২০১৪ থেকে ভারতের ক্ষমতায় হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি৷ একই সময়ে, দেশে বাড়ছে কিছু রাজনৈতিক টেলিভিশন সিরিজের রমরমা৷
বিজ্ঞাপন
২০৪৯ সালের ভারতে জোশিজির ভয়ে সবাই সন্ত্রস্ত৷ জোশিজির হাতে অগাধ ক্ষমতা থাকার ফলে দেশে তিনিই সর্বেসর্বা৷ জোশিজির ভারতে আন্তঃধর্ম বা আন্তঃগোষ্ঠী বিবাহ থেকে যে সন্তানদের জন্ম, তাদের গায়ে ‘মিশ্রিত' ট্যাগ৷ কাল্পনিক ট্যাগ নয়, রীতিমত চামড়ার তলায় ঢুকিয়ে রাখা চিপ৷ জোশিজির ভারতে রাষ্ট্রের চোখ কেউ এড়াতে পারে না৷ সবার চামড়ার তলার চিপ বলে দেয় কোন ধর্ম, কোন জাত, পরিবারে রক্তের ‘মিশ্রণে'র কতটুকু ইতিহাস৷ এসবের ওপর নির্ভর করছে কতটুকু জল, জমি, নিশ্বাস নেবার জন্য অক্সিজেন বা অর্থ পাবে কোনো নাগরিক৷
আপাতদৃষ্টিতে শুনলে মনে হবে ভারতের ভবিষ্যদ্বাণী করছেন কোনো জ্যোতিষী৷ কিন্তু তা নয়, খোদ ২০১৯ সালের ভারতে বসেই ২০৪৯এর ভারত দেখাচ্ছে নেটফ্লিক্সে জনপ্রিয় হওয়া একটি টেলিভিশন সিরিজ ‘লেইলা'৷ প্রয়াগ আকবরের একটি উপন্যাস থেকে নেওয়া এর গল্প৷ ১৪ জুন মুক্তি পাওয়া এই সিরিজ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল ভারতের এমন চিত্র হয়তো অসম্ভব নয়৷ প্রযুক্তির সাহায্যে দেশের নাগরিকদের ‘ক্যাটেগরাইজ' বা ভাগ করে দেওয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে ভারতে৷ কাগজ মানেই নাগরিক, নতুবা নয়, এর সাথে হাত মিলিয়েছে ‘আধার' কার্ডের মাধ্যমে নাগরিককে ডিজিটাল তথ্যে পরিণত করা৷
তবে এসব দেখে মোটেও চমকাইনি৷ ‘লেইলা'র গল্পে ভারতের আবহাওয়া, জল সংকট ও এর সাথে জাতপ্রথার এক হয়ে যাওয়া দেখে ভারতীয় নাগরিক হিসাবে ভীত হয়েছি৷ বর্তমান ভারতে গোমাংস খাওয়ার গুজব মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলে৷ নীচু জাতের ‘দলিত' হবার ‘অপরাধে' সেতু দিয়ে যাওয়ার অধিকার থাকেনা মৃতদেহেরও৷ ফলে, দড়ি দিয়ে বেঁধে সেতুর নীচেই ফেলে দিতে হয় দলিতের লাশ৷
ফলে, ২০৪৯ সালে এই ভারতেই যে ‘মিশ্রিত' কোনো নতুন বিদ্বেষী গালাগাল হয়ে উঠবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? বাকি রইলো জল, জমি, বাতাস ইত্যাদির ওপর নাগরিকের অধিকারের কথা৷ টুজি স্পেকট্রাম কাণ্ডে আকাশ বেচা নিয়ে কেলেঙ্কারির কথা সবাই জানে৷ ওড়িশায়, ছত্তিশগড়ে যেভাবে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাদের থেকে ক্রমাগতভাবে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে জমি, জল, তারপরও এই প্রশ্ন করার প্রয়োজনই বা কতটুকু?
সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার কম হয়নি৷ এমনকি ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় থেকেও যদি দেখা যায়, সংখ্যালঘুদের ওপর বারবার আঘাত এসেছে৷ কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো স্থানীয় স্বার্থে৷
ছবি: bdnews24.com
ভারতভাগের পরপরই
ভারত ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে৷ এর পরপর পূর্ব বাংলার অনেক জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে৷ অনেকে বলে থাকেন যে, রাষ্ট্রীয় মদদে স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করে৷ ১৯৪৯ সালে কালশিরা ও নাচোলে চলে বর্বরতা৷ এরপর ১৯৫০ সালে বরিশাল, ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাংশ, পাকিস্তানি পুলিশ, আনসার বাহিনী হত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণ, ধর্ষণ চালায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
গুজব ছড়িয়ে হামলা
প্রায়ই গুজব ছড়িয়ে বাঙালি হিন্দুদের ওপর হামলা করা হয়েছে, যা এখনো দেখা যায়৷ তেমনই এক ঘটনা ঘটে ১৯৬৪ সালে৷ ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে অবস্থিত হজরতবাল নামক তীর্থক্ষেত্রে হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর সংরক্ষিত মাথার চুল চুরি করা হয়েছে – এই সংবাদ ছড়িয়ে পূর্ব-বাংলায় আবারো সংগঠিত হয় বাঙালি হিন্দু হত্যা৷ আবারো হাজারো হিন্দু ধর্মাবলম্বী পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Mustafa
স্বাধীনতা আন্দোলনে
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায়৷ তারা হিন্দু অধ্যুষিত অসংখ্য গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েছে৷ একটি হিসেব বলছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪০ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যা নেমে হয়েছে ২১ শতাংশ৷
ছবি: AP
বাবরি মসজিদের গুজব
ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে এই গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা শুরু হয় ভারতীয় উপমহাদেশে৷ তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও৷ ১৯৯০ সালে হিন্দুদের উপর ৩০ অক্টোবর থেকে নির্মম নৃশংসতা শুরু হয় এবং বিরতিহীন ভাবে ২ নভেম্বর পর্যন্ত চলে৷ এই ঘটনার সূত্র ধরে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত থেকে থেকে পুরো বংলাদেশেই হিন্দুদের উপর অত্যাচার, নির্যাতন হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
রাজনৈতিক হামলার শিকার
শুধু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বা অন্য স্থানীয় স্বার্থে নয়, রাজনৈতিক কারণেও সহিংসতার শিকার হয়েছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ৷ যেমন, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নির্দিষ্টভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নৃশংস হামলা হয়৷ এমনকি ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শুরুতেও ব্যাপক হামলা হয়৷ এসব হামলার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় নয় লাখ মানুষ দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান৷
ছবি: bdnews24.com
নিস্তার পাননি অন্যান্য সংখ্যালঘুরাও
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রামের রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা করে দুর্বৃত্তরা৷ এই ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক নিন্দিত হয়৷ ২০১৬ সালে পুলিশ ও চিনিকল শ্রমিক কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় সাঁওতালদের৷ এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনজন সাঁওতাল মারা যান ও উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়৷ এছাড়া পাহাড়ে প্রায়ই নিপীড়নের খবর পাওয়া যায়৷
ছবি: AFP/Getty Images
এখনো থেমে নেই
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলার রায়ের পর হামলা করা হয় নোয়াখালীর অনেকগুলো হিন্দু বাড়িতে হামলা হয়৷ অনেক মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ এছাড়া রংপুর বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফেসবুকে মিথ্যা পোস্ট দিয়ে পরিকল্পনা করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করা হয়েছে৷ এসব ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছেন সারা দেশের মানুষ৷
ছবি: Khukon Singha
কত শতাংশ অবশিষ্ট?
কিছু হিসেবে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪০ ভাগ ছিল সংখ্যালঘু৷ ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে তা ২২ শতাংশ৷ ২০১১ সালের আদমশুমারিতে তা নেমে হয় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ৷ তবে সবশেষ ২০১৫ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো যে হিসেব দেখিয়েছে, তাতে হিন্দু ধর্মের মানুষের সংখ্যা ২০১১ থেকে বেড়েছে৷ ২০১৫ সালে দেখা গেছে, জনসংখ্যার ১০.৭ শতাংশ সংখ্যালঘু রয়েছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW
শত্রু সম্পত্তি আইন
২০০৮ সালে অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতসহ আরো কয়েকজনের লেখা নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হয়৷ বইটির নাম, ‘Deprivation of Hindu Minority in Bangladesh: Living with Vested Property’৷ সেখানে লেখকরা বলেন, শত্রু সম্পত্তি আইনের ফলে ১৯৬৫-২০০৬ সময়কালে ১২ লাখ পরিবারের ৬০ লাখ হিন্দু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন৷ এ সময় তাঁরা ২৬ লাখ একর ভূমি হারিয়েছেন৷
ছবি: bdnews24.com
হামলার বিচার হয় না
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ইতিহাস দীর্ঘ৷ কিন্তু হামলার বিচার এবং দোষীদের শাস্তির নজির নেই বাংলাদেশে৷
ছবি: bdnews24.com
10 ছবি1 | 10
মোদীজির দেশে জোশিজি
ভারতে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বেড়েছে দেশে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীদের তৎপরতা৷ ‘লাভ জিহাদ'এর নামে আন্তঃসম্প্রদায় বিবাহের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ব্যাপক নীতিপুলিশি৷ শুধু তাই নয়, ‘ঘর ওয়াপসি'র মতো প্রকল্প চেষ্টা চালাচ্ছে ভারতের মাটি থেকে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের ‘হিন্দু' ছাতার তলায় একত্রিত করতে৷ ‘অখণ্ড ভারত'র অন্তর্গত যে হিন্দু রাষ্ট্রচিন্তার প্রচার চালিয়ে আসছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ গত কয়েক দশক ধরে, সেই সংঘ পরিবারের আদর্শেই গঠিত বিজেপি৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এই সংঘেরই সাবেক সদস্য৷
ফলে, লেইলা প্রকাশ পাবার পর অনেক আলোচনায় উঠে আসছিল একই কথা- আজকের মোদীজিই আগামীর জোশিজি৷ এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে লেইলা সিরিজের অভিনেত্রী হুমা কুরেশি হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেছেন, ‘‘সব স্বৈরাচারীরাই ক্ষমতা হারাতে ভয় পান৷ তাই বাঁধন শক্ত করেন৷''
এবিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে ‘লেইলা'র জোশিজি একজন স্বৈরাচারী৷ গোল পেকে যায় তখন, যখন প্রশ্ন ওঠে মোদীজিই কি জোশিজি? অর্থাৎ, তিনি কি কিছুটা হলেও স্বৈরাচারী?
জোশিজির ভারতে তার বিরুদ্ধে কথা বলার জো নেই৷ মোদীজির ভারতে সংবাদমাধ্যম প্রায় রুদ্ধ হলেও নেটফ্লিক্সের মতো অনলাইন মাধ্যম পুরোপুরি রাষ্ট্রের আওতায় নেই৷ আলোচনা চলছে সেন্সর বোর্ডের ক্ষমতায় শীঘ্রই তা আনার, কিন্তু এখনও তা সম্ভব হয় নি৷ ফলে, জুন মাসে লেইলা মুক্তি পাবার পর এর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে সোশাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ সংগঠিত হলেও, সম্প্রচার থামানো যায়নি৷
আপাতত মোদীজির ভারত আর জোশিজির ভারত এক না৷ এখন লেইলা ছাড়াও জনপ্রিয় হয়েছে ‘সেক্রেড গেমস'র মতো সমালোচক টেলিভিশন সিরিজও৷ ভারতীয় নাগরিক হিসাবে আমার এটুকুই আশা, জোশিজি থেকে যাতে শিখতে না শুরু করেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী৷ সেটা হলে আর প্রশ্ন করার কোনো অবকাশ থাকবে না৷ আক্ষরিক অর্থেই৷