লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পরিস্থিতি ও পরিকাঠামোর পর্যালোচনা করতে সেনা প্রধান নরবণে লে এসেছেন। দুই দিন ধরে এখানকার সেনা কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি পুরো পরিস্থিতি খতিয়ে দেখবেন।
ইতিমধ্যেই লাদাখে প্রায় দশ হাজার ভারতীয় সেনা নিয়োগ করা হয়েছে। তিনটি বলয়ে এই সেনা নিয়োগ করা হয়েছে। পাহাড়ে যুদ্ধের বিশেষ ক্ষমতা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিখ, গোর্খা, ইন্দো টিবেট বর্ডার ফোর্সের ব্যাটেলিয়নকে বেশি করে মোতায়েন করা হয়েছে। বসানো হয়েছে ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপনাস্ত্র। মাঝে মধ্যেই যুদ্ধবিমান লে থেকে উড়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার দিকে চক্কর দিয়ে আসছে। স্থানীয় স্তরে উত্তেজনা বাড়তে পারে, সংঘর্ষ হতে পারে মনে করেই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আরও কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা সেনা প্রধান আলোচনার পর ঠিক করবেন।
এই পরিস্থিতিতে আর কী দরকার, কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, সংঘর্ষ হলে কী করা দরকার সেই সব বিষয় নিয়ে সেনা প্রধান আলোচনা করবেন। তিনি পুরো সেনা ব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখবেন। তারপর উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তাই সেনা প্রধানের লাদাখ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বার বার সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও চীনের সেনা। কেন? ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ছবি: Rouf Bhat/Afp/Getty Imagesভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ লাদাখে। বাকি অংশ উত্তর পূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে।
ছবি: DW/H. Joshiলাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষ বসবাস করে না। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo১৩৪ কিলোমিটার লম্বা প্যাংগং লেক ১৪ হাজার ফুটে অবস্থিত। নোনতা জলের এই হ্রদকে ঘিরে প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জমি। প্যাংগংয়ের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের দখলে। দুই-তৃতীয়াংশ চীনের। প্রকৃত সীমান্তরেখা এই লেকের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। ভারতের দাবি, চীন সেই সীমান্তরেখা অগ্রাহ্য করে ভারতের জমি দখল করছে এবং সীমান্তের খুব কাছে রাস্তা বানাচ্ছে। চীনের দাবি, ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা মানছে না।
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Karelগালওয়ানের খুব কাছ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা গিয়েছে। চীন তিব্বতের উপর দিয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে। যাকে কারাকোরাম হাইওয়ে বলা হয়। ভারতের অভিযোগ, ওই হাইওয়ের জন্যই লাদাখের একটি অংশের দখল নিতে চায় চীন। তা করতে পারলে আরও সহজ একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত তা হতে দিতে চায় না। গালওয়ান সমস্যার মূল কারণ এটিই।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Vatsyayanaদারবুক, শাইয়োক হয়ে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে ভারত। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের উচ্চতম এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে ভারত। এই এয়ার স্ট্রিপ এবং সিয়াচেন পর্যন্ত রাস্তা নিয়ে চীনের আপত্তি আছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Khawer১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে উত্তর পূর্ব ভারত এবং তিব্বতের সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়েছিল ম্যাকমোহন লাইনের মাধ্যমে। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে এই লাইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে চীনকে নেওয়া হয়নি। সেই তখন থেকেই অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে অরুণাচল অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে এই সমস্যার সমাধানে দুই দেশ আলোচনা করেছে। তবে চীন এখনও মনে করে অরুণাচল তাদের।
ছবি: Prabhakar Maniসীমান্ত সমস্যার জেরে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর সরাসরি দুই দেশের মধ্যে আর কোনও যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা-য় দুই দেশের সৈন্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলের তুলু লা-তে ফের সংঘর্ষ হয় দুই দেশের সেনার। যদিও কোনওটাই দীর্ঘ সংঘর্ষ বা যুদ্ধের স্তরে পৌঁছয়নি। তবে জুন মাসে গালওয়ানের ঘটনা নজিরবিহীন।
ছবি: DW সোমবার ভারত-চীন লেফটানান্ট জেনারেল পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। প্রায় ১১ ঘণ্টা ধরে আলোচনা হয়। ভারতের তরফ থেকে প্রতিবারই সাত-আটটি বিষয় আলোচনায় তোলা হয়। চীনকে ম্যাপ দিয়ে বলা হয়, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার দুই কিলোমিটারের মধ্যে চীন প্রচুর নির্মাণকাজ করেছে। যা তারা করতে পারে না। এ গুলি ভেঙে দিতে হবে। চীনা সেনাকে ৪ মে-র আগের অবস্থানে যেতে হবে। অর্থাৎ, তারা যে এগিয়ে এসেছে, সেখান থেকে পিছনে চলে যেতে হবে। সেনা সমাবেশ কমাতে হবে।
সোমবারের বৈঠকেও বিষয়গুলো উঠেছিল। কিন্তু কোনও সমাধানসূত্র পাওয়া যায়নি। এই সামরিক পর্যায়ে আলোচনায় অবশ্য খুব বেশিদূর যাওয়া যায় না। এই আলোচনা থেকে কূটনৈতিক পর্যায়ের আলোচনার ভিতটা তৈরি হয়। সেনা সূত্রে খবর, সোমবারের বৈঠকে চীন সেনা পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো ইঙ্গিত দেয়নি। বরং তারা বারবার ভারতকে লাদাখে সেনার সংখ্যা কমাতে বলেছে।
চীনের আরও সুবিধা হয়েছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কথায়। গত শুক্রবার সর্বদলীয় বৈঠকে মোদী বলেছেন, ভারতের জমিতে চীনা সেনা নেই। ভারতের কোনো পোস্টও তাঁদের দখলে নেই। এরপরই গালওয়ান উপত্যকাকেই তাঁদের এলাকা বলে দাবি করে চীন।
ভারত ও চীনের মধ্যে একবারই যুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬২ সালে। কিন্তু তার আগে ও পরে অনেকবারই সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে এই দুই দেশ। সেই সংঘাতের কাহিনি দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত।
ছবি: Getty Images/Three Lions/Radloffচীন তিব্বতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলো ১৯৫১ সালে। তার আট বছর পরে চতুর্দশ দলই লামা পালিয়ে ভারতে আসেন। ভারত তাঁকে আশ্রয় দেয়। চীন তার বিরোধিতা করে। তারপর শুরু হয় সীমান্তে দুই সেনার সংঘর্ষ।
ছবি: APসীমান্ত সংঘর্ষ হয়েছে প্রচুর। কিন্তু যুদ্ধ একবারই। ১৯৬২ সালে এক মাস এক দিনের লড়াইয়ে ভারতীয় ভূখন্ডে ঢুকে পড়ে চীন। অরুণাচল প্রদেশে ও লাদাখের ভিতরে। ভারত ছিলো অপ্রস্তুত। চীন সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলো।
ছবি: Getty Imagesভারত ও চীনের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত রয়েছে। সহজভাবে বললে, যুদ্ধের পর দুই দেশের সেনা যেখানে অবস্থান করছে, সেটাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা।
ছবি: Getty Imagesপাঁচ বছরের মধ্যে অবস্থা বদলে গেলো। ১৯৬৭-র ১১ সেপ্টেম্বর চীনা সেনা নাথু লা-য় ভারতীয় পোস্ট আক্রমণ করে। পাঁচ দিন ধরে সংঘর্ষ চলে। এ বার ভারত ছিলো সুবিধাজনক অবস্থায়। তারা চীনা সেনাকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে। সংঘর্ষ হয় চো লা-তেও।
ছবি: Diptendu Dutta/AFP/Getty Imagesআবার উত্তেজনা ২০ বছর পরে, সামডরং উপত্যকায়। ভারত তখন অপারেশন চেকারবোর্ড চালাচ্ছিলো। কত তাড়াতাড়ি আসাম থেকে সীমান্তে সেনা পৌঁছনো যায় তা নিয়ে। সেখান থেকেই উত্তেজনা। দুই দেশের সেনা সামনাসামনি। তবে সংঘর্ষ হয়নি।
ছবি: picture-alliance/AP Photoএ বার বিরোধ ২০১৭-তে, ডোকলামে। ভারত, ভূটান ও চীনের সীমান্তে। চীনের সেনা একটা রাস্তা বানাতে থাকে। ভারতীয় সেনাও বুলডোজার নিয়ে চলে যায় তা থামাবার জন্য। সেই সংঘাত ৭৩ দিন চলে। অবশেষে কূটনৈতিক আলোচনার পর বিরোধ মেটে।
ছবি: APএ বার ২০২০-তে। আবার লাদাখ। প্রথমে দুই সেনার হাতাহাতি লড়াই। সিকিমেও একই ঘটনা ঘটলো। চীনের প্রেসিডেন্ট বললেন, তিনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তারপর ভারত ও চীন দুই পক্ষই সীমান্তে প্রচুর সেনা মোতায়েন করেছে। দুই দেশই প্রচুর কামান ও গোলাবারুদ নিয়ে গিয়েছে।
ছবি: Eesha Khenyচীন দাবি করে অরুণাচল প্রদেশ তাঁদের এলাকা। বিশেষ করে তাওয়াং শহর। অরুণাচলের লোকের চীনে যেতে ভিসা লাগবে না। ভারত জানায়, অরুণাচল তাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ছবি: picture-alliance/dpa/dinodiaভারতের দাবি, আকসাই চীন তাদের এলাকা। চীন জবরদখল করে রেখেছে। ১৯৬২ থেকেই এ নিয়ে বিরোধ চলছে। এখানে কোনও মানুষের বসতি নেই। কিন্তু সামরিক দিক থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
ভারত ও চীনের সম্পর্ককে বলা হয় ব্লো হট, ব্লো কোল্ড রিলেশন বা নরমে-গরমের সম্পর্ক। মাঝে মাঝেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর উত্তেজনা হয়। আবার শান্তি আসে। দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর। দুই দেশের সেনা শক্তিশালী। তাই তা আর যুদ্ধের দিকে যায় না।
ছবি: Reuters/Handout ভারতের পক্ষ থেকে চীনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সরকারের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পরিস্থিতির প্রয়োজনে সেনাবাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারকরতে পারবে। এর আগে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত সিদ্ধান্ত বদল করেছে। চীন অবশ্য এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে।
ভারত আবার লাদাখে ভূমি থেকে আকাশ ক্ষেপনাস্ত্রও বসিয়েছে। চীনা বিমান বাহিনীর তৎপরতা দেখেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সূত্র জানাচ্ছে। তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রক অবশ্য এ নিয়ে কোনও কথা বলেনি।
সোমবারই নয়াদিল্লিতে সেনা কর্তাদের বৈঠকে ঠিক হয়েছে, চীনের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর যে রাস্তাগুলি তৈরি করার কথা, তা জরুরি ভিত্তিতে করা হবে বা যে রাস্তা তৈরি হচ্ছে তা দ্রুত শেষ করা হবে। চীন সীমান্তে ৩২টি রাস্তা তৈরি করছে ভারত। রাস্তা তৈরির কাজে দক্ষ সেনা কর্মীদের লাদাখে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তাঁদের রাস্তা তৈরির কাজে নিয়োগ করা হয়েছে। লে-তে ডয়চে ভেলেকে সেনা বাহিনীর এক ইঞ্জিনিয়ার জানিয়েছেন, করোনার কারণে বহু ইঞ্জিনিয়ারকে বাড়িতে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল সেনা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁদের অনেককেই লে-তে উড়িয়ে আনা হচ্ছে। পাঠানো হচ্ছে রাস্তা এবং পরিকাঠামো তৈরির কাজে।