সৌদি আরব সফরে এসে লেবাননের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে৷ সৌদি আরব জানিয়েছে, লেবানন কার্যত সে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে৷
বিজ্ঞাপন
গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সৌদি আরব ও ইরানের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা নতুন বিষয় নয়৷ বিশেষ করে যেখানেই শিয়া-সুন্নি সংঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে এই উত্তেজনা আরও বেশি করে লক্ষ্য করা যায়৷ কিন্তু এবার লেবাননকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার লড়াই নতুন ও বিপজ্জনক মাত্রা পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ বহু জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের ছোট এই দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারসাম্যের চেষ্টা চালানো হয়ে থাকে৷ সেই বোঝাপড়া আবার হুমকির মুখে৷
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল-হারিরি সৌদি আরব সফরে এসে শনিবার পদত্যাগের ঘোষণা করেন৷ তাঁর আশঙ্কা, দেশে তাঁর প্রাণ যেতে পারে, ঠিক যেমনটা তাঁর বাবা ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রফিক আল হারিরির ক্ষেত্রে ঘটেছিল৷ এই পরিস্থিতির জন্য তিনি হেজবোল্লাহ গোষ্ঠী ও তাদের মদতদাতা ইরানকে দায়ী করেন৷ উল্লেখ্য, দেশ ছাড়ার ঠিক আগে তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনেই-এর শীর্ষ উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন৷
এবার সৌদি আরব জানিয়েছে, লেবানন সে দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বলে বিবেচনা করা হবে৷ সৌদি আরবের পারস্য উপসাগরীয় বিষয়ক মন্ত্রী তামের আল-সাবহান আরও বলেন, ক্ষমতায় আসার পর এক বছরে হারিরি প্রশাসন হেজবোল্লাহর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে৷ ওই গোষ্ঠীকে দেশের দক্ষিণে ফেরত পাঠিয়ে কোণঠাসা করা হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন৷ তবে সৌদি আরব সেই লক্ষ্যে কী পদক্ষেপ নেবে, সৌদি মন্ত্রী সে বিষয়ে কিছু জানাননি৷
হেজবোল্লাহ নেতা সৈয়দ হাসান নাসরাল্লাহ হারিরির বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়েছেন৷ তাঁর মতে, এই বিবৃতি আসলে সৌদি আরব লিখে দিয়েছে৷ তারাই হারিরিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে৷ হেজবোল্লাহর ঘনিষ্ঠ লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন৷ সংসদের স্পিকার নবিহ বেরি-ও এই মুহূর্তে নতুন সরকার গড়ার কোনো উদ্যোগ নেই বলে জানিয়েছেন৷ হারিরি শীঘ্রই দেশে ফিরবেন বলে কিছু মহল আশা করছে৷
উল্লেখ্য, সৌদি আরবের সঙ্গে হারিরি পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে৷ হারিরি নিজে সৌদি আরবেরও নাগরিক৷ বর্তমানে সে দেশে যে দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান চলছে, তারই আওতায় হারিরিকে পদত্যাগ করতে হয়েছে বলে কিছু মহল অনুমান করছে৷
সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল জুবেইর অবশ্য এমন সব সম্ভাবনার কথা নাকচ করে দিয়েছেন৷ তাঁর মতে, লেবাননে সরকারের মধ্যে হেজবোল্লাহর দাপটের কারণেই বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী৷ হারিরি ইচ্ছে করলে যে কোনো সময়ে সৌদি আরব ছেড়ে চলে যেতে পারেন বলে তিনি মন্তব্য করেন৷ হারিরি এর মধ্যে সৌদি আরব ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন বলে তাঁর নিজস্ব টেলিভিশন কেন্দ্র ফিউচার টিভি জানিয়েছে৷
সৌদি ক্ষমতাকেন্দ্রে তারুণ্য
সৌদি আরবের ভবিষ্যৎ বাদশাহ মহম্মদ বিন সালমান ‘এমবিএস’ নামেও পরিচিত৷ গত কয়েক বছরে ক্ষমতাকেন্দ্রে তাঁর উত্থান সবার নজর কেড়েছে৷ এই তরুণ নেতা সম্পর্কে এই তথ্যগুলো কি জানা আছে?
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
বাদশাহর আস্থাভাজন
অশীতিপর বাবা বাদশাহ সালমান কার্যত দেশের ক্ষমতা প্রিয় ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন৷ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়াও তিনি পেট্রোলিয়াম কোম্পানি আরামকো ও দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন৷ উপ প্রধানমন্ত্রী পদও তাঁর দখলে ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Saudi Press Agency
ঝুঁকি নিতে ভয় পান না
প্রচণ্ড পরিশ্রমী বলে পরিচিত মহম্মদ বিন সালমান সৌদি শাসকগোষ্ঠীর এতকালের ধীরস্থির ভাবমূর্তি ভেঙে দিয়েছেন৷ অর্থনৈতিক সংস্কারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি এতদিনের নানা প্রথা ভেঙে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন৷ তাঁর সমর্থকরা মনে করেন, বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে দেশে এমন নেতারই প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/abaca/Balkis Press
পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন
এতকালের সংযম ভেঙে ফেলে সৌদি আরব গোটা অঞ্চলে নিজস্ব স্বার্থরক্ষায় বেশ কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ ইরানের প্রতি বৈরি মনোভাব, ইয়েমেনে সেনা অভিযান থেকে শুরু করে কাতারকে একঘরে করে ফেলার সিদ্ধান্তের পেছনেও মহম্মদ বিন সুলতানের স্বাক্ষর স্পষ্ট৷ ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার স্থপতিও তিনি৷
ছবি: picture alliance / AP Photo
রাজপরিবারে উত্থান
সৌদি রাজপরিবারের জটিল ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোণঠাসা করে বাদশাহর ঠিক পরে শীর্ষ স্থানে পৌঁছানোর মতো অসাধ্যসাধন করেছেন ‘এমবিএস’৷ শুধু তাই নয়, এতকাল মনোনীত ‘ক্রাউন প্রিন্স’ মহম্মদ বিন নায়েফ (বামে) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও উপাধি খুইয়েও তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন৷
ছবি: Reuters/Saudi Press Agency
ব্যতিক্রমী জীবন
সৌদি রাজপরিবারের সন্তানরা সাধারনত বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন, কমপক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছে যান৷ মহম্মদ বিন সালমান সেই পথে না গিয়ে দেশে থেকেই আইন নিয়ে পড়েছেন এবং বাবার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন৷ বাদশাহ সালমান যখন নিজে ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন, তখনও তিনি বাবার রাজসভার দায়িত্বে ছিলেন৷
ছবি: Getty Images
পেট্রোলিয়ামের উপর নির্ভরতা
সৌদি অর্থনীতি এতকাল তার বিশাল পেট্রোলিয়াম ভাণ্ডারের উপর নির্ভর করে ছিল৷ মহম্মদ বিন সালমান অর্থনীতির খোলনলচে বদলে ২০৩০ সালের মধ্যে সেই পরিস্থিতি বদলানোর উদ্যোগ শুরু করেছেন৷ ভরতুকিসহ অনেক সুযোগসুবিধা বন্ধ করে তিনি বেশ কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্তও নিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/Ali Jarekji
ধর্মীয় অনুশাসন
সৌদি আরবের প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে এখনো কোনো বড় সংঘাতে যাননি মহম্মদ বিন সালমান৷ তবে দেশের বিশাল যুবসমাজের কথা ভেবে তিনি সংগীতের জলসা, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছেন৷ সেইসঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনের তত্ত্বাবধায়ক পুলিশের দৌরাত্ম্য কিছুটা কমিয়েছেন৷