লিবিয়ার এক সশস্ত্রগোষ্ঠীর নেতা খলিফা হাফতারের রাজধানী ত্রিপোলি দখলের অভিযানে এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন অন্তত ২১ জন৷ জাতিসংঘ অস্ত্রবিরতির চেষ্টা চালালেও তা একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য সাময়িক অস্ত্রবিরতিতে দুই পক্ষকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল জাতিসংঘ৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ত্রিপোলি সরকার ও দেশটির পূর্বাঞ্চলের দখলে থাকা হাফতারের যোদ্ধাদের মধ্যে চলছে তীব্র লড়াই৷ গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে হাফতারের এই ত্রিপোলি দখল অভিযান৷
সবশেষ তথ্য
সরকারপন্থি ও হাফতারপন্থি যোদ্ধাদের লড়াইয়ে নিহত হয়েছেন অন্তত ২১ জন৷
যুদ্ধে আহত আবং বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য অন্তত দুই ঘণ্টার অস্ত্রবিরতি ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ৷
‘নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনা' করে নিজেদের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷
বেসামরিক নাগরিকরা ‘হুমকিতে'
হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি- এলএনএ'র মুখপাত্র আহমেদ মিসমারি জানান, ‘‘অভিযানে প্রথমবারের মতো যোগ দিয়েছে বিমানবাহিনী৷ বিমানবন্দর থেকে শহরে প্রবেশের সড়ক এরই মধ্যে দখলে নেয়া হয়েছে৷''
সাগর থেকে শরণার্থীদের উদ্ধারে এনজিও-র জাহাজ
গত ইস্টারে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত জাহাজ ‘অ্যাকোয়ারিয়াস’ প্রায় ৩০০ মানুষকে ভূমধ্যসাগর থেকে বাঁচিয়েছে৷ একটি অভিযান চলাকালীন ইউরোপীয় নৌ কর্তৃপক্ষ ৮০-৯০ জন উদ্বাস্তুকে উদ্ধার করা থেকে ‘অ্যাকোয়ারিয়াস’-কে বিরত রাখে৷
ছবি: DW/F. Warwick
সর্বাগ্রে অকুস্থলে পৌঁছাও
৩১শে মার্চ, শনিবার৷ সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ইটালিয়ান মেরিটাইম রেস্কু কোঅর্ডিনেশন সেন্টার বা আইএমআরসিসি অ্যাকোয়ারিয়াস জাহাজ ও লিবীয় উপকূলরক্ষীদের কাছে খবর পাঠায় যে, একটি রাবারের ডিঙি আন্তর্জাতিক সমুদ্রে বিপদে পড়েছে৷ এসওএস মেডিটারেনি সংস্থা ও ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্স বা এমএসএফ সংস্থার কর্মী, জাহাজের মাল্লা ও মেকানিকরা ‘অ্যাকোয়ারিয়াস’-কে চালিয়ে থাকেন৷
ছবি: DW/F. Warwick
অথৈ সাগর
এগারোটা নাগাদ অ্যাকোয়ারিয়াস খোলা সাগরে ভাসমান রাবারের ডিঙিটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমর্থ হয়৷ এর খানিক পরেই আইএমআরসিসি এসওএস সংস্থার মুখ্য সমন্বয়কারীকে জানায় যে, লিবীয় উপকূলরক্ষীরা উদ্বাস্তুদের উদ্ধারের দায়িত্ব নেবেন৷ রাবারের ডিঙির আরোহীরা স্পষ্টতই বিপন্ন, হাত নেড়ে তাঁরা তা বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন৷ অ্যাকোরিয়াসকে ডিঙির কাছে থেকে উত্তরোত্তর নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়৷
ছবি: DW/F. Warwick
শেষমেষ...
দু’ঘণ্টা ধরে লিবীয় উপকূলরক্ষীদের কোনো চিহ্ন দেখতে না পাওয়ার পর আইএমআরসিসি ও লিবীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শিশু, মহিলা ও পরিবারবর্গকে উদ্ধার করার অনুমতি পায় অ্যাকোয়ারিয়াস৷ এভাবে ৩৯ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও রাবারের ডিঙিতে ভাসমান বাদবাকি ৮০-৯০ জন মানুষকে লিবীয় উপকূলরক্ষীদের আগমনের আশায় ছেড়ে আসতে হয়৷
ছবি: DW/F. Warwick
সবে মিলে করি কাজ
এমএসএফ-এর নার্স সিলভি অ্যাকোরিয়াসের দ্রুতগতির উদ্ধার নৌকাটিতে ছিলেন৷ ঐ বোটের কর্মীরা সেই সব রুগ্ন ও বিপন্ন মানুষকে শনাক্ত করেন, পরে যাদের অ্যাকোয়ারিয়াস জাহাজে নিয়ে যাওয়া হবে৷ এভাবে অ্যাকোয়ারিয়াসের তিনটি অভিযানে ২০টি দেশ থেকে আগত ২৯২ জন মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, যাদের অধিকাংশই এসেছেন সাব-সাহারান আফ্রিকা থেকে৷ অনেকেই মুখ-চোখে জলাভাব, ক্লান্তি, দুর্বলতা – এমনকি শারীরিক নির্যাতনের ছাপ৷
ছবি: DW/F. Warwick
ছোট ছোট খুশি
বাবা-মায়েরা অ্যাকোয়ারিয়াসের পাটাতনের উপর বসে হাঁফ ছাড়ছেন৷ ছোটদের মুখে কিন্তু ইতিমধ্যেই হাসি ফুটেছে, বিশেষ করে এমএসএফ-এর লজিস্টিকস বিশেষজ্ঞ ফ্রঁসোয়া তাদের সঙ্গে খেলায় নেমে পড়ার পর৷
ছবি: DW/F. Warwick
ডাক্তারের চেম্বারে
ডক্টর ড্যান ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছেন৷ উদ্ধারের পর জাহাজে আনা সব উদ্বাস্তুকে তিনি পরীক্ষা করে দেখেন, কারো কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন আছে কিনা৷ ডাঙায় নামার পর ইটালির স্থানীয় চিকিৎসা বিভাগের কর্মীরা উদ্বাস্তুদের আরো একবার পরীক্ষা করে দেখবেন৷
ছবি: DW/F. Warwick
আবহাওয়া খারাপ হলে...
ঝোড়ো বাতাস আর ঢেউয়ে অ্যাকোয়ারিয়াস জাহাজ যখন টালমাটাল, তখন এসওএস মেডিটারেনি সংস্থার এক কর্মী আগের দিন উদ্ধার করা একটি শিশুকে কোলে করে বসে আছেন৷ ‘‘নাবিক হিসেবে আমাদের কাজ হলো বিপন্ন সবাইকে উদ্ধার করা,’’ বললেন তিনি৷ ‘‘গতকাল আমরা সবাই চোখের জল ফেলেছি৷ আমি একটি শিশুকে কোলে নিয়ে অন্যান্য বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে ছিলাম৷ আমরা কিছু মহিলাদেরও সাহায্য করেছি৷’’
ছবি: DW/F. Warwick
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ...
অ্যাকোয়ারিয়াস যখন সিসিলির মেসিনা বন্দরে পৌঁছাচ্ছে, তখন অনেক উদ্ধার করা মহিলা ইংরেজি অথবা ফরাসিতে গসপেলের গান গেয়ে নিরাপদে ভূমধ্যসাগর পার করার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান৷
ছবি: DW/F. Warwick
পায়ের তলার মাটি...
ফ্রঁসোয়া নিজে ২৯২ জন উদ্ধারকৃত স্ত্রী-পুরুষ ও শিশুদের জাহাজ থেকে নামতে সাহায্য করেন৷ ‘‘মানসিকভাবে ব্যাপারটা সহজ নয়, কারণ, শেষজন ডাঙায় নামলেই আমার কাজ শেষ৷ শুধু সকলকে টেলিফোন করে বলে দেওয়া যে, সকলে ভালোভাবে নেমে গেছে৷ তখন যেন ভিতরটা খালি হয়ে যায়৷’’
ছবি: DW/F. Warwick
পরিশ্রমের পুরস্কার...
বিদায়ের সময় ফ্রঁসোয়ার গালে এক উদ্বাস্তু শিশুর চুম্বন৷ শিশুটির ভাগ্য ভালো, কারণ, সে আর তার পরিবার ইউরোপে পৌঁছাতে পেরেছে৷ তাদের মতো সাড়ে সাত লাখ থেকে নয় লাখ উদ্বাস্তু, অভিবাসন প্রয়াসী ও রাজনৈতিক আশ্রয় সন্ধানী লিবিয়ার ‘মাইগ্র্যান্ট ডিটেনশন সেন্টার’গুলিতে জাতিসংঘের ভাষায় ‘অমানবিক’ পরিস্থিতিতে আটকা পড়ে রয়েছেন৷ সাগরে নাও ভাসানো ছাড়া এই সব অসহায় মানুষদের আর কোনো উপায় আছে কি?
ছবি: DW/F. Warwick
10 ছবি1 | 10
অন্যদিকে, সরকারি বাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল মোহামেদ নোউনোউ জানিয়েছেন, তাঁদের অভিযানের লক্ষ্য পুরো লিবিয়াকে ‘অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করা'৷
অবিলম্বে ‘অভিযান বন্ধে' হাফতারকে আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও৷ তিনি বলেন, ‘‘ত্রিপোলিতে একপাক্ষিক এই সেনা অভিযান বেসামরিক নাগরিকদের জীবন হুমকির মুখে ফেলছে এবং সকল লিবিয়ানের উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন ধ্বংস করে দিচ্ছে৷''
২০১১ সালে গাদ্দাফির সরকার বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমনপীড়ন শুরু করেন৷ তখন থেকেই অস্থিতিশীল লিবিয়ার পরিস্থিতি৷ ন্যাটো-সমর্থিত বিদ্রোহীরা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করে এবং গাদ্দাফিকে হত্যা করে৷ কিন্তু তখন থেকে ত্রিপোলির ক্ষমতার লড়াইয়ে রয়েছে বিভিন্ন বিবদমান পক্ষ৷
গত বছর ত্রিপোলির ফায়েজ আল-সারাজের সরকার, হাফতার ও অন্য বেশকিছু বিদ্রোহী পক্ষের মধ্যে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি সমঝোতা হয়৷ ২০১৯ সালের শেষের দিকে সাধারণ নির্বাচনে রাজি হয় সব পক্ষ৷
কিন্তু এবার হাফতার বলছেন, ত্রিপোলি সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতায় তিনি হতাশ৷ এদিকে, হাফতারের বিরুদ্ধে ‘চুক্তিভঙ্গের' অভিযোগ এনেছে জাতিসংঘ-সমর্থিত ত্রিপোলি সরকার৷
১৯৬৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে গাদ্দাফিকে সহায়তা করেছিলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা খলিফা হাফতার৷ কিন্তু পরবর্তীতে গাদ্দাফির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়৷ ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধে গাদ্দাফির সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাফতার ও তাঁর বাহিনী ছিল সামনের সারিতে৷
এডিকে/জেডএইচ (এএফপি, রয়টার্স)
গাদ্দাফির পর কেমন চলছে লিবিয়া?
লিবিয়ার সাবেক নেতা মোয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর পর প্রায় ছয় বছর কেটে গেছে৷ এখনও দেশটিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি৷
ছবি: Reuters/R. Casilli
অক্টোবর, ২০১১
ঐ বছর উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ‘আরব বসন্তের’ ঢেউ উঠেছিল৷ লিবিয়াতেও সেই ছোঁয়া লেগেছিল৷ এরই এক পর্যায়ে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লিবিয়া শাসন করা গাদ্দাফি পালিয়ে যান৷ পরে অক্টোবরে তিনি ধরা পড়েন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়৷ অদ্ভুত আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন তিনি৷ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাঁর সরকারের সম্পর্ক ছিল৷
ছবি: AP
শান্তি প্রত্যাশা
গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে বলে আশা করা হয়েছিল৷ সেই লক্ষ্যে ২০১২ সালের জুনে সংসদ নির্বাচনেরও আয়োজন করা হয়৷ কিন্তু তারপর রাজনীতিবিদরা একটি কার্যকর সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হন৷
ছবি: AP
জঙ্গিবাদের প্রসার
দেশটিতে কার্যকর সরকার না থাকায় জঙ্গিবাদের প্রসার হতে থাকে৷ গাদ্দাফিকে সরাতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে একতা গড়ে তুলতে পারলেও তাঁর মৃত্যুর পর নিজেরা একসঙ্গে থাকতে পারেনি৷ ফলে লিবিয়ায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংখ্যাও বাড়ছে৷ তাদেরই একটি অংশ ২০১২ সালে বেনগাজিতে মার্কিন মিশনে হামলা চালায়৷
ছবি: Reuters
রাজনৈতিক বিভক্তি
লিবিয়ার বর্তমান জাতিসংঘ সমর্থিত ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড’ বা জিএনএ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত৷ কিন্তু এর বাইরেও আরও কয়েকটি গোষ্ঠী লিবিয়ার ক্ষমতা তাদের হাতে বলে দাবি করে৷ এই সুযোগে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস লিবিয়ায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে৷
ছবি: picture alliance/Xinhua/H. Turkia
সহায়তা কামনা
লিবিয়ার জিএনএ ও স্বঘোষিত ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা এলএনএ সম্প্রতি দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে ন্যাটোর সহায়তা চেয়েছে৷ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট দূর করার আহ্বান জানিয়েছে জিএনএ ও এলএনএ৷