1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লেখক-প্রকাশক সদ্ভাব থাকা সময়ের দাবি

রুমা মোদক
রুমা মোদক
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বইমেলা বইপ্রেমীদের প্রাণের জায়গা৷ কাঙ্ক্ষিত কিংবা স্বপ্নের গন্তব্য৷ এখন প্রশ্ন, বইপ্রেমী কারা? যারা বই সংশ্লিষ্ট৷ বই সংশ্লিষ্ট কারা? লেখক,প্রকাশক এবং পাঠক৷ লেখক প্রাথমিক এবং আবশ্যিক অনুষঙ্গ৷ পাঠকও৷

প্রকাশিত বইয়ের কয় কপি বিক্রি হলো, অধিকাংশ লেখক তা জানেন না৷ ছবি: Habibur Rahman/aal.photo/IMAGO

পাঠের ক্ষেত্রে পাঠক সিলেক্টিভ কিংবা স্বেচ্ছাধীন৷ কিন্তু লেখকের লক্ষ্য যেমন পাঠক,পাঠকের লক্ষ্যও লেখক, তবে তা শর্তসাপেক্ষে ৷ দুই দুইয়ের পরিপূরক বটে৷ এককে ছাড়া অপর পরিপূর্ণ নয়৷ অচলতো বটেই, অস্তিত্বহীনও৷ কিন্তু তবুও লেখক সর্বাংশে পাঠক মুখি নয়৷

বাকি থাকে প্রকাশক৷ তিনি এই দুইয়ের সেতুবন্ধন৷ লেখক লিখেন, প্রকাশক প্রকাশ করেন আর পাঠক পড়েন৷ লেখক না লিখলে পাঠক কিংবা প্রকাশকের অস্তিত্ব থাকে না৷ কিন্তু পাঠক না পড়লে, প্রকাশক প্রকাশক প্রকাশ না করলে লেখক লিখতেন কিনা এই বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে৷

সমকালে দুজন লেখক বহুল আলোচিত৷ একজন জীবনানন্দ, যার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লেখা আবিস্কৃত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর ট্র্যাংকে, ফটোগ্রাফ খুঁজতে গিয়ে৷ আর দ্বিতীয়জন কাফকা,যিনি তার বন্ধুকে বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর তাঁর সব লেখা পুড়িয়ে দিতে৷

এই দুইজন লেখকের প্রসঙ্গের অবতারণা এজন্য যে লেখক আসলে কেন লিখেন,পাঠককে লক্ষ্য করে কি? ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় লেখার তাড়না এক অন্তর্গত বোধ,যা তাকে তাড়িত করে লিখতে৷ সেক্ষেত্রে একজন লেখক যখন লিখেন তখন কি সামনে পাঠক থাকেন? আমার ধারণা জনপ্রিয় ঘরানার লেখক ছাড়া অন্য লেখকদের মোটেই তা থাকে না৷ জনপ্রিয় ঘরানার লেখকরা লিখেন পাঠকের মনোরঞ্জনের জন্য৷ পাঠক কী পড়তে পছন্দ করবে,কী ধরনের লেখা সংখ্যাগরিষ্ঠ লেখকের প্রত্যাশা তা মাথায় রেখে তিনি লিখেন৷ জনপ্রিয় ধারার লেখার সাথে অর্থের সংযোগ থাকে৷ বেস্টসেলার তকমা লাভের হাতছানি থাকে৷ ফলে প্রচলিত জনমানস কিংবা প্রথার বিরুদ্ধে যায় এমন কোন সত্য তিনি উচ্চারণ করেন না,কিংবা উচ্চারণ করার সাহসও করেন না৷ তিনি বাজারমুখি৷ সাহিত্যে তিনি আবশ্যিক কিনা এ প্রশ্নটি উহ্য রেখে বলা যায়, তাকে অস্বীকার করা যায়না৷ যুগে যুগে এমন ধারার লেখক ছিলো আছে এবং থাকবে৷ তিনি জনপ্রিয় হন তাঁর লেখার ক্ষমতা দিয়েই৷ তিনি লিখতে পারেন বলেই তো লিখেন৷ লিখে পাঠক মন জয় করেন৷ তার লেখা সস্তা হতে পারে,কিন্তু সহজ নয় কোনোমতেই৷  সদাসর্বদা জনমানসকে তৃপ্ত রাখার প্রচেষ্টা খুব সহজ প্রচেষ্টা নয়৷ 

অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে নীরবে বই পড়া

02:32

This browser does not support the video element.

কিন্তু জাত লেখক এসব নিয়ে ভাবিত হননা কখনোই৷ পাঠক কী চান তা ভাবেন না মোটেই৷ কিন্তু তার লেখা পাঠকের হাতে পৌঁছাক,পাঠক পড়ুক, উপলব্ধি করুক এই বাসনা তারও থাকে৷ কিন্তু প্রথা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিজের শক্তিশালী কণ্ঠকে উচ্চকিত করা লেখা সবসময় গুটিকয়েকের জন্য,যারা মননশীলতার চর্চা করেন৷ যুগে যুগেই এমন পাঠকের সংখ্যা কম৷

প্রকাশক কে? প্রকাশক সে,যিনি মূলত পাঠক এবং লেখকের মধ্যে সেতুটি তৈরি করে দেন৷ এর বাইরে তার আরেকটি দায়িত্বও কিন্তু রয়েছে,যে দায়িত্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ সেটি হলো এই, যে তিনি যুগোত্তীর্ণ কিংবা কালোত্তীর্ণ লেখাকে প্রকাশের আলোতে নিয়ে আসবেন৷ তিনি হয়তো জানেন এই লেখা তেমন বেশি সংখ্যক পাঠক পড়বে না৷ এই বই বিক্রি করে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হবেন না৷ কিন্তু সামাজিক কিংবা নৈতিক কিংবা পেশাগত সততা থেকে তিনি কাজটি করবেন৷

সামাজিক দায়িত্ব বলি কিংবা নৈতিক অথবা পেশাগত সততা যে তিনটি বিষয় এখানে উল্লেখ করলাম এই তিনটি একজন পুস্তক প্রকাশকের জন্য আবশ্যিক৷ কারণ তিনি বই প্রকাশ করতে এসেছেন৷ কেবলই ব্যবসা করতে নয়৷ শুধু লাভ যদি তার কাছে মুখ্য হয় তবে তিনি আলু পটল ডিম তেল পেঁয়াজ নানা কিছুর ব্যবসা করলেই পারতেন৷  স্থূল দাগে এই তিনটি বিষয়  একজন পুস্তক প্রকাশক এবং অন্য ব্যবসায়ীর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দেয় সুস্পষ্ট ভাবে৷

প্রশ্ন উঠতে পারে বই বিক্রি না হলে কি প্রকাশক লোকসান দেবে? বাংলাদেশের খুব কম প্রকাশককেই আমি লোকসান গুনতে দেখেছি৷বাংলাদেশের প্রকাশকরা সবাই ধনাঢ্য হয়েছেন বইয়ের ব্যবসা করেই৷ কিন্তু গুটি দুচারজন ছাড়া লিখে ধনাঢ্য হয়েছেন তেমন লেখক পাওয়া কঠিন৷

চিন্তাশীল, মননে ঢিল ছুঁড়ে আন্দোলিত করে এমন পাঠকের সংখ্যা সবসময়ই কম৷ বাংলাদেশের প্রকাশকরা অধিকাংশই পেশার ক্ষেত্রে খুবই আপসহীন৷ তারা ব্যবসাটাই বোঝেন৷ দায়বদ্ধতা কিংবা দায়িত্বের জায়গাটিতে সৎ কোনো প্রকাশকের দেখা আমি এখনো পাইনি৷ লেখকের প্রকাশিত বইয়ের কয় কপি বিক্রি হলো, অধিকাংশ লেখক তা জানেন না৷ আমি সবসময় প্রকাশকের কাছে শুনে এসেছি আমার বই বিক্রি হয়না৷ আমি জানি, আমার বই হটকেকের মতো বিক্রি হয় না,কিংবা হটকেকের মতো বিক্রি হবে এমন বই আমি লিখতে পারিনা৷ ফলে প্রকাশকের সাথে দর কষাকষিতে যাওয়ার সাহস আমার থাকেনা৷ থাকলেও উপায় নেই৷আমি চাইলেও সত্যটা জানতে পারবো না৷

শুনেছি বই প্রকাশের আগে প্রকাশকগণ লেখকের সাথে চুক্তি করেন৷ কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমি  কোন প্রকাশক পাইনি যিনি আমার সাথে লিখিত চুক্তি করেছেন৷ কোনো কোনো লেখক বলেন বটে কিন্তু তার সত্যতা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে দ্বিধা আছে৷  দু চারজন থ্রিলার লেখক আর জনপ্রিয় ধারার গুটিকয়েক লেখক ছাড়া কোন নিবেদিত প্রান লেখক প্রকাশকের সাথে বাক্যালাপ বাড়াতে চান বলে আমার মনে হয়না৷ লেখক যে ধ্যানে লিখেন, বই বিক্রি হয়না,কেউ পড়েনা রকম মন্তব্যে সত্যিকারের লেখক মগ্নতায় ঘাটতি ঘটাতে চান বলে মনে হয়না৷ শেষ পর্যন্ত প্রকাশকই তো লেখকের ভরসা,লেখাকে পাঠক অন্তত একজন পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও তো প্রকাশকই এগিয়ে আসেন৷ তাই লেখকের প্রকাশকের সাথে সদ্ভাব রাখাটাই যুক্তিযুক্ত৷ নইলে জীবনানন্দের মতো ট্র্যাংকবন্দী করে রাখাই লেখার নিয়তি৷ এ যুগে এতোটা নির্মোহ লেখক পাওয়া বোধকরি কঠিন৷ চুক্তিতে আবদ্ধ না হলেও আমি বেশ কয়েকজন প্রকাশকের কাছ থেকে রয়্যালটির টাকা পেয়েছি৷ যদিও তা টাকার অংকে সামান্যই৷ এতে লেখক হিসাবে আপত্তি নেই৷ কিন্তু প্রকাশক সম্ভবত তখন বইয়ের প্রকাশক হিসাবে নিজের নৈতিকতার পরিচয় দিতে পারবেন,যখন তিনি বই বিক্রির উপর ভরসা না করে লেখককে রয়্যালটি দিয়ে প্রকাশের জন্য একটি ভালো বই মনোনীত করবেন৷

ইদানিং বইমেলায় একটি প্রবণতা ফেইসবুক সেলিব্রিটি,মোটিভেশনাল  কিংবা আমলা, ক্ষমতাবান,বিত্তশালীদের বই প্রকাশ৷ এদের বই প্রকাশে প্রকাশকদের আগ্রহ অসীম৷ এদের বই প্রকাশে প্রকাশকদের প্রবল ও প্রচুর আগ্রহ৷ এক্ষেত্রে প্রকাশকদের কোন আর্থিক ঝুঁকি থাকেনা৷ টাকার বিনিয়োগ নিয়ে ভাবতে হয়না,উলটো অনুগত কিংবা স্বার্থগত কারণে বইয়ের ক্রেতারও অভাব হয়না৷

তেতো হলেও যা সত্য, তা হলো খুব কম প্রকাশক খুঁজে ভালো বই প্রকাশ করেন৷ লেখকের নিজেকে প্রমাণের যাত্রাটি বড়োই নিঃসঙ্গ একা৷ যিনি লেখালেখিকে পেশা নয়, মননে ধারণ করেন তিনি বইমেলা কেন্দ্রিক বই লিখেন না৷ বিক্রি নিয়ে তারা খুব চিন্তিতও নন৷ কিন্তু প্রকাশকগণ মেলা কেন্দ্রিক৷ বেশিরভাগ প্রকাশক মেলাকে কেন্দ্র করেই বই প্রকাশ করেন৷ এই মেলা কেন্দ্রিক বই প্রকাশের লক্ষ্য নিশ্চয়ই বিক্রি৷ বলা বাহুল্য মেলাকেন্দ্রিক পাঠক অপাঠক সবারই বই কেনার ঝোঁক থাকে৷ জনপ্রিয় লেখকের বই বিক্রি বেশি হয়,অজনপ্রিয়দের বই বিক্রি হয় কম৷ কিন্তু তাই বলে লেখক কি হতাশ হন? বিক্রির জোয়ারভাটা তাকে কি বিমর্ষ করে?যিনি প্রাণের আনন্দে লিখেন, তিনি অনাহারে থেকেও লিখেন,অর্ধাহারে থেকেও লিখেন৷ বেচাকেনার হাট তাঁকে বিচলিত করে বলে মনে হয় না কখনোই৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ