জুন থেকে অক্টোবর, গত চার মাসে সাতবার বৈঠকে বসেও লাদাখ সমস্যার সমাধানসূত্র মিলল না। সোমবার সর্বশেষ বৈঠকেও ভারত এবং চীনের সেনা কম্যান্ডাররা একে অপরের দিকে শুধু আঙুলই তুললেন।
সোমবার লাদাখে ভারত-সীমান্তে চুসুলে বৈঠকে বসেছিলেন ভারত এবং পিপলস রিপাবলিক আর্মির সেনা অফিসররা। ভারত এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রকের গুরুত্বপূর্ণ অফিসাররাও সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য এই প্রথম সেনা স্তরের বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রকের অফিসার পাঠালো চীন। ডয়চে ভেলেকে সেনা সূত্র জানিয়েছে, সোমবার সকালে বৈঠক শুরু হয়। সন্ধে পর্যন্ত সেই বৈঠক চলে। দুই দেশই সমাধান সূত্র বার করার মরিয়া চেষ্টা করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেনা সরাতে রাজদি হয়নি কোনও পক্ষই।
সেনা সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকে ভারত দাবি করেছে, এপ্রিল মাসের আগে সীমান্তের যে অবস্থা ছিল, সেই অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। চীনকে সেনা সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু চীন সেনা সরাতে রাজি হয়নি। তাদের দাবি, গত কয়েক মাসে, বিশেষ করে অগাস্টে ভারত প্যাংগং লেকের দক্ষিণে যে অঞ্চল দখল করেছে, সেখান থেকে প্রথমে ভারতকে সেনা সরাতে হবে। তারপরেই চীন সেনা সরানোর কথা ভাববে।
বার বার সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও চীনের সেনা। কেন? ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ছবি: Rouf Bhat/Afp/Getty Imagesভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ লাদাখে। বাকি অংশ উত্তর পূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে।
ছবি: DW/H. Joshiলাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষ বসবাস করে না। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo১৩৪ কিলোমিটার লম্বা প্যাংগং লেক ১৪ হাজার ফুটে অবস্থিত। নোনতা জলের এই হ্রদকে ঘিরে প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জমি। প্যাংগংয়ের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের দখলে। দুই-তৃতীয়াংশ চীনের। প্রকৃত সীমান্তরেখা এই লেকের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। ভারতের দাবি, চীন সেই সীমান্তরেখা অগ্রাহ্য করে ভারতের জমি দখল করছে এবং সীমান্তের খুব কাছে রাস্তা বানাচ্ছে। চীনের দাবি, ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা মানছে না।
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Karelগালওয়ানের খুব কাছ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা গিয়েছে। চীন তিব্বতের উপর দিয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে। যাকে কারাকোরাম হাইওয়ে বলা হয়। ভারতের অভিযোগ, ওই হাইওয়ের জন্যই লাদাখের একটি অংশের দখল নিতে চায় চীন। তা করতে পারলে আরও সহজ একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত তা হতে দিতে চায় না। গালওয়ান সমস্যার মূল কারণ এটিই।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Vatsyayanaদারবুক, শাইয়োক হয়ে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে ভারত। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের উচ্চতম এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে ভারত। এই এয়ার স্ট্রিপ এবং সিয়াচেন পর্যন্ত রাস্তা নিয়ে চীনের আপত্তি আছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Khawer১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে উত্তর পূর্ব ভারত এবং তিব্বতের সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়েছিল ম্যাকমোহন লাইনের মাধ্যমে। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে এই লাইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে চীনকে নেওয়া হয়নি। সেই তখন থেকেই অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে অরুণাচল অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে এই সমস্যার সমাধানে দুই দেশ আলোচনা করেছে। তবে চীন এখনও মনে করে অরুণাচল তাদের।
ছবি: Prabhakar Maniসীমান্ত সমস্যার জেরে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর সরাসরি দুই দেশের মধ্যে আর কোনও যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা-য় দুই দেশের সৈন্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলের তুলু লা-তে ফের সংঘর্ষ হয় দুই দেশের সেনার। যদিও কোনওটাই দীর্ঘ সংঘর্ষ বা যুদ্ধের স্তরে পৌঁছয়নি। তবে জুন মাসে গালওয়ানের ঘটনা নজিরবিহীন।
ছবি: DW কিন্তু চীনের এই প্রস্তাব ভারত মানতে রাজি হয়নি। কারণ, ভারতের দাবি, অগাস্টে ভারত প্যাংগংয়ের দক্ষিণে যে পাহাড়ে পোস্ট তৈরি করেছে, তা ভারতেরই জায়গা। কিন্তু চীনের বক্তব্য, ওই পোস্ট থেকে প্রকৃত সীমান্ত রেখার অন্য প্রান্তে চীনের সেনার অবস্থান স্পষ্ট দেখা যায়। ফলে ভারতকে ওই স্ট্র্যাটেজিক এলাকা ছাড়তে হবে। ভারত কোনো ভাবেই তাতে রাজি হয়নি। ফলে গত ছয়টি বৈঠকের মতো সোমবারের বৈঠকও ভেস্তে গিয়েছে।
ভারতীয় সেনার সাবেক লেফটন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্যের মতে, ভারত এবং চীনের এলএসি বা প্রকৃত সীমান্ত রেখা স্পষ্ট নয়। দুই তরফই নিজেদের মতো করে এলাকা চিহ্নিত করে। এবং সে কারণেই এ বারের সংঘাতের কোনও সমাধানসূত্র মিলছে না। বস্তুত, প্যাংগং লেক, গোগরা, হটস্প্রিং, ডেপসাংয়ে চীন প্রকৃত সীমান্ত রেখা উপেক্ষা করে সৈন্য মোতায়েন করেছে বলে ভারতের অভিযোগ। এবং সে কারণেই ভারত বার বার এপ্রিলের আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে। চীন যা মানতে চাইছে না।
চীন পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম রাষ্ট্র৷ পূর্ব এশিয়ার দেশটির সঙ্গে স্থলসীমানা রয়েছে আরো ১৪টি দেশের৷ এদের অনেকের সঙ্গেই সীমানা নিয়ে ঝগড়া রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশটির৷
চীনের দীর্ঘতম সীমানা রয়েছে মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে (৪,৬৭৭ কিলোমিটার)৷ স্থলসীমায় আবদ্ধ মঙ্গোলিয়ার আরেক প্রতিবেশী দেশ হলো রাশিয়া৷ অতীতে বিরোধপূর্ণ ইতিহাস থাকলেও চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে এখন সীমানা নিয়ে কোনো বিরোধ নেই মঙ্গোলিয়ার৷
ছবি: Reuters/B. Rentsendorjরাশিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় দীর্ঘতম সীমানা রয়েছে চীনের৷ তেমন বড় কোনো বিরোধ নেই৷
ছবি: Reuters/H. Wuভারতের সঙ্গে চীনের যৌথ সীমানা তিন হাজার ৩৮০ কিলোমিটারের৷ এর মধ্যে তিনটি অংশ জুড়ে বিরোধ রয়েছে৷ সম্প্রতি লাদাখে সংঘর্ষের যে ঘটনাটি ঘটেছে তা হলো পূর্ব অংশের সীমানায়৷ এছাড়া নেপাল ও ভুটানের সীমানা রয়েছে মাঝখানে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photoবাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের সঙ্গে চতুর্থ বৃহত্তম সীমানা রয়েছে চীনের, প্রায় দুই হাজার ১৮৫ কিলোমিটারের৷ অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে ভারত ও চীনের দ্বন্দ্বে মিয়ানমারও রয়েছে৷ কারণ, সে অংশে তাদেরও সীমানা রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpaমধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তানের সঙ্গে চীনের সীমান্ত এলাকা প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার (১,৫৩৩ কিমি) দীর্ঘ৷ সীমানা বিরোধ বলতে তেমন কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS/H. Huhuউত্তর কোরিয়া ও চীনের যৌথ সীমানার দৈর্ঘ্য এক হাজার ৪১৬ কিলোমটার৷ পায়েকতু পর্বত ও জিয়ানদাও এলাকা নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে দু’দেশের৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yonhapমধ্য এশিয়ার আরেক দেশ কিরগিস্তানের সঙ্গে ৮৫৮ কিলোমিটারের সীমানা রয়েছে চীনের৷
ছবি: DW/L. Salm-Reifferscheidtদক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে চীনের সীমানা রয়েছে এক হাজার ২৮৩ কিলোমিটারের৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltd/D. Henleyপাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ৫২৪ কিলোমিটারের সীমানা৷ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সীমানা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর নির্ভর করছে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমানা বিরোধের অবস্থা৷
ছবি: Reuters/R. Saeed Khanদক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটানের সঙ্গে ৪৭০ কিলোমিটারের সীমানা রয়েছে চীনের৷ এর মধ্যে কিছু অংশ নিয়ে বিরোধও আছে৷ ভারতের সঙ্গে চীনের সীমানা বিরোধের জেরও টানতে হচ্ছে ভুটানের৷
নেপালের সঙ্গেও চীনের সীমানা রয়েছে৷ এর দৈর্ঘ্য এক হাজার ৪৪০ কিলোমিটার৷ কালাপানি এলাকায় নেপাল ও ভারতের মধ্যে বিরোধ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/N. Shresthaচীন ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ লাওসের মধ্যকার সীমানা প্রায় ৪২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Hoelzlমধ্য এশিয়ার দেশ তাজিকিস্তানের সঙ্গে চীনের সীমানার দৈর্ঘ্য ৪১৪ কিলোমিটার৷
ছবি: picture-alliance/Photoshotআফগানিস্তানের সঙ্গে সবচেয়ে কম এলাকার সীমানা রয়েছে চীনের৷ মাত্র ৭৬ কিলোমিটারের৷
ছবি: Getty Images/AFP/Shefayeeদক্ষিণ চীন সাগরে ব্রুনেই, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স ও ভিয়েতনামের সঙ্গে সীমানা নিয়ে বিরোধ আছে চীনের৷ এছাড়া পূর্ব চীন সাগরেও জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক এলাকা নিয়ে বিরোধ রয়েছে চীনের৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/M. Xiaoliang সমস্যা রয়েছে আরো। এই মুহূর্তে ভারত এবং চীন দুই পক্ষই প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য সীমান্তে জড়ো করেছে। কোনও কোনও মহলের বক্তব্য চীনের সেনা রয়েছে ৬০ হাজার। একই সঙ্গে এয়ার টু গ্রাউন্ড মিসাইল থেকে শুরু করে বিভিন্ন অস্ত্রও দুই পক্ষ সীমান্তে এনে রেখেছে। এখন যদি সেনা সরানোর প্রস্তাবে সায় দিতে হয়, তা হলে সীমান্ত থেকে অনেকখানি পিছিয়ে যেতে হবে। সরিয়ে নিতে হবে অস্ত্রও। কিন্তু তারপরেও সংঘাত বন্ধ না হলে শীতে সেই অস্ত্র এবং সেনার সরঞ্জাম ফের সীমান্তে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। কারও কারও মতে প্রায় অসম্ভব। কয়েক দিনের মধ্যেই লাদাখের বহু রাস্তা বরফে বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আর বড় বড় সেনার গাড়ি সেখানে নিয়ে যেতে পারবে না। অস্ত্রও নেয়া যাবে না। ফলে কোনো পক্ষই সেনা সরাতে রাজি হচ্ছে না।
তা হলে কি লাদাখ সমস্যার সমাধান নেই? কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে, শীতে সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা কম। বরং উল্টোটা হতে পারে। সামান্য সমস্যাও এলাকাভিত্তিক লড়াইয়ের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। অতীতেও যা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সংঘাত আরও বাড়বে। যদি তা না হয়, তা হলে শীতের পরে দুই পক্ষই সেনা সরানোর প্রস্তুতি শুরু করতে পারে।
তবে একটি কথা স্পষ্ট। কূটনৈতিক স্তরে দুই দেশের মন্ত্রী বৈঠক করে যে সমাধানের রাস্তা তৈরি করেছিলেন, বাস্তবতা তার সঙ্গে মিলছে না। এবং সে কারণেই সেনা স্তরের বৈঠক আজ পর্যন্ত একটিও ফলপ্রসূ হয়নি।