ভারতে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে কয়েকটি বিয়ে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে সন্ত্রাসবিরোধী এজেন্সি এনআইএ৷ অভিযোগ রয়েছে, এসব বিয়ের মাধ্যমে হিন্দু নারীদের কার্যত মুসলমান বানিয়ে সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
ভারতের কেন্দ্রীয় সন্ত্রাসবিরোধী এজেন্সি এনআইএ সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে যে, কেরালা রাজ্যে দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে নব্বইটি বিয়ে নিয়ে তদন্ত করছে সংস্থাটি৷ কেননা, এসব বিয়ের সময় হিন্দু নারীদের প্রলুব্ধ করে বা জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷ গত দুই বছরে এসব বিয়ের ঘটনা ঘটেছে৷
দেশভাগের আগুন, যা এখনো জ্বলছে
১৯৪৭ সালের ১৪/১৫ আগস্ট ব্রিটিশদের অধীনে থাকা ভারত দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল৷ হিন্দু অধ্যুষিত ভারত এবং মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান৷ সেই থেকে দুই দেশের কিছু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছাড়া কোনো উন্নতি হয়নি৷ বরং শত্রুতা বেড়েই চলেছে৷
ছবি: AP
দুই দেশের জন্ম
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের অধীনে থাকা ভারত দুই দেশে বিভক্ত হয়৷ জন্ম নেয় নতুন দুই রাষ্ট্র৷ ভারত ও পাকিস্তান৷ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং তাঁর দল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ প্রথমে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর উপর নিজেদের আধিপত্য দাবি করেন এবং পরবর্তীতে মুসলিমদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্রের দাবি জানান৷ জিন্নাহ’র বিশ্বাস ছিল হিন্দু আর মুসলিমরা ভবিষ্যতে একসাথে থাকতে পারবে না৷
ছবি: picture alliance/dpa/United Archives/WHA
রক্তাক্ত পথ
পার্টিশন বা দেশ বিভাগ নৃশংস এবং ভয়াবহ এক অধ্যায়ের নাম৷ ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে পাঞ্জাবে৷ ইতিহাসবিদরা বলেন, ঐ দাঙ্গায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়৷ জন্মভূমি ছেড়ে ভারত থেকে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে ভারতে আসে লাখ লাখ মানুষ৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Images
১৯৪৮ সালের যুদ্ধ
ভারত ও পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতা পাওয়ার পর কাশ্মীর নিয়ে আবারো বিবাদে জড়িয়ে পড়ে৷ মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীরের দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল হিন্দু নেতার হাতে৷ কিন্তু জিন্নাহ চাইলেন এটা যাতে পাকিস্তানের অধীন হয়৷ ১৯৪৮ সালে দুই দেশের সেনাবাহিনী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে৷ কাশ্মীর উপত্যকার বেশিরভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ভারতীয় সেনারা৷ কিন্তু সেই সংঘর্ষের জের অব্যাহত আছে আজও৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/M. Desfor
যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার মতো
উদারপন্থি ইতিহাসবিদরা বলেন, জিন্নাহ এবং মহাত্মা গান্ধী নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র দু’টির মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন চেয়েছিলেন৷ জিন্নাহ’র আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডার মতো সম্পর্ক হবে ভারত-পাকিস্তানের৷ কিন্তু ১৯৪৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তার উত্তরসূরিরা নতুন দিল্লির সঙ্গে বিবাদ অব্যাহত রাখে৷
ছবি: AP
উপস্থাপনের ভিন্নতা
ভারত ও পাকিস্তান সরকার দেশভাগের ব্যাপারটিকে একেবারে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করে৷ ভারত এটাকে ব্রিটিশদের শাসন থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের স্বাধীনতা আন্দোলনের ফসল হিসেবে উল্লেখ করে, যেখানে মহাত্মা গান্ধীকে এর স্থপতি বলা হয়৷ অন্যদিকে, পাকিস্তানি পাঠ্যপুস্তকে ব্রিটিশ এবং হিন্দুদের আধিপত্য থেকে মুক্তির আন্দোলন হিসেবে উল্লেখ করা হয় ১৪ আগস্টকে৷
ছবি: picture alliance/dpa/AP Photo/M. Desfor
সম্পর্কের টানা-পোড়েন
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গত সাত দশক ধরেই তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে৷ আর গত কয়েক বছর ধরে ইসলামি জঙ্গিবাদের কারণে সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে দু’দেশের মধ্যে৷ নয়া দিল্লি বরাবরই পাকিস্তানকে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে জঙ্গিবাদে মদদদাতা হিসেবে দায়ী করে আসছে৷ আর ইসলামাবাদ বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে৷
ছবি: Picture alliance/AP Photo/D. Yasin
6 ছবি1 | 6
এনআইএ আরো জানিয়েছে যে, কোনো সংগঠিত গোষ্ঠী অসহায় হিন্দু নারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেয়ার দায়িত্ব রয়েছে সংস্থাটির৷ উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক এক ‘হাই-প্রোফাইল' মামলাকে কেন্দ্র করে এনআইএ তদন্তে নামে৷ গত ডিসেম্বরে ২৪ বছর বয়সি আখিলা অশোকান মুসলিম যুবক শাফিন জাহানকে বিয়ে করার পর হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন৷ তিনি তাঁর নাম বদলে রাখেন হাদিয়া৷
তবে হিন্দু বাবার অনুরোধে কেরালার হাইকোর্ট হাদিয়ার বিয়ে বাতিল করে দেয় এবং তাঁকে তাঁর বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে বলে৷ হাদিয়া ফিরে গেলে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়৷ অন্যদিকে, তার মুসলিম স্বামী আদালতের বিয়ে বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে৷
বর্তমানে এই বিষয়টি নিয়ে ভারতের বিচার বিভাগে ব্যাপক বিতর্ক হচ্ছে৷ একটি আদালত একজন মানুষের ব্যক্তি জীবনের উপর কতটা জোর খাটাতে পারে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে৷ এখন সর্বোচ্চ আদালত হাদিয়াকে হাজির হতে বলেছে যাতে তিনি নিজে তাঁর পরিস্থিতির কথা জানাতে পারেন৷ অর্থাৎ তাঁকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, নাকি নিজের ইচ্ছায় ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, তা জানতে চায় আদালত৷
যেসব দেশে বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ইউনিসেফ-এর ‘স্টেট অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন’ রিপোর্টে বিভিন্ন দেশের বাল্যবিবাহের হিসাব রয়েছে৷ মেয়েদের বয়স ১৮ হওয়ার আগে বিয়ে হলে সেটিকে বাল্যবিবাহ হিসেবে গণনা করে ইউনিসেফ৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/P. Hatvalne
নাইজার (৭৬%)
ইউনিসেফ বলছে, আফ্রিকার এই দেশটিতেই বাল্যবিবাহের হার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি৷ সেখানে মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৫৷ তবে এটি পরিবর্তন করে ১৮ করার প্রস্তাব করা হয়েছে৷ মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার পেছনে দরিদ্রতা একটি অন্যতম বড় কারণ হিসেবে কাজ করে৷ এছাড়া বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লে সামাজিকভাবে যে হেনস্তার শিকার হতে হয়, তা এড়াতেও মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয় পরিবার৷
ছবি: picture alliance/Godong
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (৬৮%)
দ্বিতীয় স্থানে থাকা এই দেশটিতে মেয়েদের বিয়ে করার বা দেয়ার বৈধ সর্বনিম্ন বয়স ১৮৷ তবে বাবা-মা ১৩ বছর বয়সি মেয়েরও বিয়ে দিতে পারেন, যদি আদালত অনুমতি দেয় কিংবা মেয়েটি যদি গর্ভবতী হয়৷ বাবা-মায়ের অনুমতি সাপেক্ষে তার চেয়েও কমবয়সি মেয়েদের বিয়ে দেয়া বৈধ সেখানে৷
ছবি: Reuters
চাড (৬৮%)
২০১৫ সালের জুনে চাডের সংসদে পাস হওয়া অর্ডিন্যান্সে, মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৫ থেকে বাড়িয়ে ১৮ করা হয়েছে৷ এছাড়া বাল্যবিয়ের সঙ্গে জড়িতদের জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/O.Cicek
মালি (৫৫%)
মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৬ আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৮ বছর৷ তবে শরিয়া আইন অনুযায়ী ১৬ বছরের কমবয়সি মেয়েদেরও বিয়ে দেয়া যেতে পারে৷ কমবয়সি মেয়েদের সাধারণত দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করে থাকে বেশি বয়সি পুরুষরা৷
ছবি: Joel Saget/AFP/Getty Images
বাংলাদেশ (৫২%)
মেয়েদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স ১৮, ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১৷ তবে সম্প্রতি পাস হওয়া একটি আইনে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপট’ বিবেচনায় ১৮ বছরের কম বয়সিদেরও বিয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
বুর্কিনা ফাসো (৫২%)
২০ থেকে ২৪ বছর বয়সি নারী, যাদের বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বিয়ে হয়েছে, তাদের সংখ্যা ধরে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ইউনিসেফ৷ ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য এতে ব্যবহার করা হয়েছে৷ বুর্কিনা ফাসোতে ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ের হার ১০ শতাংশ৷ আর ১৮ বছরের কমবয়সিদের ক্ষেত্রে হারটি ৫২ শতাংশ৷
ছবি: Getty Images/P.Parrot
গিনি (৫২%)
মা-বাবা’র অনুমতি নিয়ে বা না নিয়ে ১৮ বছরের ছেলে কিংবা মেয়ে সেখানে বিয়ে করতে পারেন৷ দেশটিতে যার যতজন অল্পবয়সি স্ত্রী আছে তার সামাজিক মর্যাদা তত বেশি বলে ধরে নেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. von Trotha
দক্ষিণ সুদান (৫২%)
চরম দারিদ্র্য, যুদ্ধ, দেশের অস্থির পরিবেশ, শিক্ষিতের হার কম হওয়া, মেয়েদের শিক্ষার সুযোগের অভাব - এসব নানা কারণে আফ্রিকার সবচেয়ে নবীন দেশটিতে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ অল্প বয়সি মেয়ে ও তাদের পরিবার মনে করে, বিয়ে দেয়ার মাধ্যমে দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/M.Elshamy
মোজাম্বিক (৪৮%)
মেয়েদের জন্য বিয়ের বৈধ সর্বনিম্ন বয়স ১৮৷ তবে পরিবারের সম্মতিতে ১৬ বছর বয়সিরাও বিয়ে করতে পারে বা তাদের বিয়ে দেয়া যায়৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/S.Mohamed
ভারত (৪৭%)
মেয়েদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়স ১৮, আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১৷ দেশটিতে ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের মধ্যে বিয়ের হার প্রায় ১৮ শতাংশ৷ ভারতের অনেক সমাজে মেয়েদের অর্থনৈতিকভাবে বোঝা মনে করা হয়৷ বিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সেই বোঝা স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া যায় বলে মনে করে অনেক পরিবার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/P. Hatvalne
10 ছবি1 | 10
এদিকে, হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বিয়ে নিয়ে তদন্তের বিষয়টির সমালোচনাও করছেন অনেকে৷ কেরালা রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র ফুয়াদ হালিম বলেন, ‘‘এই তদন্তের মাধ্যমে আসলে ভোট পাওয়ার স্বার্থে দুই ধর্মের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভেদ এবং ঘৃণার বীজ বোনা হচ্ছে৷'' তিনি এজন্য হিন্দু উগ্রবাদীদের দায়ী করেন৷
তবে নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এনআইএ'র এক কর্মকর্তা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন যে, কেরালায় যা হচ্ছে, তাকে স্রেফ মনস্তাত্বিক অপহরণের সঙ্গে তুলনা করা যায়৷ এজেন্সিটির কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ রয়েছে বলেও দাবি করেছেন সেই কর্মকর্তা৷
এনআইএ এখন অবধি দুই হিন্দু নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যাঁরা দাবি করেছেন যে, তাঁদের ধর্মন্তরিত হতে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল৷ তাঁদের একজন জানিয়েছেন যে, বিতর্কিত ইসলাম ধর্ম প্রচারক জাকির নায়েকের এক ভিডিও তাঁকে ধর্মান্তরিত হতে উৎসাহ জুগিয়েছিল৷
উল্লেখ্য, ডানপস্থি হিন্দু সংগঠনগুলো হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টিকে ‘লাভ জিহাদ' হিসেবে বিবেচনা করেন৷ তারা দাবি করেন যে, মুসলমান পুরুষরা হিন্দু নারীদের বিয়ে করে তাদের ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেন এবং অনেক সন্তান নেয়ার পর তাদের ছেড়ে দেন৷ তবে হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে বিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কিছু নয়৷ এই চর্চা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে৷