পর এক গান গেয়ে দর্শক মাতিয়ে চলছেন৷ অথবা অপরাহ উইনফ্রা মুখোমুখি ইদ্রিস এলবা আর তার স্ত্রীর সঙ্গে৷
এমন মারদাঙ্গা সব আয়োজন অথচ কোনটিই টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা প্রতিষ্ঠিত কোন স্ট্রিমিং প্লাটফর্মেও নয়৷ সরাসরি প্রচার হচ্ছে ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক, টুইটার কিংবা ইউটিউবে৷ নিজেদের অ্যাকাউন্ট বা চ্যানেলে৷ স্বাভাবিক সময়ে হয়তো যা কেউ চিন্তাও করেননি ঠিক এমনটাই ঘটেছে করোনার এই মহামারিকালে৷ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে তারকা সবাই যুক্ত ছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷ কোয়ারান্টিন বা গৃহবন্দি জীবনের গল্প তারা বিনিময় করেছেন একে অন্যের সঙ্গে৷ শিল্পীরা ভক্তদের বিনোদন দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তহবিলও সংগ্রহ করেছেন স্বাস্থ্যকর্মী আর দুর্গতদের সহায়তায়৷
সেই এপ্রিলে নাদাল তার ভক্তদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন, দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ফেডেরার আর মারের সঙ্গে মাঠে নামবেন তিনি৷ তবে রেকেটে নয়, কোর্টেও নয়৷ হবে কথার লড়াই, ইনস্টাগ্রামে৷ কিন্তু ১৯ বারের গ্র্যান্ড স্লাম চ্যাম্পিয়নের জন্য অতিথিদের লাইভে যুক্ত করাটা মোটেও সহজ ছিল না৷ অনেকটা ভজঘট অবস্থাই পাকিয়ে ফেললেন তিনি৷ এ নিয়ে কম যান না ফেডেরার আর মারেও৷ সেই লাইভের কমেন্টস বক্সেই নাদালকে নাস্তানুবাদ করেছেন তারা৷ যেমনটা মারে লিখেছিলেন, ‘‘বাহ অসাধারণ! ৫২ বার ফ্র্যাঞ্চ ওপেন জিততে পারেন তিনি (নাদাল), কিন্তু ইন্সটাগ্রাম চালাতে পারেন না৷'' সে যাই হোক শেষ পর্যন্ত তাদের আলোচনাটি কয়েক লাখ দর্শক সরাসরি উপভোগ করেছেন৷
বিনোদন জগতের খুব কম তারকাই পাওয়া যাবে যিনি এরপর সামাজিক মাধ্যমে লাইভে আসেননি৷ মজার বিষয় হচ্ছে অনেক টিভি অনুষ্ঠানও এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভ স্ট্রিমিং হয়েছে৷ অ্যামেরিকার বিভিন্ন চ্যানেলের লেইট নাইট শো গুলোর হোস্টরা নিজেদের ঘর থেকে চমক উপহার দিয়েছেন একের পর এক৷ জনপ্রিয় কমেডিয়ান ও উপস্থাপক ট্রেভর নোয়াহতো তার ‘দ্য ডেইলি সোশ্যাল ডিসটেন্সিং শো’-নিয়ে ইউটিউবে ৮০ লাখ সাবস্ক্রাইবারের সামনে হাজির হয়েছেন প্রতিদিন৷
অ্যাপলের ফ্রি টিভি সিরিজে ‘অপরাহ টকস কভিড নাইনটিন'- এ নিয়মিত এসেছেন অপরাহ উইনফ্রে৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে লাইভ কনসার্ট ‘টুগেদার অ্যাট হোম'- এ নিজেদের ঘর থেকে যোগ দিয়েছেন সেলিন ডিওন, আন্দ্রে বোসেল্লি, লেডি গাগা, পল ম্যাককার্টনি, এল্টন জন, জেনিফার লোপেজ, টেইলর সুইফট থেকে শুরু করে সঙ্গীত অঙ্গনের সব জীবন্ত কিংবদন্তীরা৷ ইউ টু ব্যান্ড এর বুনোতো ফেসবুক লাইভে এসে তার নতুন গানই প্রকাশ করে ফেললেন এবার৷
এই লাইভ স্ট্রিমিংয়ের তোড়ে সবচেয়ে মজার ব্যাপার যেটি ঘটেছে তা হল তারকারা দর্শকের হৃদয়ের আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এসেছেন৷ স্টুডিওর ঝলমলে আলো কিংবা চেহারা বদলে দেয়া মেকআপের প্রলেপ ছিল না তাদের মুখে৷ ছিল না ক্যামেরার পারফেক্ট ফোকাস, হোয়াইট ব্যালেন্স কিংবা চকচকে রেজ্যুলেশন বজায় রাখার তাড়না৷ মোবাইলে আর আট দশজন যেমন লাইভে হাজির হতে পারেন ঘর বা ঘরের বাইরে থেকে তেমনি তারাও হাজির হয়েছেন৷ পর্দার এতদিনের তারকা আর সাধারণের মোটাদাগের যে দূরত্বও তা যেন অনেকটা ঘুঁচে গেছে এর মধ্য দিয়ে৷
শুধু তাই নয়, সুযোগের অভাবে আড়ালে পড়ে থাকা অনেকেও ডিজিটাল দুনিয়ার পাদপ্রদীপের আলোয় নতুন ধরা পড়েছেন৷ লকডাউনে সোশ্যাল মিডিয়ার সার্বক্ষণিক কনটন্ট শিকারীদের বদৌলতে বিশাল ফ্যান ফলোয়ারও গড়েছেন অনেকে৷
সব মিলিয়ে লাইভ স্ট্রিমিংয়ের এই ট্রেন্ড সীমাবদ্ধ ছিল না কোন মহাদেশ, দেশ কিংবা কোন একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে৷ সীমাবদ্ধ ছিল না তারকাদের মধ্যেও৷ সাধারণের মাঝেও যে অসাধারণত্ব রয়েছে সেটিও বড় পরিসরে মানুষ জানতে পেরেছেন৷ কোয়ারান্টিনের সময়ে ইটালির বাসিন্দাদের ব্যালকনি মিউজিকের নানা ভিডিও সারা বিশ্বের মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে৷
পৃথিবীতে কোন প্রযুক্তিগুত সুবিধা বা সেবাই এখন আর খুব বেশিদিন মানুষের মন যোগাতে পারে না৷ সময়ের ব্যবধানে তার নতুন কিছু না কিছু চাই৷ সোশ্যাল মিডিয়ার টেক্সট, লিংক, অডিও আর প্রথাগত ভিডিও কনটেন্টের স্তূপে মানুষ যেন অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছিল এরিমধ্যে৷ লাইভ স্ট্রিমিং জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল ক্রমশই৷ এই ট্রেন্ডস মূল স্রোত হয়ে উঠতে কিছুটা সময় হয়তো লাগত৷ কিন্তু করোনায় তা অনেকটা ঘূর্নিঝড়ের মতোই হাজির হল সবার কাছে৷
হোম অফিসে কর্পোরেট দুনিয়ার মিটিং থেকে শুরু করে সাধারণের বিনোদন কিংবা যোগাযোগের অনিবার্য মাধ্যম হয়ে উঠেছে লাইভ ভিডিং স্ট্রিমিং৷ টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে যার স্বর্ণযুগের কেবল সূচনা ঘটেছে৷
প্রযুক্তির এই পালাবদলে মিডিয়া জগৎ কতটা বদলে যাবে কিংবা কী ধরনের নেতিবাচক উপসর্গ তৈরি হবে, কতদিনই বা কতদিনইবা আমাদের মোহবিষ্ট করে রাখবে তা-ই দেখার বিষয়৷