ঘটনাটা সম্ভবত বছর পাঁচেক আগের। বাংলাদেশের এক টিভি চ্যানেলে কর্মরত থাকার সূত্রে একটি আয়োজন নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে জাতীয় প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম। এখন কী অবস্থা জানি না। কিন্তু তখন সপ্তাহে প্রায় সাত দিনই প্রেসক্লাবের সামনে একাধিক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হতো। বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ না হলে সেজন্য আলাদা করে এসব মানববন্ধন সংবাদের জন্যও তেমন গুরুত্ব বহন করতো না, তেমন একটা নজরও কাড়তো না।
সেসময় শিক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে বেশ আলোচনা চলছিলো। ফলে প্রেসক্লাবের ভেতর থেকেই বাইরে মাইকে 'নাস্তিক্যবাদি', 'হিন্দুয়ানি', 'কুফরি' ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ শুনে বেশ আগ্রহ জাগ্রত হয়। সাধারণত সরকারের নীতির বাইরে গিয়ে এমন বিষয়ে গরম গরম কথা বলার জন্য প্রেসক্লাবের সামনে বিএনপি বা তাদের সমমনা দলগুলোকে তেমন সুযোগ দেয়া হয় না। ফলে কারা এমন সব কথা বলছে তা দেখতে মন চাইলো।
বাইরে গিয়ে ব্যানারে চোখ পড়তেই বুঝলাম, এ তো সেই 'আওয়ামী ওলামা লীগ'। এই রহস্যময় 'ওলামা লীগ' নিজেদের আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার অনুসারী বলে দাবি করে, কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের নিজেদের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন বলে মানতে অস্বীকৃতি জানায়।
এর আগেও ওলামা লীগ বাংলা নববর্ষকে 'ইসলামবিরোধী' বলে আখ্যা দিয়ে এবং পাঠ্যপুস্তক থেকে অমুসলিম লেখকদের লেখা বাদ দেয়ার দাবি তুলে আলোচনায় এসেছিল। কিন্তু নামের মধ্যে 'লীগ' থাকলেও শিক্ষা নিয়ে এই সংগঠনের নেতাদের বক্তব্য হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার প্রায় অনুরূপ ছিল। কিন্তু তারপরও তথাকথিত 'সেক্যুলার' একটি দলের সঙ্গে এমন 'কট্টরপন্থি' সংগঠনের সংযোগ থাকে কোন ভিত্তিতে?
আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বিতর্ক সৃষ্টি হলেই নিজেদের ওলামা লীগ থেকে আলাদা করে নিয়েছেন। 'ওলামা লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই', এমন মন্তব্য একাধিক শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাই গণমাধ্যমদের সামনে করেছেন। ‘সম্পর্ক' না থাকা সত্ত্বেও এসব ছবি ও নামসর্বস্ব সংগঠনগুলো কোনো ধরনের আইনী জটিলতা ছাড়াই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে ও যাচ্ছে৷
বারবারই দলের শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে ‘নাম ভাঙিয়ে খাওয়া'র বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি আমরা শুনেছি৷ কিন্তু এজন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তা চোখে পড়েনি৷ সম্প্রতি দেশ রূপান্তর পত্রিকা এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, ‘‘ভুঁইফোড় সংগঠনগুলোর বিষয়ে আমরা কঠোর। ইতিমধ্যে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। যারা আওয়ামী লীগের নাম বিক্রি করে অপকর্ম করে আসছে তাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। প্রমাণ মিললেই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।''
ব্যবস্থা নিতে এমন গরিমসির দুটো কারণ থাকতে পারে৷ অনুমোদিত অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে অনেক নেতাকর্মীকে কমিটিতে রাখা যায় না৷ ফলে দীর্ঘদিন ধরে পদ পাওয়ার আশায় কাজ করে যাওয়া নেতাকর্মীকে এইসব অনুমোদনহীন সংগঠনের সুবাদে একটা ‘সান্ত্বনা পুরস্কার' দেয়া যায়৷ ফলে মাঠে শক্তিপ্রদর্শনে আরো বেশি এগিয়ে থাকা যায়৷ অন্যদিকে, সেসব সংগঠনের অপকর্মের দায়ও নিজেদের ঘাড়ে নিতে হয় না৷ ‘অনুমোদনহীন সংগঠনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে' বিবৃতি দিয়েই পার পাওয়া যায়৷
পুলিশ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে ঢাকাসহ সারা দেশে ১০৫টি ভুঁইফোড় সংগঠনের সন্ধান পেয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার তথ্যও নাকি রয়েছে পুলিশের কাছে৷ এইসব ‘লীগের' কয়েকটি হচ্ছে- বাংলাদেশ ইলেকট্রিক লীগ, নাপিত লীগ, দর্জি লীগ, ফকির লীগ, হারবাল লীগ, ডিজিটাল লীগ, পর্যটন লীগ, সমবায় লীগ, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, স্বাধীনতা লীগ, প্রবীণ লীগ, আওয়ামী অভিভাবক লীগ, নাগরিক লীগ, তরুণ লীগ, তৃণমূল লীগ, জননেত্রী লীগ, তরিকত লীগ ইত্যাদি৷
‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ' নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম হওয়ায় হেলেনা জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটি থেকে তড়িৎ অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, তাকে অন্য ‘নানা কারণ’ দেখিয়ে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে৷ কিন্তু এই আলোচনাটা একবার সামাল দিয়ে দিলে বাকিদের কি আদৌ কিছু হবে? অতীত অভিজ্ঞতা কী বলে?
সহযোগী ও ভুঁইফোঁড় সংগঠন কথন
আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অনেক দলেরই স্বীকৃত সহযোগী সংগঠন আছে৷ এর বাইরে এসব দল ও তাদের প্রতিষ্ঠাতা, নেতা-নেত্রীর নাম ব্যবহার করে অনেকে ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে তোলেন৷ তাদের কারণে মূল দলগুলো প্রায়ই সমস্যায় পড়ে৷
ছবি: bdnews24.com
আওয়ামী লীগ
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আটটি সহযোগী সংগঠন আছে৷ এগুলো হলো মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, তাঁতী লীগ, যুব মহিলা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ও মৎস্যজীবী লীগ৷ এর বাইরে ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও মহিলা শ্রমিক লীগ ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত৷ আর বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের সদস্যদের নামে কোনো সংগঠন করতে হলে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের’ অনুমোদন নেয়ার নিয়ম আছে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
আওয়ামী লীগের নামে ভুঁইফোঁড় সংগঠন
২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকায় আওয়ামী লীগের নামে অনেক ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে উঠেছে৷ এই সংখ্যা তিনশর বেশি হবে৷ এদের অনুমোদন না থাকলেও আওয়ামী লীগের মধ্যেই তাদের পৃষ্ঠপোষক আছে৷ আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও তাদের নিবৃত্ত করা যায়না৷ এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রী-এমপিদের দেখা যায়৷ ছবিতে আওয়ামী ওলামা লীগ নামে একটি সংগঠনের কর্মীদের দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: bdnews24.com
আলোচনায় ওলামা লীগ
২০১৯ সালে আওয়ামী ওলামা লীগ যেসব এনজিও বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য কাজ করছে তাদের নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল৷ এছাড়া বিপিএলের নামে জুয়া খেলা হচ্ছে দাবি করে বিপিএল বন্ধেরও দাবি করেছিল৷ সেই সময় ‘আওয়ামী ওলামা লীগ’ নামে আওয়ামী লীগের কোনো সহযোগী সংগঠন নেই বলে জানানো হয়৷ ২০১৬ সালেও আলোচনায় এসেছিল ওলামা লীগ৷ তখন তারা বলেছিল, পহেলা বৈশাখে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, উলুধ্বনি দেওয়া বিধর্মীদের কাজ৷
ছবি: bdnews24.com
‘চাকরিজীবী লীগ’
সম্প্রতি ফেসবুকে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামের একটি সংগঠনের পোস্টার ভাইরাল হয়৷ এতে লেখা ছিল ‘জেলা, উপজেলা ও বিদেশী শাখায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে’৷ পোস্টারে সংগঠনের সভাপতি হিসেবে হেলেনা জাহাঙ্গীরের নাম ও ছবি প্রকাশিত হয়৷ এরপর সমালোচনা শুরু হলে আওয়ামী লীগের উপকমিটির সদস্যপদ হারান হেলেনা জাহাঙ্গীর৷ বৃহস্পতিবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
শেখ হাসিনাও অবাক!
২০১৮ সালে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ‘বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, নেতা মোদের শেখ মুজিব’ স্লোগান শুনে মঞ্চে থাকা আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিকভাবে বলে ওঠেন, ‘‘এটি কী? এটি আবার কবে হলো? আগে তো শুনিনি!’’
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/A. Nath
বিএনপি
দলের ওয়েবসাইটে অঙ্গ সংগঠন হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা দল, যুবদল, কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, তাঁতী দল, ওলামা দল ও মৎস্যজীবী দলের নাম রয়েছে৷ আর সহযোগী সংগঠন হিসেবে আছে ছাত্রদল ও শ্রমিক দলের নাম৷
ছবি: bnpbd.org
বিএনপির নামে ভুঁইফোঁড় সংগঠন
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির নামে অনেক ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে উঠেছিল৷ দৈনিক প্রথম আলো বলছে, বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী ২০১২ সালে এমন অন্তত ৪০টি সংগঠনের নাম উল্লেখ করে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে দলীয় কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ অবশ্য ২০১৪ নির্বাচনের পর এসব সংগঠনের তৎপরতা কমেছে৷ সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বিএনপি জানিয়েছে, ‘শহীদ জিয়া ছাত্র পরিষদ’ নামের সংগঠনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
জাতীয় পার্টি
দলের ওয়েবসাইটে অঙ্গ সংগঠন হিসেবে জাতীয় যুব সংহতি, মহিলা পার্টি, কৃষক পার্টি, স্বেচ্ছাসেবক পার্টি, ওলামা পার্টি, সাংস্কৃতিক পার্টি, জাতীয় প্রাক্তন সৈনিক পার্টি ও জাতীয় তরুণ পার্টির নাম রয়েছে৷ এছাড়া সহযোগী সংগঠন আছে সাতটি৷ এগুলো হলো শ্রমিক পার্টি, আউনজীবী ফেডারেশন, ছাত্র সমাজ, মৎস্যজীবী পার্টি, তাঁতী পার্টি, মটর শ্রমিক পার্টি ও হকার্স পার্টি৷
ছবি: jatiyoparty.org.bd
জামায়াতে ইসলামী
দলের ওয়েবসাইটে ‘জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র’ বলে একটি পাতা রয়েছে৷ সেখানে গঠনতন্ত্র ডাউনলোড করার একটি লিংক রয়েছে, যেটিতে ক্লিক করলে ফাইল পাওয়া যায় না৷ তবে দলটির সহযোগী সংগঠন হিসেবে ইসলামী ছাত্রশিবিরের পরিচিতি রয়েছে৷ যদিও ২০১০ সালে জামায়াতে ইসলামী দাবি করেছিল, ছাত্রশিবির তাদের অঙ্গ সংগঠন নয়৷ এর বাইরে শিশুদের সংগঠন ‘ফুলকুঁড়ি আসর’ জামায়াতের অর্থায়নে চলে বলে অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: jamaat-e-islami.org
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
একাদশ সংসদে এই দলের দুজন সাংসদ আছেন৷ ওয়ার্কার্স পার্টির ওয়েবসাইট অনুযায়ী দলের গণ ও শ্রেণি সংগঠনগুলো হলো জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, জাতীয় কৃষক সমিতি, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন, বাংলাদেশ নারী মুক্তি সংসদ, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী ও জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন৷