এই বছরই বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন রাজেশ ওঁরাও এর বাবা-মা। কিন্তু অবিবাহিত বোনের বিয়ে না দিয়ে তিনি কিছুতেই বিয়ে করতে চাইছিলেন না। শেষ পর্যন্ত অবিবাহিতা বোনের বিয়ে দেওয়া হলো না রাজেশের। লাদাখের গালওয়ানে চীনা সেনার হাতে মরতে হয়েছে রাজেশকে।
আনন্দবাজার জানাচ্ছে, বীরভূম জেলার মহম্মদবাজারের বেলগড়িয়ায় রাকেশের গ্রাম শোকস্তব্ধ। বাবা সুভাষ ওঁরাও চাষ করেন। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে শয্যাশায়ী। মা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। বাবা সুভাষ ওঁরাও বলেছেন, তাঁর একটাই শান্তি, ছেলে লড়াই করে মারা গিয়েছে। যতক্ষণ পাল্টা জবাব না দেওয়া হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত তাঁর বেদনা ঘুচবে না।
গরিব পরিবার। আগে মাটির বাড়ি ছিল। রাজেশের টাকায় পাকা বাড়ি হয়েছে। রাজেশ প্রতি রোববার ফোন করতেন। গত রোববার ফোন আসেনি। তার আগের সপ্তাহে বলেছিলেন, পরিস্থিতি ভালো নয়। কবে ফোন করতে পারবেন জানেন না। ফোন এসেছে মঙ্গলবার। রাজেশের কাছ থেকে নয়। সেনাবাহিনীর তরফে। প্রথমে খবর দেওয়া হয়, রাজেশ গুরুতর আহত। তারপর মৃত্যুর খবর। সত্যিই ফোনটা আর করতে পারলেন না রাজেশ।
বাড়িতে এলেই কাশ্মীরের গল্প করতেন। লড়াইয়ের গল্প। কাশ্মীরের সৌন্দর্যের গল্প। সেই গল্পও অসমাপ্ত থেকে গেল। বিদায় নিতে হলো রাজেশকে। পাঁচ বছর ধরে সেনাবাহিনীতে চাকরি করছিলেন। অনেক আশা ছিল, পরিবারকে দাঁড় করাবেন। সেই ইচ্ছেও পূর্ণ হলো না।
মারা গিয়েছেন রাজেশের রেজিমেন্টের কম্যান্ডিং অফিসার কর্নেল সন্তোষ বাবুও। তাঁর বদলি হয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন আগেই তাঁর লাদাখ ছেড়ে চলে আসার কথা। হয়নি, প্রথমে করোনা ও পরে চীনের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকায়। এর মধ্যে হায়দরাবাদে তাঁর নতুন বাড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে। স্ত্রী ও বাচ্চাদের দিল্লি থেকে সেখানে পৌঁছবার কথা। তিনিও দিন গুনছিলেন কবে যাবেন সেখানে।
বার বার সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও চীনের সেনা। কেন? ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ছবি: Rouf Bhat/Afp/Getty Imagesভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ লাদাখে। বাকি অংশ উত্তর পূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে।
ছবি: DW/H. Joshiলাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষ বসবাস করে না। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo১৩৪ কিলোমিটার লম্বা প্যাংগং লেক ১৪ হাজার ফুটে অবস্থিত। নোনতা জলের এই হ্রদকে ঘিরে প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জমি। প্যাংগংয়ের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের দখলে। দুই-তৃতীয়াংশ চীনের। প্রকৃত সীমান্তরেখা এই লেকের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। ভারতের দাবি, চীন সেই সীমান্তরেখা অগ্রাহ্য করে ভারতের জমি দখল করছে এবং সীমান্তের খুব কাছে রাস্তা বানাচ্ছে। চীনের দাবি, ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা মানছে না।
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Karelগালওয়ানের খুব কাছ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা গিয়েছে। চীন তিব্বতের উপর দিয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে। যাকে কারাকোরাম হাইওয়ে বলা হয়। ভারতের অভিযোগ, ওই হাইওয়ের জন্যই লাদাখের একটি অংশের দখল নিতে চায় চীন। তা করতে পারলে আরও সহজ একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত তা হতে দিতে চায় না। গালওয়ান সমস্যার মূল কারণ এটিই।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Vatsyayanaদারবুক, শাইয়োক হয়ে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে ভারত। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের উচ্চতম এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে ভারত। এই এয়ার স্ট্রিপ এবং সিয়াচেন পর্যন্ত রাস্তা নিয়ে চীনের আপত্তি আছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Khawer১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে উত্তর পূর্ব ভারত এবং তিব্বতের সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়েছিল ম্যাকমোহন লাইনের মাধ্যমে। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে এই লাইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে চীনকে নেওয়া হয়নি। সেই তখন থেকেই অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে অরুণাচল অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে এই সমস্যার সমাধানে দুই দেশ আলোচনা করেছে। তবে চীন এখনও মনে করে অরুণাচল তাদের।
ছবি: Prabhakar Maniসীমান্ত সমস্যার জেরে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর সরাসরি দুই দেশের মধ্যে আর কোনও যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা-য় দুই দেশের সৈন্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলের তুলু লা-তে ফের সংঘর্ষ হয় দুই দেশের সেনার। যদিও কোনওটাই দীর্ঘ সংঘর্ষ বা যুদ্ধের স্তরে পৌঁছয়নি। তবে জুন মাসে গালওয়ানের ঘটনা নজিরবিহীন।
ছবি: DW রোববার তিনি ফোন করেছিলেন বাবা-মাকে। বলেছিলেন, পরিস্থিতি দেখে তিনিও উদ্বিগ্ন। প্রবল উত্তেজনা রয়েছে। বাবা-মা বলেছিলেন, সাবধানে থাকতে। সন্তোষ বলেছিলেন, তিনি সাবধানে থাকবেন।
কিন্তু কাজটাই এমন যে সাবধানে আর থাকা হয়নি। মঙ্গলবার পরিবারের কাছে ফোন যায় তাঁর মারা যাওয়ার খবর নিয়ে।
বাবা পি উপেন্দ্র একই সঙ্গে শোকার্ত ও গর্বিত। তিনি বলেছেন, ''আমি নিজে সেনাবাহিনীতে যেতে চেয়েছিলাম। পারিনি। তাই চেয়েছিলাম ছেলে সেনাতে যোগ দিক। আত্মীয়রা মানা করেছিল। কিন্তু আমি বলেছিলাম, সেনাতে যোগ দিয়ে দেশসেবা করুক সন্তোষ। আমি গর্বিত, ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে।''
জিএইচ/এসজি(আবাপ, এএনআই, এনডিটিভি)