লিবিয়ায় অভিবাসীদের ক্রীতদাস হিসেবে কেনাবেচার খবর প্রকাশ হওয়ার পর পুরো আফ্রিকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে৷ মহাদেশটির রাজনীতিবিদরা এ বিষয়ে তদন্তের এবং দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
সর্বোচ্চ দরদাতা কে? আটশ' দিনার! ১,০০০ দিনার! ১,১০০ দিনার! সবশেষে ১,২০০ লিবিয়ান দিনার বা ৮০০ মার্কিন ডলার দাম হাঁকা ব্যক্তি জয়ী হন৷ না, কোনো গাড়ির নিলামের কথা বলা হচ্ছে না৷ সাব-সাহারান আফ্রিকার একদল ভীতসন্ত্রস্ত তরুণকে এভাবে নিলামে বিক্রি করা হয় লিবিয়ায়৷
২০১৭ সালের শুরুর দিকে লিবিয়ার একটি বাজারে এভাবে ক্রীতদাস বিক্রির ভিডিও গতসপ্তাহে প্রকাশ করে মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক সিএনএন৷ গণমাধ্যমটি এই বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে, লিবিয়ায় ক্রীতদাস বেচাকেনার বেশ কয়েকটি বাজার রয়েছে, যেখানে ইউরোপে আসতে আগ্রহী আফ্রিকার শরণার্থীদের বিক্রি করছে মানবপাচারকারীদের চক্র৷
গাদ্দাফির পর কেমন চলছে লিবিয়া?
লিবিয়ার সাবেক নেতা মোয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর পর প্রায় ছয় বছর কেটে গেছে৷ এখনও দেশটিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি৷
ছবি: Reuters/R. Casilli
অক্টোবর, ২০১১
ঐ বছর উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ‘আরব বসন্তের’ ঢেউ উঠেছিল৷ লিবিয়াতেও সেই ছোঁয়া লেগেছিল৷ এরই এক পর্যায়ে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লিবিয়া শাসন করা গাদ্দাফি পালিয়ে যান৷ পরে অক্টোবরে তিনি ধরা পড়েন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়৷ অদ্ভুত আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন তিনি৷ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গেও তাঁর সরকারের সম্পর্ক ছিল৷
ছবি: AP
শান্তি প্রত্যাশা
গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে বলে আশা করা হয়েছিল৷ সেই লক্ষ্যে ২০১২ সালের জুনে সংসদ নির্বাচনেরও আয়োজন করা হয়৷ কিন্তু তারপর রাজনীতিবিদরা একটি কার্যকর সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হন৷
ছবি: AP
জঙ্গিবাদের প্রসার
দেশটিতে কার্যকর সরকার না থাকায় জঙ্গিবাদের প্রসার হতে থাকে৷ গাদ্দাফিকে সরাতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে একতা গড়ে তুলতে পারলেও তাঁর মৃত্যুর পর নিজেরা একসঙ্গে থাকতে পারেনি৷ ফলে লিবিয়ায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সংখ্যাও বাড়ছে৷ তাদেরই একটি অংশ ২০১২ সালে বেনগাজিতে মার্কিন মিশনে হামলা চালায়৷
ছবি: Reuters
রাজনৈতিক বিভক্তি
লিবিয়ার বর্তমান জাতিসংঘ সমর্থিত ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড’ বা জিএনএ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত৷ কিন্তু এর বাইরেও আরও কয়েকটি গোষ্ঠী লিবিয়ার ক্ষমতা তাদের হাতে বলে দাবি করে৷ এই সুযোগে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস লিবিয়ায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে৷
ছবি: picture alliance/Xinhua/H. Turkia
সহায়তা কামনা
লিবিয়ার জিএনএ ও স্বঘোষিত ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ বা এলএনএ সম্প্রতি দেশটিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে ন্যাটোর সহায়তা চেয়েছে৷ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট দূর করার আহ্বান জানিয়েছে জিএনএ ও এলএনএ৷
ছবি: Reuters/R. Casilli
5 ছবি1 | 5
আফ্রিকায় ব্যাপক নিন্দা
শরণার্থীদের ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রির খবর প্রকাশ হওয়ার পর আফ্রিকায় নিন্দার ঝড় উঠেছে৷ বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে৷ নাইজারের প্রেসিডেন্ট মাহামাদু ইসোফাউ সেদেশে লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছেন এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে লিবিয়ার বিরুদ্ধে দাসবিক্রির অভিযোগ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন৷
এদিকে, বুর্কিনা ফাসোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলফা বেরি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, তিনিও লিবিয়ার রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছেন৷ আগামী সপ্তাহে আইভরি কোস্টে অনুষ্ঠেয় আফ্রিকান ইউনিয়নের বৈঠকেও এই বিষয়টি আলোচনা করা হবে বলে জানা গেছে৷
ক্রীতদাস বেচাকেনা নিয়ে আইভরি কোস্টে আলোচনা নতুনমাত্রা পেয়েছে, কেননা, গতসপ্তাহে সেদেশের ১৫৫ জন শরণার্থী ইউরোপীয় ইউনিয়নের পুর্নবাসন কর্মসূচির আওতায় দেশে ফিরে গেছেন৷ আইভরিয়ান সরকার জানিয়েছে, লিবিয়া থেকে ফিরে যাওয়া এই মানুষরা শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল৷ তাদের মধ্যে কেউ কেউ দাসত্বের শিকার হয়েছিলেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে৷
লিবিয়ার তদন্তের আশ্বাস
সপ্তাহান্তে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে লিবিয়ার দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করেছে কয়েক হাজার মানুষ৷ এমনকি লন্ডনেও এই বিষয়ে প্রতিবাদ হয়েছে৷ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এরকম এক বিক্ষোভ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীকে৷
শরণার্থী সংকটের কিছু আইকনিক ছবি
ইউরোপে ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী প্রবেশের ছবি গোটা বিশ্বে ছড়িয়েছে এবং মানুষের মতামত সৃষ্টিতে প্রভাব বিস্তার করেছে৷ অভিবাসন এবং অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট ভোগান্তির এত ছবি আগে দেখেনি বিশ্ব৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/E. Morenatti
লক্ষ্য: টিকে থাকা
অনিশ্চিত যাত্রার ধকল সামলাতে হয় শারীরিক এবং মানসিকভাবে৷ ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে হাজার হাজার সিরীয় নাগরিক তুরস্ক হয়ে গ্রিসে জড়ো হয়েছেন৷ সে দেশের তিনটি দ্বীপে এখনো দশ হাজারের মতো শরণার্থী বসবাস করছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস অবধি ছয় হাজার নতুন শরণার্থী এসেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Messinis
পায়ে হেঁটে ইউরোপে
২০১৫ এবং ২০১৬ সালে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ গ্রিস ও তুরস্ক থেকে পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেছে৷ ম্যাসিডোনিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরি, অর্থাৎ বলকান রুট ব্যবহার করে তাদের এই যাত্রার অধিকাংশই ছিল পায়ে হেঁটে৷ অভিবাসীদের এই যাত্রা বন্ধ হয়ে যায়, যখন রুটটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় এবং কয়েকটি দেশ সীমান্তে বেড়া দিয়ে দেয়৷
ছবি: Getty Images/J. Mitchell
বৈশ্বিক আতঙ্ক
এই ছবিটি গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ তিন বছর বয়সি সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির মরদেহ তুরস্কে সমুদ্রতটে ভেসে ওঠে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে৷ ছবিটি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরণার্থী সংকটের প্রতীকে পরিণত হয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/DHA
বিশৃঙ্খলা এবং হতাশা
শেষ সময়ের ভিড়৷ ইউরোপে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুনে ক্রোয়েশিয়াতে এভাবে ট্রেনে এবং বাসে উঠতে দেখা যায় অসংখ্য শরণার্থীকে৷ ২০১৫ সালের অক্টোবরে হাঙ্গেরি সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং শরণার্থীদের জন্য কন্টেইনার ক্যাম্প তৈরি করে৷
ছবি: Getty Images/J. J. Mitchell
বিবেকবর্জিত সাংবাদিকতা
হাঙ্গেরির এক সাংবাদিক এক শরণার্থীকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার ভিডিও নিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমালোচনার ঝড় ওঠে৷ সার্বিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন হাঙ্গেরির একটি এলাকার সেই ঘটনায় আলোচিত সাংবাদিকের চাকুরি চলে যায়৷
ছবি: Reuters/M. Djurica
উন্মুক্ত সীমান্ত নয়
২০১৬ সালের মার্চে বলকান রুট আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেয়ার পর সীমান্তগুলোতে আরো আবেগপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়৷ হাজার হাজার শরণার্থী বিভিন্ন সীমান্তে আটকা পড়ে এবং তাদের সঙ্গে বর্বর আচরণের খবর পাওয়া যায় বিভিন্ন স্থান থেকে৷ অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে৷
ধুলা এবং রক্তে ঢাকা এক শিশু৷ পাঁচবছর বয়সি ওমরানের এই ছবিটি প্রকাশ হয় ২০১৬ সালে৷ আয়লান কুর্দির ছবির মতো এই ছবিটিও গোটা বিশ্বকে আরেকবার নাড়িয়ে দেয়৷ সিরীয়ায় গৃহযুদ্ধ কতটা বিভৎস পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে এবং সিরীয়রা কতটা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে, তার এক প্রতীক হয়ে ওঠে ছবিটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Aleppo Media Center
অজানা নতুন ঠিকানা
গ্রিক-ম্যাসিডোনিয়া সীমান্তের ইডোমিনিতে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় হাঁটছেন এক সিরীয় নাগরিক৷ ইউরোপে তাঁর পরিবার নিরাপদ থাকবে, এমনটাই প্রত্যাশা ছিল তাঁর৷ ডাবলিন রেগুলেশন অনুযায়ী, একজন শরণার্থী প্রথম ইউরোপের যে দেশে প্রবেশ করেন, সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করতে হবে৷ ফলে যারা আরো ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন, তাদের অনেককে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷
ছবি: Reuters/Y. Behrakis
সহযোগিতার আশা
বিপুল সংখ্যক শরণার্থী প্রবেশের কারণে জার্মানি অভিবাসন নীতি আরো কড়া করে ফেললেও এখনো শরণার্থীদের প্রথম পছন্দ জার্মানি৷ ইউরোপের আর কোনো দেশ জার্মানির মতো এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থী নেয়নি৷ ২০১৫ সালে সঙ্কট শুরুর পর থেকে দেশটি ১২ লক্ষ শরণার্থী নিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা
ইউরোপে শরণার্থী প্রবেশের সংখ্যা চলতি বছর কমেছে, তবে থেমে যায়নি৷ বরং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে অনেকে৷ বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং সরকারের হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছর এখন অবধি সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছে প্রায় দু’হাজার মানুষ৷ গতবছর এই সংখ্যা ছিল ৫ হাজার৷
ছবি: picture alliance/AP Photo/E. Morenatti
10 ছবি1 | 10
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস নিউ ইয়র্কে সোমবার বলেছেন, ‘‘আমাদের বিশ্বে দাসপ্রথার কোনো স্থান নেই৷'' এ ধরনের চর্চাকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ' হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি লিবিয়া সরকারের প্রতি দাসবিক্রির ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন৷
জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লিবিয়া সরকার জানিয়েছে যে, ক্রীতদাস বেচাকেনার বিষয়ে তদন্ত করার হবে৷ লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ ওমর মাইতিক এ সংক্রান্ত এক কমিশন গঠন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন৷ আর দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে লিখেছে, ‘‘দাসবিক্রির অভিযোগগুলো সত্য হলে, দোষীদের সবার শাস্তি নিশ্চিত করা হবে৷''
‘লিবিয়া ছিল এক জাহান্নাম'
লিবিয়ায় আটকে পড়া শরণার্থীদের অধিকাংশই পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজার, গিনি, বুর্কিনা ফাসো এবং আইভরি কোস্ট থেকে আসা৷ তাঁদের সঙ্গে রয়েছে ইরিত্রিয়া আর সোমালিয়ার শরণার্থীরা, যারা ইউরোপে উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছেড়েছেন৷ শরণার্থীরা সাধারণত বিভিন্ন দেশ থেকে এসে লিবিয়ায় জড়ো হন এবং সেখান থেকে সমুদ্রপথে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন৷
আইভরি কোস্টে ফিরে যাওয়া শরণার্থী সুলাইমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘লিবিয়া ছিল এক জাহান্নাম৷'' তিনি দেশটিতে বেশ কয়েকমাস বন্দি ছিলেন৷ অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন আইওএমের চেষ্টায় তিনি ভাগ্যক্রমে ছাড়া পান৷ সুলায়মান বলেন, ‘‘আমি সেখানে থাকার সময় সবসময় ভয়ে থাকতাম যে, যেকোনো সময় হয়ত কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী এসে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে এবং দাস হিসেবে বিক্রি করে দেবে৷''