বাংলাদেশে ভেজাল ওষুধ নির্ধারণ করার মতো জনবল ও কার্যকারিতা নেই৷ কোম্পানিগুলো মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন করে লাইসেন্স নেয়, পরে নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার করে৷ জানান জাতীয় ভেজাল প্রতিরোধ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এসএম মোরশেদ৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে: আপনারা ভেজাল ওষুধ নিয়ে বহুদিন ধরে কাজ করছেন৷ বাংলাদেশে ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য এত বেশি কেন?
এসএম মোরশেদ: বাংলাদেশে ভেজাল ওষুধ নির্ধারণ করার মতো সরকারের পক্ষ থেকে যে জনবল রয়েছে, তা যথেষ্ট নয়৷ একেবারেই অপ্রতুল৷ সেজন্য ভেজাল প্রতিরোধে গত প্রায় আট বছর ধরে কাজ করছি আমরা৷ আমরা ভেজাল খাদ্যসামগ্রি ও ওষুধ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচেতন করার জন্য জেলায় জেলায় প্রচারণা চালাচ্ছি৷ এ সব প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে কথা বলছি৷ আসলে সব কিছুতেই তো ভেজাল৷ যে কোনো ওষুধ কোম্পানিতে গেলে দেখবেন যে, তারা যখন লাইসেন্সটা নেয়, তখন মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন করেই লাইসেন্সটা নেয়৷ কিন্তু লাইসেন্স পাওয়ার পর, তারা আর মানসম্মত ওষুধ তৈরির দিকে খেয়াল রাখে না৷ তখন নিম্নমানের কাঁচামাল দিয়ে ওষুধ উৎপাদন করে৷ ফলে এর ভুক্তভোগী হন সাধারণ মানুষ৷ অথচ সাধারণ জনগণ পয়সা দিয়েই এই ওষুধ কিনছেন৷ অথচ তাঁদের রোগ প্রতিরোধে তা কাজে আসছে না৷ তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন৷
ভেজাল ওষুধে মৃত্যুর কয়েকটি ঘটনা
নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের কারণে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশু সহ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K.Remmers
বাংলাদেশে ৭৬ শিশুর মৃত্যু
নব্বইয়ের দশকে ‘ফ্ল্যামোডল’ নামক এক প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে ৭৬ জন শিশুর মৃত্যু হয়৷ ঐ ঘটনায় অ্যাডফ্লেম কোম্পানির বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় হয় ২০১৪ সালে৷ এতে তিনজনকে ১০ বছরের সাজা দেয়া হয়৷ পরের বছর বিসিআই ফার্মা নামে আরেক কোম্পানির পরিচালকসহ (ছবি) ছয় জনকে একই অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ ফ্ল্যামোডল সিরাপে ডাইইথাইলিন গ্লাইকল পাওয়া গিয়েছিল, যা শিল্প কারখানায় রাসায়নিক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Str
২৮ শিশুর মৃত্যু, কিন্তু সবাই খালাস
রিড ফার্মা নামে এক ওষুধ প্রস্তুতকারীর তৈরি ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে সারা দেশে ২৮ শিশু মারা যাওয়ার অভিযোগ এনে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২০০৯ সালে আদালতে মামলা করেছিল৷ কিন্তু তদন্তে গাফিলতির কথা বলে ২০১৬ সালের নভেম্বরে ঐ কোম্পানির মালিকসহ পাঁচজনকে বেকসুর খালাস দেন আদালত৷ ২০০৯ সালে তোলা উপরের ছবিতে শারমীনকে দেখা যাচ্ছে৷ সেও ভেজাল ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল৷ পরে সুস্থ হয়৷
ছবি: picture alliance/Photoshot
ম্যালেরিয়ার ওষুধ নকল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে ২০১০ সালে বিশ্বের ৬ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা যান৷ এ সব মৃত্যুর জন্য নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করা হয়৷ ২০১০ সালে ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ম্যালেরিয়ার ওষুধ নকল ছিল বলে জানানো হয়৷ ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ পরীক্ষা করে এ সব তথ্য পান গবেষকরা৷
ছবি: AP
যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু
২০০৭-২০০৮ সালে চীন থেকে যাওয়া নকল হেপারিনের (যে ওষুধ রক্ত জমাট প্রতিহত করে) কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/chromorange/R. Roeder
নাইজেরিয়ায় শিশুর মৃত্যু
২০০৯ সালে ‘মাই পিকিন’ নামে একটি ভেজাল সিরাপ সেবনের কারণে ৮৪ জন শিশুর প্রাণ গিয়েছিল৷ সিরাপের মধ্যে ডাইইথাইলিন গ্লাইকল পাওয়া গিয়েছিল৷
ছবি: DW/M. Kindzeka
হৃদরোগের ওষুধে ভেজাল
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে সরকারি ‘পাঞ্জাব ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিওলজি’ থেকে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হৃদেরাগের ওষুধ খেয়ে ২০১২ সালে একশ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়৷ পরে পরীক্ষা করে ওষুধে ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গিয়েছিল৷ ছবিতে পাকিস্তানের একটি সরকারি হাসপাতালের সামনে রোগীদের দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Merten
পানামায় কাশির সিরাপে বিষ
২০০৬ সালে দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা না জেনে কাশির ওষুধে ডাইইথাইলিন গ্লাইকল মিশিয়েছিলেন৷ সেই ওষুধ খেয়ে ৩৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে সেই সময় দাবি করা হয়েছিল৷ কয়েকটি চীনা কোম্পানি গ্লিসারিনের নামে এই বিষ পানামায় রপ্তানি করেছিল৷ ছবিতে পানামার এক শিশুকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/C.Jasso
7 ছবি1 | 7
ভেজাল ওষুধের কারণে শারীরিক অসুস্থতা বা মৃত্যুর ঘটনা কি ঘটে? এর কোনো পরিসংখ্যান আছে আপনাদের কাছে?
হ্যাঁ, আমাদের কাছে তথ্য আছে৷ সেসব তথ্য নিয়ে আন্দোলন করার কারণে প্রায় ৫২ টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকার নোটিস পাঠিয়েছে৷ ২০টি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং বাকিগুলো প্রক্রিয়াধীন আছে৷
কোন লক্ষণগুলো দেখে বোঝা যায় যে ওষুধগুলো ভেজাল?
খোলা বাজারে বিশেষ করে চর্ম এবং যৌন রোগের ভেজাল ওষুধ বিক্রি হয়ে থাকে৷ এগুলো খেলে ক্যানসারের উপসর্গ দেখা দেয়, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়৷ এ ধরনের নিম্নমানের ওষুধ খেয়ে মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে৷ কিন্তু এগুলো নিয়ে থানায় কেউ অভিযোগ করে না৷ বাংলাদেশে চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসার কারণে এ সব ভেজাল ওষুধ খেয়ে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
Interview Morshed Final - MP3-Stereo
দেশে আগাছার মতো ক্লিনিক গজিয়ে উঠছে, সেখানে ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য কতটা?
সরকারি হাসপাতালগুলোতে কিছু ওষুধ দেয়া হয়৷ আর বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হয় বেশি৷ ছোটখাটো বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে প্রায় ৯০ ভাগ ওষুধই ভেজাল৷
গ্রাম না শহর? কোথায় ভেজাল ওষুধ বেশি বিক্রি হয়?
ওষুধ যে ভেজাল হতে পারে – গ্রামের মানুষ তা চিন্তাও করতে পারেন না৷ তাঁদের কল্পনাতেও আসে না এটা৷ শহরের মানুষ এ বিষয়ে কিছুটা সচেতন৷ শহরে কিছুটা মনিটরিংও হয়৷ ওষুধ কোম্পানিগুলো গ্রামে-গঞ্জে এই ওষুধ ছড়িয়ে দেয় এবং চিকিৎসকদের উপঢৌকন দেয়, যাতে তাঁরা প্রেশকিপশনে এই ওষুধের নাম লেখেন৷ তাছাড়া গ্রামের অনভিজ্ঞ মানুষদের ওষুধের দোকানের কর্মচারীরা ওষুধ দিয়ে থাকে কোনো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই৷ তারাই বলে দেয় কোন রোগের কী ওষুধ৷
ভেজাল ওষুধের কারণে গর্ভবতী নারীরা কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন?
হ্যাঁ, তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন৷ কিন্তু হাসপাতালগুলো এগুলো চেপে রাখে, যাতে তা গণমাধ্যমে না আসে৷
এর প্রতিকার কী?
প্রতিকার পাওয়ার জন্য জনসচেতনতার বিকল্প নেই৷ তাই আমরা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছি৷ আমরা বিভিন্ন সেমিনার করছি৷ যেসব কোম্পানি সরকারের ছত্রছায়ার আছে, তারা আমাদের পাত্তা দিতে চায় না৷ তারা পেশীশক্তি ব্যবহার করে আমাদের এই সচেতনতা বৃদ্ধি রোধ করার চেষ্টা করে৷ আসলে বাংলাদেশে যে আইন আছে, সেই আইনেরও প্রয়োগ নেই৷
অতিরিক্ত ওষুধ সেবন মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে
বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের ঔষুধ সেবনে মৃত্যু – এরকম খবর প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হতে দেখা যায়৷ ঘুমের ওষুধ, ব্যথা বা অন্য ওষুধ একটা, দুটো করে খেতে শুরু করে অনেকের এক সময় নেশা হয়ে যায়৷ ছবিঘরে পাবেন ওষুধে আসক্তি থেকে ফেরার উপায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. May
নীরব নেশা
ঘুম আসছেনা বা মনটা উতলা, অশান্ত৷ ভয়, উত্তেজনা বা খুব অস্থির লাগছে৷ এসব ক্ষেত্রে অনেকেই মনে করেন, ওষুধ সেবন করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আর এভাবেই শুরু৷ ঘুমের ওষুধ এবং সেডেটিভ অর্থাৎ নিস্তেজ বা শান্ত রাখার ওষুধ অনেকে সেবন করেন এর ভয়াবহ পরিণতির কথা না ভেবেই৷ জার্মানিতে আনুমানিক ১.২ মিলিয়ন মানুষ এসব ওষুধের ওপর নির্ভরশীল৷ এই নেশাকে বলা হয়ে থাকে ‘নীরব আসক্তি’৷
ছবি: picture alliance/Arco Images GmbH
মদ্যপান করার চেয়েও তাড়াতাড়ি নেশা এনে দেয়
‘‘অনেকের ক্ষেত্রেই রোগী এবং ডাক্তার খেয়ালই করেন না যে এসব ওষুধ রোগীকে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যেই সেই ওষুধের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে৷’’ একথা বলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ব়্যুডিগার হলৎসবাখ৷ তিনি আরো জানান, কিছু ঘুমের ওষুধ এবং সেডেটিভ মদ্যপান করার চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি আসক্তি বা নেশা এনে দেয়৷
ছবি: Fotolia/Paul Schwarzl
কম ডোজ থেকেও সাবধান !
অনেকে হয়তো দিনে মাত্র একটি ট্যাবলেট সেবন করেন৷ কাজেই বুঝতেই পারেন না যে তারা ধীরে ধীরে ওষুধে আসক্ত হচ্ছেন৷ ওষুধে এক-আধদিন বিরতি দিলেই কেমন যেন শরীর খারাপ বা ঘুমের সমস্যা হয়৷ তখন আবার ওষুধ খেতে হয়৷ এটাই যে আসক্তি, প্রথমে তা বেশিরভাগ মানুষই বোঝেন না৷
ছবি: Fotolia/Yuri Arcurs
ওষুধ সেবনের আগে চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দিন
প্রথমত, শুধু স্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকার হলেই ওষুধ খাবেন এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে এবং এর কোনো বিকল্প চিকিৎসা আছে কিনা ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন৷ দ্বিতীয়ত, ওষুধ যতটুকু ডোজ দরকার, ঠিক ততটুকুই খাবেন৷ তার চেয়ে একটুও বেশি নয়!
ছবি: Colourbox
পরামর্শ
তৃতীয়ত, ওষুধ অল্প সময়ের জন্য – অর্থাৎ চার সপ্তাহের কম সময় সেবন করুন৷ চতুর্থত, ওষুধ চট করে ছেড়ে না দিয়ে আস্তে আস্তে ওষুধের মাত্রা কমিয়ে দিন৷ তবে অবশ্যই এ নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে৷ পরামর্শ ডা. হলৎসবাখ-এর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. May
5 ছবি1 | 5
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷