২০২০ সালের জুন মাসে লাদাখের গালওয়ানে মুখোমুখি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল ভারত এবং চীনের সেনা। দুইপক্ষের হাতাহাতিতে মৃত্যু হয়েছিল বেশ কিছু ভারতীয় সেনা জওয়ানের। চীনের সেনা অফিসারের মৃত্যুর খবরও শোনা গেছিল। যার জেরে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন স্ট্যান্ডঅফ চলে। অর্থাৎ, দুই দেশের সেনা ওই অঞ্চলে মুখোমুখি অবস্থান করতে শুরু করে। পরে একাধিক বৈঠকের পর দুই দেশে সেনা সরাতে সম্মত হয়। এবার সেই গালওয়ান নিয়েই নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত নতুন বছরের প্রথম দিন।চীনের একটি সরকারি সংবাদমাধ্যমের টুইটার হ্যান্ডেলে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়। যেখানে দেখা যায়, গালওয়ান উপত্যকায় চীনের পতাকা তুলে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে সেনা। ভিডিওটি ভাইরাল হয়ে যায় ভারতে। সোমবার ওই ভিডিও দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জবাব চেয়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী।
চীনের ওই ভিডিও-র ক্যাপশনে বলা হয়েছে, যে পতাকাটি তোলা হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে বেজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে ওই পতাকা তোলা হয়েছিল। নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানোর জন্যই ওই পতাকা ওখানে তোলা হয়েছিল বলে ভিডিও-তে দাবি করা হয়।
বার বার সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও চীনের সেনা। কেন? ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ছবি: Rouf Bhat/Afp/Getty Imagesভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ লাদাখে। বাকি অংশ উত্তর পূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে।
ছবি: DW/H. Joshiলাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষ বসবাস করে না। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo১৩৪ কিলোমিটার লম্বা প্যাংগং লেক ১৪ হাজার ফুটে অবস্থিত। নোনতা জলের এই হ্রদকে ঘিরে প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জমি। প্যাংগংয়ের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের দখলে। দুই-তৃতীয়াংশ চীনের। প্রকৃত সীমান্তরেখা এই লেকের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। ভারতের দাবি, চীন সেই সীমান্তরেখা অগ্রাহ্য করে ভারতের জমি দখল করছে এবং সীমান্তের খুব কাছে রাস্তা বানাচ্ছে। চীনের দাবি, ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা মানছে না।
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Karelগালওয়ানের খুব কাছ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা গিয়েছে। চীন তিব্বতের উপর দিয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে। যাকে কারাকোরাম হাইওয়ে বলা হয়। ভারতের অভিযোগ, ওই হাইওয়ের জন্যই লাদাখের একটি অংশের দখল নিতে চায় চীন। তা করতে পারলে আরও সহজ একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত তা হতে দিতে চায় না। গালওয়ান সমস্যার মূল কারণ এটিই।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Vatsyayanaদারবুক, শাইয়োক হয়ে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে ভারত। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের উচ্চতম এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে ভারত। এই এয়ার স্ট্রিপ এবং সিয়াচেন পর্যন্ত রাস্তা নিয়ে চীনের আপত্তি আছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Khawer১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে উত্তর পূর্ব ভারত এবং তিব্বতের সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়েছিল ম্যাকমোহন লাইনের মাধ্যমে। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে এই লাইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে চীনকে নেওয়া হয়নি। সেই তখন থেকেই অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে অরুণাচল অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে এই সমস্যার সমাধানে দুই দেশ আলোচনা করেছে। তবে চীন এখনও মনে করে অরুণাচল তাদের।
ছবি: Prabhakar Maniসীমান্ত সমস্যার জেরে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর সরাসরি দুই দেশের মধ্যে আর কোনও যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা-য় দুই দেশের সৈন্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলের তুলু লা-তে ফের সংঘর্ষ হয় দুই দেশের সেনার। যদিও কোনওটাই দীর্ঘ সংঘর্ষ বা যুদ্ধের স্তরে পৌঁছয়নি। তবে জুন মাসে গালওয়ানের ঘটনা নজিরবিহীন।
ছবি: DW গালওয়ান নিয়ে ভারত এবং চীনের মধ্যে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। গালওয়ানে ভারতীয় ভূখণ্ডের বেশ কিছু অঞ্চল চীন দখল করে রেখেছে বলে ভারতের দাবি। যা নিয়ে ২০২০ সালে সংঘাত হয়। এরপর একাধিক বৈঠক হয় দুই দেশের সেনা পর্যায়ে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। শেষপর্যন্ত দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়। তারপর ঠিক হয়, সংঘাতের অঞ্চল থেকে দুই দেশে দুই কিলোমিটার করে পিছিয়ে যাবে। এলাকাটি সেনামুক্ত করা হবে। গত বছর তা বাস্তবায়িত হয়।
ভিডিও দেখে বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, সংঘাতের ওই অঞ্চলেই পতাকা তোলা হয়েছে। তবে ভারতীয় সেনার সূত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছে, সংঘাতের এলাকায় পতাকা তোলা হয়নি। স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গালওয়ান নদীর বাঁক থেকে বেশ খানিকটা দূরে পতাকা তোলা হয়েছে। যেখানে এখন চীন অবস্থান করছে। বিতর্কিত অঞ্চলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে পতাকা তোলা হয়নি।
প্রশ্ন হলো, বিতর্কিত অঞ্চলে পতাকা তোলা না হলেও, চীন যেখানে এ কাজ করেছে, তা কি চীনেরই এলাকা? ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, ওই এলাকাও চীন 'দখল' করে রেখেছে। অন্য অংশের বক্তব্য, ওই এলাকাটিও বিতর্কিত অঞ্চল। কিন্তু তা দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কে রয়েছে। সাম্প্রতিক বিতর্কিত এলাকার মধ্যে ওই অঞ্চলটি পড়ে না।
তবে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতির জল যে আরো ঘোলা হতে পারে, রাজনৈতিক মহলের একটি বড় অংশ মনে করছে। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আগে কংগ্রেস বিষয়টি নিয়ে আরো সরব হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এসজি/জিএইচ (চীনের টুইট, এনডিটিভি)