এই প্রথম লাদাখ প্রসঙ্গে কথা বলার সময় ভারতের কোনও মন্ত্রী 'যুদ্ধ' শব্দটি ব্যবহার করলেন।
বিজ্ঞাপন
যুদ্ধ শুরু করা আমাদের হাতে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তা শেষ করা আর কারো হাতে থাকে না। লাদাখ প্রসঙ্গে রাজ্যসভায় বিবৃতি দেওয়ার সময় এ ভাবেই ভারত-চীন সাম্প্রতিক সংঘাতকে ব্যাখ্যা করলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। লোকসভায় আগেই এ প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাজ্যসভায় বিবৃতি দেন তিনি। বিরোধীদের প্রশ্নের উত্তরও দেন।
ইউপিএ আমলের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি রাজনাথকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভারতীয় সেনারা লাদাখ সীমান্তে পেট্রলিং করতে পারছে কি না। কারণ, ওই পেট্রলিংকে কেন্দ্র করেই দুই দেশের সেনার মধ্যে প্রথম সংঘর্ষ হয়। রাজনাথ জানিয়েছেন, কোনও দেশ ভারতীয় সেনার পেট্রলিং বন্ধ করতে পারবে না। তার জন্য যত দূর যাওয়া দরকার, ভারত যেতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু এ বিষয়ে কারও কাছে মাথা নত করা হবে না। অন্য কোনও দেশকেও ভারত তার সামনে মাথা নত করতে বলবে না।
গত সপ্তাহেই মস্কোয় পর পর দুইটি বৈঠক হয়েছিল ভারত এবং চীনের। প্রথমে দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং তারপর বিদেশমন্ত্রী। বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকের পর পাঁচটি পয়েন্টে লাদাখ সংকট কাটানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। পাঁচটি পয়েন্ট নিয়ে দুই দেশের সেনার মধ্যে বৈঠক হোয়ারও কথা ছিল। ঠিক হয়েছিল, দুই দেশই সেনা প্রত্যাহার করবে সীমান্ত থেকে। কিন্তু কী ভাবে করবে, তার সিদ্ধান্ত নেবেন সেনা আধিকারিকরা।
চীন-ভারত: সামরিক শক্তিতে কে কত এগিয়ে
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেনাবাহিনীকে বলেছেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে৷ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী ভারতও প্রস্তুত৷ যুদ্ধ কখনো কাম্য নয়৷ তবু দেখে নেয়া যাক সামরিক শক্তিতে চীন আর ভারতের বর্তমান অবস্থা৷
ছবি: picture-alliance/AP/A. Rahi
পিডাব্লিউআর ব়্যাঙ্কিং
সামরিক শক্তির এই ব়্যাঙ্কিংয়ে ভারতের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে চীন৷ যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার ঠিক পরে, অর্থাৎ তিন নাম্বারে আছে চীন আর ভারত আছে চার নাম্বারে৷
ছবি: APTN
সক্রিয় সেনাসদস্য
১৩৮ টি দেশের মধ্যে পিআরডাব্লিউ ইনডেক্সে তৃতীয় স্থানে থাকা চীনের মোট ২১ লক্ষ ২৩ হাজার সেনাসদস্য রয়েছে, ভারতের রয়েছে ১৪ লক্ষ ৪৪ হাজার সেনাসদস্য৷ তবে রিজার্ভ সৈন্যর সংখ্যায় ভারত এগিয়ে৷ চীনের পাঁচ লাখ ১০ হাজারের বিপরীতে তাদের রয়েছে ২১ লাখ রিজার্ভ সৈন্য৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Asfouri
প্রতিরক্ষা বাজেট
প্রতিরক্ষা খাতে চীনের বাজেট ২৩৭০ কোটি ডলারের এবং ভারতের ৬১০ কোটি ডলারের৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Goya
এয়ারক্রাফট
এখানেও চীন এগিয়ে৷ চীনের ৩২১০টির বিপরীতে ভারতের রয়েছে ২১২৩টি এয়ারক্রাফট৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Li Jianshu
যুদ্ধজাহাজ
চীনের ৭৭৭টি আর ভারতের রয়েছে ২৮৫টি যুদ্ধজাহাজ৷
ছবি: Getty Images/AFP
যুদ্ধবিমান
চীনের যুদ্ধবিমান ভারতের দ্বিগুণেরও বেশি৷ চীনের ১২৩২টি আর ভারতের ৫৩৮টি৷ (প্রতীকী ছবি)
ছবি: Imago-Images/StockTrek Images
হেলিকপ্টার
চীনের আছে ৯১১টি হেলিকপ্টার আর ভারতের ৭২২টি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/epa/J. Singh
ট্যাঙ্ক
ভারতের ট্যাঙ্ক চীনের চেয়ে অনেক বেশি৷ চীনের আছে ৩৫০০টি ট্যাঙ্ক আর ভারতের ৪২৯২টি৷ ওপরে চীন, রাশিয়া ও ইরানের যৌথ মহড়ার ছবি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Grits
সাঁজোয়া যান
চীনের সাঁজোয়া যানবাহনের সংখ্যা ৩৩ হাজার, ভারতের আট হাজার ৬৮৬৷
ছবি: picture-alliance/Xinhua/Z. Hesong
স্বয়ংক্রিয় আর্টিলারি
এখানে দু দেশের তুলনাই হয় না৷ চীনের আছে ৩৮০০, ভারতের মাত্র ২৩৫৷
ছবি: picture-alliance/AP/A. Rahi
ফিল্ড আর্টিলারি
এখানে ভারত কিছুটা এগিয়ে৷ চীনের ৩৮০০-র বিপরীতে তাদের রয়েছে ৪০৬০টি ফিল্ড আর্টিলারি৷
ছবি: picture-alliance/AP/A. Rahi
রকেট প্রজেক্টর
চীনের ২৬৫০, ভারতের ২৬৬৷ সুতরাং এখানে চীন প্রায় দশগুণ এগিয়ে৷
ছবি: Reuters/F. Mascarenhas
সাবমেরিন
সাবমেরিনের সংখ্যার দিক থেকেও ভারত অনেক পিছিয়ে৷ চীনের ৭৪টির বিপরীতে ভারতের আছে ১৬টি সাবমেরিন৷
ছবি: Reuters/S. Andrade
বিমানবাহী জাহাজ
চীনের ২টি, ভারতের ১টি৷
ছবি: picture-alliance/newscom/S. Shaver
ডেস্ট্রয়ার
চীনের ৩৬টি, অন্যদিকে ভারতের ১০টি৷
ছবি: picture-alliance/Imagechina
ফ্রিগেট
চীনের ৫২, ভারতের তার ঠিক চার ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ ১৩টি৷
ছবি: AFP/Iranian Army office
রণতরি
রণতরি চীনের ৫০টি, ভারতের ১৯টি৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Asfouri
উপকূলীয় টহল
চীনের ২২০, ভারতের ১৩৯৷
ছবি: picture-alliance/Imaginechina/Meng Zhongde
বিমানবন্দর
চীনের আছে মোট ৫০৭টি বিমানবন্দর আর ভারতের ৩৪৭টি৷
ছবি: Getty Images/AFP/G. Baker
নৌবন্দর এবং টার্মিনাল
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন প্রায় সব জায়গার মতো এখানেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশের চেয়ে এগিয়ে৷ চীনের২২টির বিপরীতে তাদের রয়েছে মোট ১৩টি বন্দর ও টার্মিনাল৷
ছবি: picture-alliance/Costfoto/Yu Fangping
ভারতের বহরে রাফাল
২০১৬ সালে ফ্রান্সে গিয়ে রাফাল যুদ্ধ বিমান চুক্তিতে সই করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মোট ৩৬টি বিমান ফ্রান্সের থেকে কেনার চুক্তি হয়েছিল। এরমধ্যে বুধবার ভারতে পৌঁছেছে নতুন পাঁচটি যুদ্ধ বিমান। সেগুলোকে লাদাখে পাঠানোর কথা রয়েছে৷ চীন-ভারত সংঘাতের কারণে আপাতত সেখানেই রাখা হবে বিমানগুলিকে। এরপর আসবে হ্যামার মিসাইলও।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Indian Air Force
21 ছবি1 | 21
বৃহস্পতিবার সংসদে দাঁড়িয়ে অন রেকর্ড রাজনাথ যা বললেন, তার সঙ্গে ওই সমঝোতা চুক্তি মিলছে না। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, লাদাখে ভারত এবং চীনের সীমান্ত বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা নিয়ে দীর্ঘদিন বিতর্ক আছে। কাঁটাতার দিয়ে সীমান্ত চিহ্নিত নয়। জনমানবহীন শীতল মরুভূমিতে হাওয়ায় পাথরও সরে যায়। তা ছাড়া যে কাল্পনিক রেখাকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বলে মনে করা হয়, তা নিয়েও দুই দেশের মধ্যে তীব্র বিতর্ক আছে। ফলে বিতর্কিত অঞ্চলে দুই দেশই ক্ষমতা মতো পেট্রলিং করে। এটাই জমির উপর ক্ষমতা জারি রাখার অন্যতম প্রক্রিয়া। বরাবর ওই পেট্রলিং নিয়েই দুই দেশের সেনার মধ্যে সংঘাত হয়। প্যাংগং, ডেপসাং, গোগরা, হটস্প্রিং অঞ্চলে এটাই সংঘাতের কারণ। জুন মাসে গালওয়ানেও ঠিক এই কারণেই সংঘাত হয়েছে। এবং ২০ জন সেনা জওয়ানের প্রাণ গিয়েছে। যদিও গালওয়ান বিতর্কিত অঞ্চল ছিল না।
রাজনাথের কথা মতো যদি পেট্রলিং চলতে থাকে, তা হলে বিদেশমন্ত্রীদের আলোচনায় উঠে আসা সমঝোতা সম্ভব নয়। পেট্রলিং বন্ধ না করলে দুই দেশের সেনা পিছনে যেতে পারবে না। বস্তুত, সেনা সূত্রের বক্তব্য, এপ্রিল মাসের পর থেকে চীন ডেপসাং অঞ্চলে অনেকটাই ঢুকে এসেছে। প্যাংগংয়ের উত্তর প্রান্তেও একই ঘটনা ঘটেছে। আবার প্যাংগংয়ের দক্ষিণে ভারত দুইটি গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ের দখল নিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সেনা পিছিয়ে নিতে হলে, বিতর্কিত অঞ্চলে পেট্রলিং বন্ধ করতে হবে। রাজনাথ বলছেন, পেট্রলিং বন্ধ হবে না। তা হলে সমঝোতারও কোনও সম্ভাবনা নেই বলে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য।
আকাশ থেকে লাদাখ
পৃথিবীর অপার সৌন্দর্যের যে অংশকে স্বর্গের কাছাকাছি ভাবা হয় তা হলো লাদাখ৷ পাখির চোখে দেখে নেওয়া যাক সেখানকার দুর্গম পাহাড়ের কিছু ছবি৷
ছবি: DW/S. Ghosh
শুধুই বরফ
দিল্লি থেকে লে-র বিমান রওনা হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে শুরু হয়ে যায় হিমালয় পর্বতমালা।
ছবি: DW/S. Ghosh
শিবালিক আর পিরপাঞ্জাল
প্রথমেই চোখে পড় শিবালিক আর পিরপাঞ্জাল পর্বতমালা। ছবিতে যত দূর চোখ যায়, পুরোটাই ভারতীয় হিমালয়ের অংশ।
ছবি: DW/S. Ghosh
হিমালয়ের দৃশ্য
মুহূর্তে বদলাতে শুরু করল দৃশ্য। পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বিমান। যত দূর দেখা যায়, একের পর এক চেনা অচেনা শিখর।
ছবি: DW/S. Ghosh
যত দুর্গম, তত আলোড়ন
হিমালয়ের এই দুর্গম অঞ্চল ঘিরেই যত সংঘাত। ভারত, চীন, পাকিস্তানের সীমান্ত রয়েছে এই গিরিবর্তের নানা খাঁজে।
ছবি: DW/S. Ghosh
যুদ্ধ সেখানে, যেখানে মানুষ নেই
সিয়াচেন গ্লেসিয়ারেও যুদ্ধ করেছে ভারত-পাকিস্তান। হিমালয় পর্বতমালা ছেড়ে বিমান ঢুকে পড়েছে ট্রান্স হিমালয়। দূরে কারাকোরাম। সেখানেই সিয়াচেন।
ছবি: DW/S. Ghosh
নীল-হ্রদ
১৫ হাজার ফুটে নোনতা জলের হ্রদ। সো মুরারি। লাদাখি ভাষায় সো মানে হ্রদ। সো মুরারি ছেড়ে আর একটু এগিয়ে গেলে প্যাংগং সো। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ভারত ও চীনের সেনা।
ছবি: DW/S. Ghosh
লাদাখ-তিব্বত মালভূমি
আমরা ঢুকে পড়েছি লাদাখ-তিব্বতের শীতল মরুভূমিতে। চারিদিক ধূসর। মাঝে মাঝে সামান্য সবুজ। সেখানেই মানুষের বাস।
ছবি: DW/S. Ghosh
আছে শুধু সেনা
এই মনুষ্যবর্জিত ল্যান্ডস্কেপে গাছ নেই, অক্সিজেন খুব কম। তারই মাঝে মাঝে সেনার ছাওনি। যে দেশের সেনা যত বেশি উচ্চতায় থাকতে পারবে, যুদ্ধে তার তত সুবিধা৷
ছবি: DW/S. Ghosh
লাদাখ মানে শান্তি
বিমান পৌঁছেছে লে-র আকাশে। এখন এখানে যুদ্ধের ঘনঘটা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় উড়ছে যুদ্ধবিমান। এটা লে-র স্বাভাবিক ছবি নয়। লে মানে শান্তি। সর্বধর্মের সহাবস্থান।
ছবি: DW/S. Ghosh
9 ছবি1 | 9
তা হলে সমাধান কোথায়? সংসদে দাঁড়িয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী যা বলেছেন, যে ভাবে 'যুদ্ধ' শব্দটি কৌশলে ব্যবহার করেছেন, তা থেকে অনেকেই মনে করছেন, আপাতত সমঝোতায় যাওয়ার কথা ভাবছে না ভারত। বরং সময় কেনার চেষ্টা করছে। দেখতে চাইছে, চীন এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়। কারণ, এই মুহূর্তে চীনের সঙ্গে সমঝোতা করে সেনাদের বর্তমান অবস্থান থেকে পিছিয়ে নিলে তা ভারতের ক্ষতি বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। গত ১৫ বছর ধরে ডেপসাং এবং প্যাংগং অঞ্চলে ক্রমাগত নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেছে চীন। এ বছরের গোড়াতেও তারা সে কাজ করেছে। ফলে এখন সমঝোতা হলে চীন অ্যাডভান্টেজ পেয়ে যাবে। রাজনাথ বলেছেন, তাঁদের সরকার আগের মতো নয়। যে কোনও প্রক্রিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ভারতের মাথা নত হতে তাঁরা দেবেন না। বাস্তবে যদি তাই ঘটে, তা হলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। শীত যত বাড়বে, ততই পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হবে লাদাখে।
এ দিন সংসদে রাজনাথ বলেছেন, বিষয়টি সংবেদনশীল। দেশের নিরাপত্তার বিষয় জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে। ফলে সব কথা সংসদে দাঁড়িয়ে তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট কয়েকজন সংসদকে নিয়ে একান্ত বৈঠকে আরও বিশদে আলোচনা করবেন তিনি।