সিরিয়া যুদ্ধে এ পর্যন্ত এক থেকে দেড় লাখ মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন৷ অনেকেরই সন্ধান নেই ১১ বছর ধরে৷ প্রিয়জনের জন্য স্বজনদের অপেক্ষার পালা শেষ করতে এবার নতুন পরিকল্পনা সাজাচ্ছে জাতিসংঘ৷
বিজ্ঞাপন
নিখোঁজদের বিষয়ে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না বলে অতীতের কর্মপরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তনও আনছে জাতিসংঘ৷ তবে পদক্ষেপ হবে নতুন সংস্থা গড়া৷
নিখোঁজ সিরীয়দের সন্ধানে অগ্রগতি নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ নতুন একটি সংস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবছে- এ খবরকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই৷ ‘দ্য সিরিয়া ক্যাম্পেইন' নামের এক সংস্থার কমিউনিকেশন ডিরেক্টর সারা হাশাশ মনে করেন, ‘‘দীর্ঘ কয়েক বছরের নীরবতা এবং নিষ্ক্রিয়তার পর এমন একটি মেকানিজম চালু করলে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আশা করা যেতেই পারে৷ এতে (স্বজন হারিয়েছেন) এমন পরিবারগুলোতে আশার সঞ্চার করবে৷''
তবে নোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেরেমি সারকিন মনে করেন, সদিচ্ছা না থাকলে সংস্থা গড়ে কিছু হবে না৷ ডয়চে ভেলেকে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের এই অধ্যাপক বলেন, ‘‘আশা করি তারা রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করবে৷''
সিরিয়া যুদ্ধ শুরু হয়েছে ২০১১ সালে৷ সুতরাং এক থেকে দেড় লাখ নিখোঁজ সিরীয়কে খুঁজে বের করার ব্যর্থতার ইতিহাসের সূচণা ১১ বছর আগে৷ সাইপ্রাসের অনেক নাগরিক ১৯৭০-এর দশক থেকে নিখোঁজ৷ তাদের খুঁজে বের করায় জাতিসংঘের ব্যর্থতার ইতিহাস ৫০ বছরের চেয়েও দীর্ঘ৷
তাই সারকিন মনে করেন, সবাইকে ফিরে পাওয়ার আশা করা খুব বাস্তবসম্মত নয়৷ তাই তিনি চান যারা এখনো নির্যাতন সহ্য করে খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বেঁচে আছেন তাদের সন্ধান পাওয়ার চেষ্টাকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত, ‘‘যারা এখন খুব বিপদে আছে, তবে বেঁচে আছে, আমি চাই তাদের জীবন আগে রক্ষা করা হোক৷যদি তাদের বিষয়ে তথ্য কোনোভাবে পাওয়া যায়, সেগুলো পাঠিয়ে আমরা সিরিয়াকে বলতে পারবো- ওরা যে তোমার কাছে আছে তা আমরা জানি, আমরা চাই রাষ্ট্র তাদের রক্ষা করুক এবং আইসিআরসি-কে সেখানে যেতে দিক৷''
সিরিয়া- ভুলো না আমায়!
যুদ্ধ যেন ‘প্রকৃত’ সিরিয়াকে ভুলিয়েই দিচ্ছে৷ যে দেশে সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকতো, যে দেশের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির নিদর্শন মিলেছে মানবসভ্যতার সূচণালগ্নে- সেই সিরিয়াকে মনে করিয়ে দিতে জার্মানিতে চলছে অন্যরকম এক প্রদর্শনী৷
ছবি: Lutz Jaekel
‘সিরিয়া- বিস্মরণের বিরুদ্ধে’
সিরিয়া যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১১ বছর আগে৷ যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার উদার ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অতীত আজ প্রায় বিলীন৷ এখন সিরিয়ার কথা বললেই চোখে ভাসে যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশের ছবি৷ কিন্তু সিরিয়া মানে তো শুধু যুদ্ধ আর হানাহানি নয়৷ সিরিয়ার অতীত খুব উজ্জ্বল এবং আকর্ষণীয়৷ সেই অতীতকে মনে করিয়ে দিতেই জার্মানির কোলন শহরে শুরু হয়েছে দারুণ এক প্রদর্শনী৷ প্রদর্শনীর নাম দেয়া হয়েছে, ‘সিরিয়া- এগেইনস্ট ফরগেটিং’৷
ছবি: Dieter Cöllen
প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য
কোলনের রাউটেনট্রাউশ-জোয়েস্ট জাদুঘরে চলমান এই প্রদর্শনীর মূল উদ্দেশ্য- সিরিয়া আসলে কেমন দেশ ছিল আর পশ্চিমা বিশ্ব সে বিষয়ে কত কম জানে তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা৷ প্রদর্শনীর কিউরেটর জব্বার আব্দুল্লাহ বলেন, ‘‘ প্রধান লক্ষ্য যুদ্ধ নিয়েই শুধু কথা না বলা৷ আমরা অন্য এক সিরিয়া দেখাতে চাই এবং জন্মভূমি সম্পর্কে সিরীয়দের মনেও ইতিবাচক স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে আনতে চাই৷’’
ছবি: Fadi Elias/In-Haus Media 2022
সিরিয়ায় বিরল সিরিয়ার অতীত!
সিরিয়ার প্রায় সব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই ধ্বংস করে দিয়েছে তথাকথিত জঙ্গি সংগঠন আইএস৷ ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া অনেক প্রাচীন নিদর্শনই গুঁড়িয়ে দিয়েছে তারা৷ জব্বার আব্দুল্লাহর জন্ম সিরিয়ার প্রাচীন শহর পালমিরায়৷ সেখানে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া যত স্থাপনা ছিল তার অধিকাংশই শেষ করে দিয়েছে আইএস৷ প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ছবিগুলো জার্মানির সংগ্রহশালা থেকে ধার করেছেন আয়োজকেরা৷
ছবি: Lutz Jaekel
ধর্মীয় ঐক্য ছিল
এক সময় সিরিয়ায় সব ধর্মের মানুষই খুব শান্তিতে বাস করতো৷ ছবিতে সিরিয়ার ধর্মীয় ঐতিহ্যের ছোট্ট এক নিদর্শন৷
ছবি: Lutz Jaekel
ইহুদিরাও ছিলেন
২০১৪ সালে সিরিয়া থেকে মিশর হয়ে জার্মানিতে চলে আসা জব্বার আব্দুল্লাহ চান সিরিয়ার উদার ধর্মীয় সংস্কৃতির অতীতের কথা সবাইকে জানাতে৷এক সময় ইহুদিদের জন্যও সংখ্যাগুরু মুসলমানদের সঙ্গে শান্তিতে বসবাসের পরিবেশ ছিল সিরিয়ায়৷ কিন্তু এখন মাত্র একটা সিনাগগ আছে সিরিয়ায়৷ ১৯৪৭ সালে ইহুদিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলার ঘটনা ঘটে৷ ইহুদিরা তারপর থেকে সিরিয়া ছাড়তে শুরু করেন৷ নব্বই দশকের গোড়ার দিকে অনেক ইহুদিই দেশ ছাড়েন৷
ছবি: Chrystie Sherman
5 ছবি1 | 5
কিন্তু নয় বছর আগে স্বামী এবং সন্তান হারানো ফাদওয়া মাহমুদ জাতিসংঘ নতুন সংস্থা গড়লেই তার দুই স্বজনকে ফিরে পাবেন সে বিষয়ে মোটেই নিশ্চিত নন৷ তবে অনিশ্চয়তার মাঝে তার জন্য এক ধরনের সান্ত্বনাও আছে, ‘‘অনিশ্চয়তা নিয়ে এতগুলো বছর অপেক্ষায় থেকেছি যে এখন খুব আশাবাদী হওয়া কঠিন৷তবু চেষ্টা চালিয়েই যেতে হবে৷আমাদের প্রিয় মানুষগুলোকে উধাও করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সুযোগ তো ওদের দেয়া যাবে না৷''
গত আগস্টের শেষ দিকে জাতিসংঘের মহাসচিবের নির্বাহী অফিস নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে নতুন কোনো ‘‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেকলানিজম'-এর সহায়তা নেয়ার পরিকল্পনার কথা জানায়৷
এর আগে ২০২১ সালে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সংস্থা ইমপিউনিটি ওয়াচ এক সমীক্ষাতেও ‘‘অনুসন্ধান প্রক্রিয়াকে সরল এবং কেন্দ্রীভূত করার জন্য দৃশ্যমান ও সহজে যোগাযোগ করা যায় এমন একটি ওয়ান-স্টপ-শপ প্রক্রিয়া''র প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়৷
বর্তমানে নিখোঁজ সিরীয়দের খুঁজে বের করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি), জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল, ইমপার্শিয়েল অ্যান্ড ইন্ডিপেন্ডেন্ট মেকানিজম (আইআইআইএম), ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন মিসিং পার্সন্স-এর মতো বেশ কিছু সংস্থা রয়েছে৷
যুদ্ধে ঘর হারানো মানুষদের প্রাচীন জীর্ণ স্থাপনায় বসবাস
মোহাম্মদ ওথমান ছোটবেলায় বেড়াতে যেতেন প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোতে৷ ভাবেননি সেরকম কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনেই একদিন আশ্রয় নিতে হবে তাকে৷ সিরিয়ার যুদ্ধ এমন অবস্থায় ফেলেছে অনেক পরিবারকে৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
ওথমানের নতুন জীবন
আড়াই বছর ধরে এমন একটি জায়গায় বাস করছেন ওথমান৷ মারাথ আল-নুমানের কাছের এক গ্রামে সুন্দর, ছিমছাম বাড়ি ছিল তাদের৷ কিন্তু বাশার আল আসাদের বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের প্রচণ্ড যুদ্ধের কারণে বাড়ি-ঘর ছেড়ে এখানে চলে আসতে হয় তাকে৷
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
সন্তানরা আর স্কুলে যায় না
এক সময় এমন জায়গাগুলোতে স্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে বেড়াতে আসতেন ওথমান৷ এখন নিজের বাড়ি নেই, বাড়ির ভাড়া দেয়ার টাকাও নেই বলে বাধ্য হয়ে বসবাস করেন এমন জায়গায়৷ চার সন্তান তার৷ টাকার অভাবে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না৷
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
সাপ, বিচ্ছুর সঙ্গে বসবাস
তুরস্ক সীমান্তের কাছের সারজাবলেহ অঞ্চলে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই প্রাচীন অট্টালিকায় বসবাসের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ৩০ বছর বয়সি ওথমান বলেন, ‘‘এখানে গ্রীষ্মে বিচ্ছু, সাপ আর ধূলার সঙ্গে লড়তে হয় আমাদের৷ সঙ্গে জীবনের যাবতীয় চাপের ব্যাপারগুলো তো থাকেই৷ শীতে প্রচণ্ড শীত পড়ে এখানে৷ স্বাস্থ্যসেবার নাম-গন্ধ নেই৷ এখানে জীবন বড় কঠিন৷’’
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
ভূস্বামী থেকে জলপাই-কুড়ানি
মারাত আল-নুমানের কাছের গ্রামে বাড়ি ছিল, চাষের জমি ছিল৷ প্রাণ বাঁচাতে সব ফেলে চলে এসেছেন পঞ্চম শতকের এই স্থাপনার আশ্রয়ে৷ সংসার চালাতে নানা ধরনের মৌসুমী কাজ করেন ওথমান৷ কখনো জলপাই কুড়ান, কখনো যে কাজে ডাক আসে তা-ই করেন৷ কোনো কাজ না পেলে ধারের টাকায় চালাতে হয় সংসার৷ ওপরের ছবিতে এক নারীর জলপাই তোলার দৃশ্য৷
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
খাররাপ ক্যাম্প
জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা সিরিয়া যুদ্ধে ঘর-ছাড়া হয়েছেন কমপক্ষে ২৮ লাখ মানুষ৷ তাদের মধ্যে ১৭ লাখ নিজের দেশেই ঘর-ছাড়া৷ তাদের একটা অংশের আশ্রয়স্থল এই ধরনের প্রাচীন ভবন৷ স্থানীয়রা এমন ভবন বা ভবনকে ঘিরে গড়ে ওঠা আশ্রয় কেন্দ্রের নাম দিয়েছেন ‘খাররাপ ক্যাম্প’, অর্থাৎ ধ্বংসাবশেষের শিবির৷
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
পশুপালক মাহমুদ আবু খলিফা
সারজাবলেহর কাছেই ইডলিব৷ সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এই প্রদেশেও কিছু প্রাচীন ভবন রয়েছে৷ একটির নাম বাবিস্কা৷ সেখানে বাস করে ৮০টির মতো পরিবার৷ স্ত্রী আর সাত সন্তান নিয়ে মাহমুদ আবু খলিফাও থাকেন সেখানে৷ ঘর-বাড়ি ছেড়ে এলেও ভেড়াগুলো সঙ্গে নিয়ে এসেছেন৷ ৩৫ বছর বয়সি তরুণের পরিবারের জীবিকা এখন ভেড়াগুলোর ওপরই নির্ভরশীল৷
ছবি: Khalil Ashawi/REUTERS
বাড়ি ফেরা হবে?
নিজেদের বাড়িতে কখনো ফিরতে পারবেন কিনা ওথমান, মাহমুদরা তা জানেন না৷ তবে সেই দিনের অপেক্ষাতেই দিন গোণেন তারা৷ আশায় বুক বাঁধেন বারবার- একদিন শান্তি ফিরবে, সেদিন তাদেরও আবার বাড়ি-ঘর থাকবে!