বইমেলা বইপ্রেমীদের প্রাণের জায়গা৷ কাঙ্ক্ষিত কিংবা স্বপ্নের গন্তব্য৷ এখন প্রশ্ন, বইপ্রেমী কারা? যারা বই সংশ্লিষ্ট৷ বই সংশ্লিষ্ট কারা? লেখক,প্রকাশক এবং পাঠক৷ লেখক প্রাথমিক এবং আবশ্যিক অনুষঙ্গ৷ পাঠকও৷
বিজ্ঞাপন
পাঠের ক্ষেত্রে পাঠক সিলেক্টিভ কিংবা স্বেচ্ছাধীন৷ কিন্তু লেখকের লক্ষ্য যেমন পাঠক,পাঠকের লক্ষ্যও লেখক, তবে তা শর্তসাপেক্ষে ৷ দুই দুইয়ের পরিপূরক বটে৷ এককে ছাড়া অপর পরিপূর্ণ নয়৷ অচলতো বটেই, অস্তিত্বহীনও৷ কিন্তু তবুও লেখক সর্বাংশে পাঠক মুখি নয়৷
বাকি থাকে প্রকাশক৷ তিনি এই দুইয়ের সেতুবন্ধন৷ লেখক লিখেন, প্রকাশক প্রকাশ করেন আর পাঠক পড়েন৷ লেখক না লিখলে পাঠক কিংবা প্রকাশকের অস্তিত্ব থাকে না৷ কিন্তু পাঠক না পড়লে, প্রকাশক প্রকাশক প্রকাশ না করলে লেখক লিখতেন কিনা এই বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে৷
সমকালে দুজন লেখক বহুল আলোচিত৷ একজন জীবনানন্দ, যার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লেখা আবিস্কৃত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর ট্র্যাংকে, ফটোগ্রাফ খুঁজতে গিয়ে৷ আর দ্বিতীয়জন কাফকা,যিনি তার বন্ধুকে বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর সব লেখা পুড়িয়ে দিতে৷
এই দুইজন লেখকের প্রসঙ্গের অবতারণা এজন্য যে লেখক আসলে কেন লিখেন,পাঠককে লক্ষ্য করে কি? ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় লেখার তাড়না এক অন্তর্গত বোধ,যা তাকে তাড়িত করে লিখতে৷ সেক্ষেত্রে একজন লেখক যখন লিখেন তখন কি সামনে পাঠক থাকেন? আমার ধারণা জনপ্রিয় ঘরানার লেখক ছাড়া অন্য লেখকদের মোটেই তা থাকে না৷ জনপ্রিয় ঘরানার লেখকরা লিখেন পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য৷ পাঠক কী পড়তে পছন্দ করবে,কী ধরনের লেখা সংখ্যাগরিষ্ঠ লেখকের প্রত্যাশা তা মাথায় রেখে তিনি লিখেন৷ জনপ্রিয় ধারার লেখার সাথে অর্থের সংযোগ থাকে৷ বেস্টসেলার তকমা লাভের হাতছানি থাকে৷ ফলে প্রচলিত জনমানস কিংবা প্রথার বিরুদ্ধে যায় এমন কোন সত্য তিনি উচ্চারণ করেন না,কিংবা উচ্চারণ করার সাহসও করেন না৷ তিনি বাজারমুখি৷ সাহিত্যে তিনি আবশ্যিক কিনা এ প্রশ্নটি উহ্য রেখে বলা যায়, তাকে অস্বীকার করা যায়না৷ যুগে যুগে এমন ধারার লেখক ছিলো আছে এবং থাকবে৷ তিনি জনপ্রিয় হন তাঁর লেখার ক্ষমতা দিয়েই৷ তিনি লিখতে পারেন বলেই তো লিখেন৷ লিখে পাঠক মন জয় করেন৷ তার লেখা সস্তা হতে পারে,কিন্তু সহজ নয় কোনোমতেই৷ সদাসর্বদা জনমানসকে তৃপ্ত রাখার প্রচেষ্টা খুব সহজ প্রচেষ্টা নয়৷
অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে নীরবে বই পড়া
02:32
কিন্তু জাত লেখক এসব নিয়ে ভাবিত হননা কখনোই৷ পাঠক কী চান তা ভাবেন না মোটেই৷ কিন্তু তার লেখা পাঠকের হাতে পৌঁছাক,পাঠক পড়ুক, উপলব্ধি করুক এই বাসনা তারও থাকে৷ কিন্তু প্রথা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজের শক্তিশালী কণ্ঠকে উচ্চকিত করা লেখা সবসময় গুটিকয়েকের জন্য,যারা মননশীলতার চর্চা করেন৷ যুগে যুগেই এমন পাঠকের সংখ্যা কম৷
প্রকাশক কে? প্রকাশক সে,যিনি মূলত পাঠক এবং লেখকের মধ্যে সেতুটি তৈরি করে দেন৷ এর বাইরে তার আরেকটি দায়িত্বও কিন্তু রয়েছে,যে দায়িত্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ সেটি হলো এই, যে তিনি যুগোত্তীর্ণ কিংবা কালোত্তীর্ণ লেখাকে প্রকাশের আলোতে নিয়ে আসবেন৷ তিনি হয়তো জানেন এই লেখা তেমন বেশি সংখ্যক পাঠক পড়বে না৷ এই বই বিক্রি করে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হবেন না৷ কিন্তু সামাজিক কিংবা নৈতিক কিংবা পেশাগত সততা থেকে তিনি কাজটি করবেন৷
সামাজিক দায়িত্ব বলি কিংবা নৈতিক অথবা পেশাগত সততা যে তিনটি বিষয় এখানে উল্লেখ করলাম এই তিনটি একজন পুস্তক প্রকাশকের জন্য আবশ্যিক৷ কারণ তিনি বই প্রকাশ করতে এসেছেন৷ কেবলই ব্যবসা করতে নয়৷ শুধু লাভ যদি তার কাছে মুখ্য হয় তবে তিনি আলু পটল ডিম তেল পেঁয়াজ নানা কিছুর ব্যবসা করলেই পারতেন৷ স্থূল দাগে এই তিনটি বিষয় একজন পুস্তক প্রকাশক এবং অন্য ব্যবসায়ীর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দেয় সুস্পষ্ট ভাবে৷
প্রশ্ন উঠতে পারে বই বিক্রি না হলে কি প্রকাশক লোকসান দেবে? বাংলাদেশের খুব কম প্রকাশককেই আমি লোকসান গুনতে দেখেছি৷বাংলাদেশের প্রকাশকরা সবাই ধনাঢ্য হয়েছেন বইয়ের ব্যবসা করেই৷ কিন্তু গুটি দুচারজন ছাড়া লিখে ধনাঢ্য হয়েছেন তেমন লেখক পাওয়া কঠিন৷
বইমেলার শ্রমজীবী মানুষের কথা
শুধু লেখক প্রকাশকেরা নন বইমেলাকে প্রাণবন্ত করে তোলার পেছনে ভূমিকা রাখেন শ্রমজীবী মানুষেরাও৷ বইমেলা বাড়তি আয়ের সুযোগ তাদের জন্য৷ তাদের কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
জাফর ইকবালের কাজের চাপ
ঢাকার আরামবাগের ফ্রেশ ফয়েল প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করেন জাফর ইকবাল৷ বছরের শুরুর সময়টায় তার কাজের চাপ বাড়ে, বাড়তি রোজগার হয়৷ যদিও কাগজের দাম বাড়ায় এবার বই বাঁধাইয়ের চাপ তেমন নেই বলে জানান জাফর৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ব্যস্ততা নেই আগের মতো
২০২৩ সালের বইমেলায় ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল, যেখানে তার আগের বছর বিক্রি হয়েছে ৫২ কোটি টাকার৷ দীর্ঘদিন ধরে ছাপাখানার কাজে জড়িত ঢাকার ফকিরাপুলের জবা প্রিন্টিং এর এই কর্মচারি জানান, পাঁচ বছর আগেও বইমেলায় তার কাজের চাপ কয়েকগুন বেশি ছিল, আয়ও হতো বেশি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
দিনমজুর লোকমানের আক্ষেপ
বই বিক্রি ও ছাপা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে ছাপাখানার ব্যবসায়৷ ৩০ বছর ধরে ঢাকার আরামবাগে প্রেসপাড়াতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন লোকমান হাকিম৷ তিনি জানান, ব্যবসার মন্দায় তার পরিচিত অনেকেই ছাপাখানা বন্ধ হয়ে গেছে অথবা আকার ছোট করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মেলার হাওয়াই মিঠাই
রঙ-বেরঙের হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করেন আফজাল হোসেন৷ এখন তার প্রতিদিনের গন্তব্য বাংলা একাডেমীর বইমেলা প্রাঙ্গন৷ মেলায় জনসমাগম বেশি হওয়ায় আয়ও বেশি বলে জানান আফজাল৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
স্টলের চাকচিক্য
বইয়ের বিক্রি কমলেও বাড়ছে মেলার চাকচিক্য৷ নানা সাজসজ্জায় স্টল বা প্যাভিলিয়ন আকর্ষণীয় করতে চেষ্টার কমতি নেই প্রকাশকদের, যা কাজের সুযোগ করে দিয়েছে মোঃ আরমান হোসেনের মতো বৈদ্যুতিক মিস্ত্রীর৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নিপার মালা বিক্রি
ছিন্নমূল মানুষদের কেউ কেউ বইমেলায় ফুল বা ফুলের মালা বিক্রি করে টাকা রোজগারের চেষ্টা করেন৷ তেমনই একজন নিপা আক্তার৷ তবে তার অভিযোগ, মেলা প্রাঙ্গনে তার মতো ভ্রাম্যমাণ ফুল বিক্রেতাদের দেখলেই তাড়া করছে পুলিশ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘এখন আর বই টেনে পোষায় না’
পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে ভ্যান টানার কাজ করেন লুৎফর রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘আগে বইমেলায় যেমন কাজের চাপ ছিল, এখন তার এক-তৃতীয়াংশও নেই৷ এখন যা আয় হয়, তা দিয়ে আর পোষায় না৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
স্টল তৈরি
২০১৮ সাল থেকে বইমেলায় স্টল তৈরির কাজ করেন আলী হোসেন ও মোকছেদ হোসেন৷ গত কয়েক বছরে একুশে বইমেলার পরিসর বেড়েছে৷ বেড়েছে স্টল ও প্যাভিলিয়নের সংখ্যা৷ এতে কাজ বেড়েছে আলী হোসেনদের৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা
গোপালগঞ্জের একটি সরকারি কলেজে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করেন নোমান ইসলাম৷ গত চার বছর ধরে তিনি বইমেলার কাছে খাবারের ব্যবসা করছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভ্রাম্যমাণ দোকান
শাহবাগ থেকে বইমেলায় যাওয়ার পথটিতে ভ্রাম্যমান বিক্রেতারা নানা পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন৷ বইয়ের পাশাপাশি মেয়েদের কানের দুল, চুড়ি, ক্লিপসহ বিভিন্ন অলঙ্কারের বিক্রি ভালো হয় বলে জানান ভ্রাম্যমাণ দোকানি জাফর আহমেদ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
10 ছবি1 | 10
চিন্তাশীল, মননে ঢিল ছুঁড়ে আন্দোলিত করে এমন পাঠকের সংখ্যা সবসময়ই কম৷ বাংলাদেশের প্রকাশকরা অধিকাংশই পেশার ক্ষেত্রে খুবই আপসহীন৷ তারা ব্যবসাটাই বোঝেন৷ দায়বদ্ধতা কিংবা দায়িত্বের জায়গাটিতে সৎ কোনো প্রকাশকের দেখা আমি এখনো পাইনি৷ লেখকের প্রকাশিত বইয়ের কয় কপি বিক্রি হলো, অধিকাংশ লেখক তা জানেন না৷ আমি সবসময় প্রকাশকের কাছে শুনে এসেছি আমার বই বিক্রি হয়না৷ আমি জানি, আমার বই হটকেকের মতো বিক্রি হয় না,কিংবা হটকেকের মতো বিক্রি হবে এমন বই আমি লিখতে পারিনা৷ ফলে প্রকাশকের সাথে দর কষাকষিতে যাওয়ার সাহস আমার থাকেনা৷ থাকলেও উপায় নেই৷আমি চাইলেও সত্যটা জানতে পারবো না৷
শুনেছি বই প্রকাশের আগে প্রকাশকগণ লেখকের সাথে চুক্তি করেন৷ কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমি কোন প্রকাশক পাইনি যিনি আমার সাথে লিখিত চুক্তি করেছেন৷ কোনো কোনো লেখক বলেন বটে কিন্তু তার সত্যতা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্বিধা আছে৷ দু চারজন থ্রিলার লেখক আর জনপ্রিয় ধারার গুটিকয়েক লেখক ছাড়া কোন নিবেদিত প্রান লেখক প্রকাশকের সাথে বাক্যালাপ বাড়াতে চান বলে আমার মনে হয়না৷ লেখক যে ধ্যানে লিখেন, বই বিক্রি হয়না,কেউ পড়েনা রকম মন্তব্যে সত্যিকারের লেখক মগ্নতায় ঘাটতি ঘটাতে চান বলে মনে হয়না৷ শেষ পর্যন্ত প্রকাশকই তো লেখকের ভরসা,লেখাকে পাঠক অন্তত একজন পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও তো প্রকাশকই এগিয়ে আসেন৷ তাই লেখকের প্রকাশকের সাথে সদ্ভাব রাখাটাই যুক্তিযুক্ত৷ নইলে জীবনানন্দের মতো ট্র্যাংকবন্দী করে রাখাই লেখার নিয়তি৷ এ যুগে এতোটা নির্মোহ লেখক পাওয়া বোধকরি কঠিন৷ চুক্তিতে আবদ্ধ না হলেও আমি বেশ কয়েকজন প্রকাশকের কাছ থেকে রয়্যালটির টাকা পেয়েছি৷ যদিও তা টাকার অংকে সামান্যই৷ এতে লেখক হিসাবে আপত্তি নেই৷ কিন্তু প্রকাশক সম্ভবত তখন বইয়ের প্রকাশক হিসাবে নিজের নৈতিকতার পরিচয় দিতে পারবেন,যখন তিনি বই বিক্রির উপর ভরসা না করে লেখককে রয়্যালটি দিয়ে প্রকাশের জন্য একটি ভালো বই মনোনীত করবেন৷
ইদানিং বইমেলায় একটি প্রবণতা ফেইসবুক সেলিব্রিটি,মোটিভেশনাল কিংবা আমলা, ক্ষমতাবান,বিত্তশালীদের বই প্রকাশ৷ এদের বই প্রকাশে প্রকাশকদের আগ্রহ অসীম৷ এদের বই প্রকাশে প্রকাশকদের প্রবল ও প্রচুর আগ্রহ৷ এক্ষেত্রে প্রকাশকদের কোন আর্থিক ঝুঁকি থাকেনা৷ টাকার বিনিয়োগ নিয়ে ভাবতে হয়না,উলটো অনুগত কিংবা স্বার্থগত কারণে বইয়ের ক্রেতারও অভাব হয়না৷
তেতো হলেও যা সত্য, তা হলো খুব কম প্রকাশক খুঁজে ভালো বই প্রকাশ করেন৷ লেখকের নিজেকে প্রমাণের যাত্রাটি বড়োই নিঃসঙ্গ একা৷ যিনি লেখালেখিকে পেশা নয়, মননে ধারণ করেন তিনি বইমেলা কেন্দ্রিক বই লিখেন না৷ বিক্রি নিয়ে তারা খুব চিন্তিতও নন৷ কিন্তু প্রকাশকগণ মেলা কেন্দ্রিক৷ বেশিরভাগ প্রকাশক মেলাকে কেন্দ্র করেই বই প্রকাশ করেন৷ এই মেলা কেন্দ্রিক বই প্রকাশের লক্ষ্য নিশ্চয়ই বিক্রি৷ বলা বাহুল্য মেলাকেন্দ্রিক পাঠক অপাঠক সবারই বই কেনার ঝোঁক থাকে৷ জনপ্রিয় লেখকের বই বিক্রি বেশি হয়,অজনপ্রিয়দের বই বিক্রি হয় কম৷ কিন্তু তাই বলে লেখক কি হতাশ হন? বিক্রির জোয়ারভাটা তাকে কি বিমর্ষ করে?যিনি প্রাণের আনন্দে লিখেন, তিনি অনাহারে থেকেও লিখেন,অর্ধাহারে থেকেও লিখেন৷ বেচাকেনার হাট তাঁকে বিচলিত করে বলে মনে হয় না কখনোই৷
প্রসঙ্গ : পাঠকের রুচি ও অগ্রাধিকার
করোনাকালের বইমেলার ‘বেস্টসেলার’ দিয়ে কি পাঠকের সার্বিক রুচি এবং বই কেনায় পরিবর্তনের ধারা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়? তরুণ পাঠক এখন কী বেশি পড়ছেন? কেন পড়ছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ইংরেজিতে দক্ষতা এখন অনেক জরুরি
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এএফপি’র সাংবাদিক স্যাম জাহানের মতে, ‘‘বিগত এক দশকের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তরুণদের কাছে শিল্প-সাহিত্য চর্চার চেয়ে ইংরেজি শেখাটা এখন বেশি লাভজনক বিনিয়োগ৷ বিপুল সংখ্যক মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ উন্নত জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে এখন দেশত্যাগে আগ্রহী৷ বিদেশে স্থায়ী হওয়ার জন্য ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হওয়া জরুরি, তাই সেদিকেই তাদের মনোযোগ বেশি৷’’
ছবি: Privat
অনিশ্চয়তার মধ্যে সাহিত্য-চর্চা সম্ভব না
ইকমার্স নির্বাহী সামিউর রহমান বলেন, ‘‘তরুণদের বই পড়ায় আগ্রহ কমছে, আমি তা মনে করি না৷ গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যে আত্মোন্নয়ন এবং ইংরেজি শেখার চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে৷ অনেক দেশের তুলনায় আমাদের ইংরেজি শিক্ষার মান অত্যন্ত দুর্বল৷ আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত৷ সুতরাং এই অবস্থায় সাহিত্য-চর্চা শুধু নাটক-সিনেমাতে সম্ভব, বাস্তবে নয়৷’’
ছবি: Privat
বিষয়টি দ্বান্দ্বিক এবং অশনিসংকেত
লেখক ও আলোকচিত্রী শাহরিয়ার খান শিহাব বলেন, তরুণ সমাজ যে-কোনো বই পড়ছে বিষয়টি আনন্দের৷ তবে বইমেলায় কেন সৃষ্টিশীল রচনা সর্বোচ্চ বিক্রির আসনে নেই, সেখানে কেন একটি ভাষা শিক্ষার বই, এটি একটি দ্বন্দ্বপূর্ণ আলাপ৷ অন্তরালের কারণ হিসেবে বলা যায়, এখনকার লেখকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে লেখনীর মান যেমন তলানিতে যাচ্ছে, তেমনি পাঠ্যপুস্তকের বাইরের মৌলিক বইয়ের প্রতিও তরুণদের অনীহা বাড়ছে, এটা আশঙ্কাজনক৷
ছবি: Privat
সৃষ্টিশীল বই পড়ার সুযোগ কম
ঢাকা ডেন্টাল কলেজের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মাশুক শাহরিয়ার বলেন, ‘‘আমার আশেপাশের সবাই এখন পড়াশোনা, চাকরি এবং ক্যারিয়ার নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ তীব্র প্রতিযোগিতার এই যুগে পাঠ্যপুস্তক পড়ার পর যেটুকু সময় হাতে থাকে, তা আমরা অনলাইনে দেই৷ আমি নিজেই আগের মতো গল্প বা উপন্যাসের বইয়ের প্রতি সেভাবে আগ্রহ অনুভব করি না৷ বিগত কয়েক বছরের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখন মানুষ বই কিনছে মনের খোরাক মেটাতে নয়, প্রয়োজনের তাগিদে৷’’
ছবি: Privat
বই পড়া বাদেও এখন অপশন অনেক
ব্যাংক কর্মরত ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের সময়ে আমরা তিন গোয়েন্দা, কমিকস এসব বই পড়তাম, কারণ, আমাদের অপশন ছিল না৷ এখন ছেলেমেয়েদের ঘরে বসে সময় কাটানোর মাধ্যমের অভাব নেই৷ সৃষ্টিশীল বই-বিমুখতার পিছনে অভিভাবকরাও দায়ী, তারা সন্তানদের পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়তে দিতে আগ্রহী না৷ যেহেতু এখন সব ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা বেশি, ইংরেজিতে দক্ষতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, সুতরাং এ ধরনের বইয়ের প্রতি ঝোঁকটা স্বাভাবিক৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মৌলিক চাহিদা সবার আগে
চাকরিপ্রত্যাশী স্থপতি এনায়েত হোসেন বলেন, ‘‘একজন মানুষ শিল্প-সাহিত্যের দিকে তখনই মনোনিবেশ করবে যখন তার মৌলিক চাহিদা পূরণ হবে,পেটভরা থাকবে৷ তরুণ সমাজ এখন হতাশায় ভুগছে, বিভিন্ন দিকে তারা ব্যর্থ৷ এ থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা অনুপ্রেরণামূলক বই অথবা ইংরেজির মতো আন্তর্জাতিক ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হচ্ছে৷ তরুণদের বেকারত্ব, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মধ্যে এইসব সাহিত্য চর্চা এখন বিলাসিতারই নামান্তর বলে আমি মনে করি৷’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মানুষ বই কিনছে নিতান্তই প্রয়োজনে
প্রতীক প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার নূর ই প্রতীক বলেন, ‘‘মানুষ এখন নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বই কেনে না৷ বিষয়গুলো মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার সাথে কিছুটা জড়িত৷ তবে ইংরেজি ভাষা বা অনুপ্রেরণামূলক বই বেস্ট সেলার হচ্ছে মানে যে অন্যান্য বই বিক্রি একদম কম হয়, বিষয়টা তা-ও না৷ মানুষ বই পড়ছে, তবে সেসব বই বিক্রির তথ্য অতটা আলোকপাত হয় না৷ কে জানে, পরের বছরে হয়ত কোনো সৃষ্টিশীল বই সর্বোচ্চ বিক্রির জায়গা দখল করতেও পারে৷’’
ছবি: Privat
সংখ্যা সবকিছু যাচাইয়ের মাপকাঠি নয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, ‘‘দেখা যায় একটি ‘গম্ভীর’ বইয়ের তুলনায় একটি সাধারণ বই অনেক বেশি বিক্রি হচ্ছে৷ সব বইয়ের পাঠক যে সবাই না, এটাও বুঝতে হবে৷ যা প্রয়োজনে কেনা হয়, সেটা দিয়ে পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি মাপা কঠিন৷ তরুণরা বই পড়ছে এবং কিনছে৷ গতবছর প্রায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়, যার অধিকাংশ ক্রেতা এই তরুণেরা৷ যুগ ডিজিটাল হচ্ছে, কিন্তু বই পড়া থেমে নেই৷’’
ছবি: privat
তরুণ প্রজন্ম এখন বাস্তববাদী এবং সচেতন
একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর পরামর্শক মোস্তফা ফেরদৌস ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘‘আমার আশেপাশের তরুণরা এখন চাকরি, ব্যবসা, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন৷ মহামারির কারণে সবাই চাচ্ছে ঘরে বসেই নিজেদের দক্ষতাকে শাণিত করতে৷ তবে আমি দেখেছি যারা প্রকৃত পাঠক, তারা বই কিনছেই৷ কিন্তু বই পড়ার আগ্রহ একদম কম দেখতে পাচ্ছি অপেক্ষাকৃত নতুন প্রজন্মের মাঝে, যারা ডিজিটাল দুনিয়ায় নিজেদের হারিয়েই ফেলছে বলা চলে৷’’